অনির্বাণ সাহা: চন্দননগর নিবাসী কানাইলাল দত্ত ভারতের মুক্তিসংগ্রামের প্রথম যুগের বিপ্লবী । ১৮৮৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগরে মাতুলালয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল হুগলি জেলার খরসরাই বেগমপুর গ্রামে । পিতা চুনিলাল দত্ত ছিলেন বোম্বাইতে ব্রিটিশ সরকারের নৌবিভাগের একজন হিসাবরক্ষক । কানাইলাল শৈশবে বোম্বাইয়ের গিরগাঁও এরিয়ান এডুকেশন সোসাইটি স্কুলে এবং পরবর্তী সময়ে চন্দননগর দুপ্লেক্স বিদ্যামন্দিরে (বর্তমান কানাইলাল বিদ্যামন্দির) অধ্যয়ন করেন। ১৯০৮ সালে হুগলি মোহসীন কলেজ থেকে বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও বিপ্লব ও রাজদ্রোহিতার অভিযোগে কারারুদ্ধ হওয়ায় ইংরেজ সরকার তাঁকে ডিগ্রি প্রদানে বাধা দেয়, কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সে বাধা উপেক্ষা করে তাঁকে ডিগ্রি প্রদান করে ।
কানাইলাল চন্দননগর যুগান্তর পার্টির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক চারুচন্দ্র রায়ের সান্নিধ্য লাভ করেন । তাঁরই অনুপ্রেরণায় কানাইলাল বিপ্লববাদে দীক্ষা নেন এবং ব্রিটিশ-ভারতে বিপ্লবীদের মুখপত্র যুগান্তর ও অন্যান্য পত্রিকা, বিভিন্ন বৈপ্লবিক আন্দোলনের ইতিহাস এবং দেশপ্রেমিকদের জীবনগাথা পাঠে উদ্বুদ্ধ হন । শ্রীশচন্দ্র ঘোষের সক্রিয় নেতৃত্বাধীনে উপেন্দ্রনাথ, নরেন্দ্রনাথ, বসন্তকুমার প্রমুখের গোন্দলপাড়া গোষ্ঠীর সঙ্গে কানাইলালের ঘনিষ্ঠতা হয় । শ্রীশচন্দ্রেরই ব্যবস্থাপনায় কানাইলাল আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও আয়ত্ত করেন । ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চন্দননগর গোষ্ঠীর মধ্যে এক নব উদ্দীপনার সৃষ্টি করে, যার পুরোভাগে ছিলেন কানাইলাল। এ সময় চন্দননগরে বিলাতি বস্ত্রবর্জন আন্দোলনসহ ইংরেজবিরোধী অসংখ্য স্থানীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে কানাইলাল খ্যাতি অর্জন করেন । বি.এ.পরীক্ষা শেষে কলকাতায় বারীন্দ্রকুমার ঘোষ পরিচালিত গুপ্ত বিপ্লবী গোষ্ঠীর কার্যকলাপে কানাইলাল সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং ভবানীপুরের এক গৃহে গোপনে কর্মময় জীবন অতিবাহিত করেন । পরে তিনি বাগবাজারের ১৫ গোপীমোহন দত্ত লেনে চলে যান, যেখানে ছিল বিপ্লবীদের জন্য অস্ত্র ও বারুদের ভান্ডার ।
১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসুর কিংসফোর্ড হত্যাচেষ্টার ঘটনার পর আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ২রা মে অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ও অন্যান্যের সঙ্গে কানাইলালও গ্রেপ্তার হন। তাঁদের আলীপুর জেলে (বর্তমান প্রেসিডেন্সি জেল) রাখা হয় । এ মামলার অন্যতম আসামি নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী প্রাণ বাঁচাতে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হওয়ায় বিপ্লবীরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় । ১৯০৮ সালের ৩১ আগস্ট দলপতির নির্দেশে কানাইলাল অপর বন্দি বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সহযোগিতায় জেল হাসপাতালের ভেতরই নরেন গোস্বামীকে হত্যা করেন। এই হত্যাকাণ্ডকে কানাইলাল "পলিটিক্যাল মার্ডার" বলে অভিহিত করেন। বিচারে কানাইলালের ফাঁসির আদেশ হয়। এ খবর শুনে তিনি তাঁর জন্য কাউকে আপিল করতে নিষেধ করেন । বিনা আপিলে ১৯০৮ সালের ১০ই নভেম্বর ফাঁসিকাষ্ঠে আরোহণ করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন নির্বিকার, স্বাভাবিক। তাঁর এ বীরোচিত আচরণ এবং মাতৃভূমির মুক্তির জন্য এ আত্মত্যাগ তৎকালীন ব্রিটিশ কারাকর্মীদের পর্যন্ত অভিভূত করে।
৩০শে আগস্ট, ১৮৮৮ খ্রীস্টাব্দ :
চন্দননগরের সরিষাপাড়ায় মামার বাড়িতে পুণ্য জন্মাষ্টমী তিথিতে জন্মগ্রহণ করেন কানাইলাল দত্ত ।
১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দ :
