অনির্বাণ সাহা: সপ্তদশ শতকের ফরাসি চন্দননগর তথা পলাশীর যুদ্ধের আগে বাংলার এক অন্যতম বিশিষ্ট ও প্রভাবশালী বাঙালির নাম হল ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরী। তাঁকে চন্দননগর শহরের প্রাণপুরুষ বলা হয়। বর্তমান বাংলদেশের যশোর জেলার সর্বরাজপুর গ্রামের এক জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়সে তাঁর বাবা মারা যান এবং সম্পত্তির লোভে তাঁর জ্যাঠামশাই ইন্দ্রনারায়নের বিধবা মা ও তার দুই সন্তানকে খুন করতে উদ্যত হলে পরিবারের বিশ্বস্ত নায়েব তাঁদের নিয়ে মুর্শিদাবাদে নবাব মুর্শিদকুলি খানের আশ্রয়ে চলে আসেন। সেখান থেকে নবাবের বদান্যতায় তাঁরা ডাচ-হুগলী ও ফ্রেঞ্চ-চন্দননগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে (যার আগে নাম ছিল ব্রিটিশ-হুগলী, বর্তমান খাদিনামোড় -তালডাঙ্গা মধ্যবর্তী অঞ্চলে) জমি লাভ করে বসবাস শুরু করেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রনারায়ন ও তাঁর দাদা রাজারাম বড় হয়ে ওঠেন এবং ইন্দ্রনারায়নের দাদা রাজারাম মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে অ্যাকাউন্টস বিভাগে চাকরীতে নিযুক্ত হন। অন্যদিকে ইন্দ্রনারায়ন চন্দনগরের চাউলপট্টিতে চালের ব্যবসায় নামেন এবং এই ব্যবসায় দ্রুত উন্নতি করতে শুরু করেন। জানা যায় ১৭২৯ সালে তিনি নিজ উদ্যোগে ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আরেক ট্রেডিং সেন্টার পন্ডিচেরিতে একটি চাল ভর্তি জাহাজ পাঠান এবং তা থেকে প্রভূত লাভের মুখ দেখেন। অবশ্য ফরাসি প্রভুদের সঙ্গে ইন্দ্রনারায়নের গা ঘষাঘষির শুরুটা অনেক আগে তাঁর ছেলেবেলাতেই হয়েছিলো তাঁর দাদার সূত্র ধরে। মুর্শিদাবাদের নবাবের দান করা বিপুল পরিমাণ জমির কিছু অংশ রাজারাম ফরাসী বাবুদের বিক্রি করেন। সে যুগে ধনী ফরাসী বাবুরা ছুটির দিনে শহরের বাইরে পাখি শিকার করতে আসতেন এবং বাগান বাড়িতে পিকনিক করতেন। ইন্দ্রনারায়ন সেই সময় থেকেই লোকাল গাইড হয়ে তাঁদের পিছন পিছন ঘুরতেন, এবং এই ভাবে তিনি অল্প বয়সেই ফরাসী ভাষা ও আদবকায়দাগুলি রপ্ত করে নিয়েছিলেন। এবং সম্ভবত সেই সুবাদেই ১৭৩০ সাল নাগাদ ফরাসি ডিরেক্টর জেনারেল মঁসিয়ে দিরোয়ার প্রস্তাবে চাউলপট্টির মামুলি চাল ব্যবসায়ী ইন্দ্রনারায়ন মাসিক ২০ টাকা মাইনেতে ফরাসী কোম্পানিতে ‘কুর্ত্তিয়ে’ বা দালালের চাকরীতে নিযুক্ত হন। তাঁর কাজ ছিল বাঙলা, বিহার, ওড়িশা ও দক্ষিণ ভারত থেকে চন্দননগরে আসা মালপত্রের কোম্পানির তরফে তদারকি, বণ্টন ও রাজস্ব আদায় করা এবং সেই কাজের উপর তিনি ৩% কমিশন পেতেন। ১৭৩০ সালে চন্দননগর থেকে আনুমানিক ১০লক্ষ টাকার পণ্য রপ্তানি হয়। যা থেকে তিনি প্রায় ৩০,০০০ টাকা আয় করেন। এর সঙ্গে ছিল তাঁর নিজস্ব সুদের কারবার, যাতে তিনি ১২% থেকে ২৪% হারে টাকা ধার দিতেন। কৃষ্ণনগরের মহারাজা রঘুরাম তাঁর টাকার হিসাব করতে ইন্দ্রনারায়নের কাছে আসতেন পরবর্তীতে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন। আর এসবের সঙ্গে সঙ্গেই সমান্তরালভাবে চলতে লাগলো তাঁর নিজের ব্যক্তিগত চালের ব্যবসা। সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে ত্রিবেণীর সরস্বতী নদীর শুকিয়ে যাওয়া ও সপ্তগ্রাম বন্দরের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গের বাণিজ্যলক্ষ্মী