বোম্বের আর্য্য হাইস্কুলে শিক্ষা শুরু করেন । (কর্মসূত্রে কানাইলালের পিতা সপরিবারে বোম্বেতে থাকতেন) ।
১৯০৪ খ্রীস্টাব্দ :
- শারীরিক অসুস্থতার অবনতি হলে কানাইলালের পিতা চুনিলাল দত্ত বোম্বে থেকে স্বপরিবারে চন্দননগরে চলে আসেন এবং ডুপ্লে কলেজে (অধুনা কানাইলাল বিদ্যামন্দির) ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন কানাইলাল ।
- এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য হুগলি কলেজে (অধুনা হুগলি মহসিন কলেজ) ভর্তি হন ।
- উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি কলকাতার ফেয়ারলী প্লেসে "ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের" এজেন্ট অফিসে চাকুরীতে যোগ দেন অল্পদিনের জন্য ।
১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দ :
- বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের মাধ্যমে যুক্ত হন "যুগান্তর" গোষ্ঠীর সঙ্গে ।
- অনুশীলন সমিতির সদস্য হলেন এবং বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের মাধ্যমে কানাইলাল দত্ত যুক্ত হন "যুগান্তর" গোষ্ঠীর সঙ্গে ।
১৯০৬ খ্রীস্টাব্দ :
অধুনা কানাইলাল বিদ্যামন্দির থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । এরপর হুগলি কলেজে (অধুনা হুগলি মহসিন কলেজ) স্নাতক স্তরের শিক্ষা লাভের জন্য বি.এ. কোর্সে ভর্তি হন ।
১৯০৭ খ্রীস্টাব্দ :
- ত্রিবেণী স্নানঘাটে স্নানার্থীদের সুবিধার জন্য "সেবক সংঘ" গঠন করেন ।
- সন্ন্যাসীবেশে বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার চন্দননগরে আসেন শ্রীশ ঘোষ, কানাইলাল দত্ত, ইন্দুভূষণ রায়, উপেন্দ্রনাথ বান্দোপাধ্যায় প্রমুখের সাথে বৈপ্লবিক সলাপরামর্শ করতে ।
২৩শে মার্চ, ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ :
কানাইলালের বি.এ. "এ" কোর্সের (কলা-সাহিত্য বিভাগ) পরীক্ষা শুরু হয়।
১১ই এপ্রিল, ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ :
স্বগৃহে মঁসিয়ে তার্দ্দিভ্যাল নৈশভোজের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকার সময়ে তার বাড়িতে বোমা নিক্ষিপ্ত হয় । কিন্তু ঘটনাচক্রে মঁসিয়ে তার্দ্দিভ্যাল কোনোভাবে প্রাণে বেঁচে যান । "আমার দেখা বিপ্লব ও বিপ্লবী" বইতে মতিলাল রায় লিখেছেন "কানাইলাল পরদিন প্রাতঃকালে আসিয়া বলিল - 'চেষ্টা সফল হয় নাই বলিয়া আমাদের দু:খ নাই, ক্রমে দেখিও বিপ্লবীর সকল কর্মই কার্য্যকর হইতেছে।' "
১৬ই /১৭ই এপ্রিল, ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ :
কানাইলাল দত্ত চন্দননগর শহর ত্যাগ করেন (যাবার আগে মাকে বলেছিলেন - "চাকরির চেষ্টায় কলকাতায় যাচ্ছি") স্বাধীনতা আন্দোলনের নতুন দিক উন্মোচনের জন্য, সাথে সাথে বোমা প্রস্তুতের শিক্ষালাভ করতে।
২রা মে, ১৯০৮ খ্রীস্টাব্দ :
তিনি উত্তর কলকাতার ১৫ নম্বর গোপীমোহন দত্ত লেন থেকে মানিকতলা বোমা মামলায় অস্ত্র আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন । ঠিক এই সময়েই হুগলি মহসীন কলেজ থেকে বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও বিপ্লব ও রাজদ্রোহিতার অভিযোগে কারারুদ্ধ হওয়ায় ইংরেজ সরকার তাকে ডিগ্রি প্রদানে বাধা দেয়, কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সে বাধা উপেক্ষা করে তাকে ডিগ্রি প্রদান করে।
২১শে জুলাই, ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ :
আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে কানাইলালের কুঠুরির মধ্যেই ব্রিটিশ পুলিশকর্তৃক মেদিনীপুর জেল থেকে নিয়ে আসা বিপ্লবী সত্যেন বোসকে (অরবিন্দ ঘোষ ও বারীন ঘোষ এর মাতামহ রাজনারায়ণ বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র) রাখা হয় ।
৩০শে আগস্ট, ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ :
- মতিলাল রায়ের নির্দেশে চন্দননগর থেকে শ্রীশচন্দ্র ঘোষ এবং বসন্ত কুমার বন্দোপাধ্যায় জেলে ব্রিটিশ পুলিশের নিশ্ছিদ্র প্রহরায় এড়িয়ে কানাইলাল দত্ত ও উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পৌঁছে দিলেন দুটি রিভলবার ।
- এই দিন রাত্রে প্রচন্ড পেটে ব্যথার অজুহাতে কানাইলালকে জেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় (সম্ভবত জেল থেকে বিছানায় করে কানাইলালকে নিয়ে যাবার সময়ে বিছানার মধ্যে লুকিয়েই তিনি রিভলবার ও গুলি সঙ্গে নিয়ে যান) স্বদেশী ডাক্তার বৈদ্যনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শে। তিনদিন আগেই সত্যেন বোস শারীরিক অসুস্থতার কারণে এই হাসপাতলে ভর্তি হয়েছিলেন, তার পাশের বেডেই রাখা হয় কানাইলালকে।
৩১শে আগষ্ট, ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ :
চন্দননগর থেকে শ্রীশচন্দ্রের পৌছে দেওয়া রিভালবার দিয়ে রাজসাক্ষী হতে যাওয়া নরেন গোঁসাইকে জেল হাসপাতালের মূল ফটকের সিড়িতে পিছন থেকে গুলি করে কানাইলাল দত্ত । এই ঘটনায় কানাইলালের সঙ্গী ছিলেন সত্যেন বোস । গুলিটি নরেন গোঁসাইয়ের পিঠ দিয়ে ঢোকে বুক চিরে বেরিয়ে যায়, লুটিয়ে পড়ে নরেন সামনের নর্দমার মধ্যে । এই অতর্কিত আক্রমণে সেই স্থানে উপস্থিত অল্প কয়েকজন ব্রিটিশ পুলিশ হতভম্ব হয়ে যায়, দৌড়ে পালায় কানাইলাল ও সত্যেন এবং পরবর্তী সময়ে আত্মসমর্পণ করে ।
৩রা সেপ্টেম্বর, ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ :
নরেন গোসাইকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা ও হিগিন্স এবং লিন্টন নামক দুই ব্রিটিশ ওয়ার্ডারকে হত্যার প্রচেষ্টার অপরাধে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের ভেতরেই বিশেষ আদালত বসিয়ে কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন বোসের বিচারবিভাগীয় সভা শুরু হয় ।
৭(সোমবার)-৯ই(বুধবার) সেপ্টেম্বর, ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ :
বিচারবিভাগীয় সভার পর টানা তিনদিন ধরে আলিপুর আদালতে কানাইলাল ও সত্যেনের বিচার ব্যবস্থা চালু করা হয় । টানা তিনদিন ধরে এই মামলার শুনানির জন্য ১৯ জন সাক্ষীর বক্তব্য শোনা হয় ।
৯ই নভেম্বর, ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ :
- সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ শোনা ও দেখার পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লিওনার্দো বার্লে কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন বোসের ফাঁসির আদেশ দেন ।
- এই দিনে রাত্রিতে আলিপুর জেলের মধ্যেই স্বামী বিবেকানন্দের "কর্মযোগ" ও "গীতা" পাঠ করেন , তারপরে গভীর রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েন ।
১০ই নভেম্বর, ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ :
চন্দননগরের অগ্নিকিশোর বীর বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত আত্মবলিদান করেন। শোনাযায় ঐদিনটি চন্দননগর ছিল নিষ্প্রদীপ আর ঘরে ঘরে অরন্ধন পালিত হয়।
১৩ই এপ্রিল, ১৯৮৯ খ্রীষ্টাব্দ :
শহীদ কানাইলাল দত্ত জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বি.এ. ডিগ্রির সার্টিফিকেট বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের হাতে তুলে দেন ।
তথ্যসূত্র :
-- মতিলাল রায়ের লেখা "আমার দেখা বিপ্লব ও বিপ্লবী" ।
-- "বিপ্লবতীর্থ চন্দননগর" - বিমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ।
-- শুভ্রাংশু কুমার রায় মহাশয়ের লেখা "শিকড়ের সন্ধানে চন্দননগর"।
-- চন্দননগর (১৪৯৯-২০০০) : মনোরঞ্জন মুখার্জী ।
-- কানাইলাল বিদ্যামন্দির (ইংরেজি ও ফরাসি বিভাগ) সার্ধশতবর্ষ উদযাপন কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত "কানাইলাল বিদ্যামন্দিরের সার্ধশতবর্ষ স্মরণিকা (১৮৬২-২০১২)" ।
-- saabdik.com নামক ওয়েবপেজে প্রকাশিত পার্থ চক্রবর্তী মহাশয় "জন্মাষ্টমীর জাতক" শীর্ষক প্রতিবেদন ।
-- কানাইলাল দত্তের পৌত্রী শ্রীমতি শর্বরী বোসের আলাপচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য ।
-- উইকিপিডিয়া ওয়েবপেজ ।