ভাগীরথীর মূল ধারা বরাবর কলকাতার দিকে যাত্রা শুরু করে। ফরাসডাঙা ছিল সেই যাত্রায় কোলকাতার আগে দ্বিতীয় স্টপেজ, হুগলীর ওলন্দাজ বন্দরের পর। যদিও ফরাসডাঙার এই বাণিজ্যিক প্রাধান্যের স্থিতিকাল ছিল মাত্র ২৬ টি বছর (অর্থাৎ ১৭৩০ থেকে ১৭৫৬ সালে রবার্ট ক্লাইভ কর্তৃক চন্দননগর দখল করার আগে পর্যন্ত), কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই ফরাসী গভর্নর-জেনারেল জোসেফ ফ্রাসোয়াঁ ডুপ্লের (১৭৩০-১৭৪১) বিচক্ষণ নেতৃত্বে হুগলী নদীতে ব্রিটিশ বাণিজ্যতরীর সংখ্যাকে ছাপিয়ে ফরাসীরা হয়ে ওঠে প্রধান ইউরোপীয় শক্তি। সে সময় চন্দননগর ছিল দক্ষিণবঙ্গের চাল ও অন্যান্য পাইকারি ব্যবসার প্রধান আড়ত এবং অর্থনৈতিক বিচারে কোলকাতার চেয়ে বহু অংশে বড় বাণিজ্যকেন্দ্র। তৎকালীন যুগে চাউলপট্টি অঞ্চলে ১১৪টি চালের গুদাম ছিল, যার প্রতিটিতেই আনুমানিক ৬০০০মণ করে ধাণ মজুত থাকত। যার বেশিকিছু গুদাম ছিল ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরির নিজের। সেই কারণে চন্দননগর বিজয়ের পর ১৭৫৬ সালে রবার্ট ক্লাইভ নাকি চন্দননগরকে ‘বাঙলার শস্যভাণ্ডার’ বলেছিলেন!
বিভিন্ন বাণিজ্যিক নথিপত্র, লেনদেন ও সম্পত্তির খতিয়ান দেখলে অনুমান করা যায় যে, ঠিক সময়ে ঠিক লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করাটা ছিল তাঁর সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি। পন্ডিচেরি, সুরাট, ওড়িশা হয়ে হুগলীর ওলন্দাজ ও আর্মেনিয়ান, গোন্দলপাড়ার ডেনিশ - একমাত্র ইংরেজ বাদে বাকি সকলের সঙ্গেই ইন্দ্রনারায়নের ব্যবসায়িক সুসম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। তৎকালীন এই অর্থ-সামাজিক উন্নতি ও ফরাসি সরকারের বাণিজ্য বৃদ্ধিতে "দালাল ইন্দ্রনারায়নের" প্রমুখ ভূমিকা এবং ফরাসিদের সাথে তাঁর সুসম্পর্কের উপর ভিত্তি করে মাত্র দুবছর পর ১৭৩২ সালে গভর্নর-জেনারেল জোসেফ ফ্রাসোয়াঁ ডুপ্লের অনুমতিতে মাত্র ১২টাকার বাৎসরিক চুক্তিতে চন্দননগরের জমিদারির ইজারা নেন। "দালাল ইন্দ্রনারায়ণ" হয়ে ওঠেন "দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ"। ফরাসী সরকারের বাণিজ্যবৃদ্ধি ও মুঘল শাসকদের সঙ্গে ফরাসী গভর্ণমেন্টের সফল ডিপ্লোমেসি ইন্দ্রনারায়নকে দু’পক্ষের কাছেই বিশেষ সম্মানীয় উচ্চতায় উন্নীত করে এবং এর পুরষ্কার স্বরূপ ১৭৩৫ সালে ফরাসী গভর্নর-জেনারেল ডুপ্লের সুপারিশে ইন্দ্রনারায়ণ ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুই-এর কাছ থেকে নেপোলিয়নের পূর্ববর্তী সময়ে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সন্মান *"লা মেদাই দ্য'র"* (La Medaille d'or) পুরস্কার স্বরূপ একটি স্বর্ণ পদক পান।
কিন্তু বিদেশী রাজার দেওয়া সম্মান ইন্দ্রনারায়নের কাছে যথেষ্ট ছিলনা। তিনি চেয়েছিলেন সামাজিক গোত্রপতির সম্মান, যা কেনা যায় না, যা অর্জন করতে হয় সমাজের বাকি সম্মানীয় ও বিচক্ষণ ব্যক্তিদের সম্মতির মাধ্যমে। আর এই সামাজিক মানরক্ষার লড়াইয়ে ইন্দ্রনারায়নের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল চন্দননগরের তৎকালীন সাবেক গোত্রপতি হালদাররা। ইন্দ্রনারায়নের বিপুল অর্থ ও রাজ-অনুগ্রহ থাকলেও যা তাঁর ছিল না তা হল, তৎকালীন যুগের আক্ষরিক অর্থে ব্রহ্মাস্ত্র, অর্থাৎ বামুন সমাজের অনুগ্রহ! ব্রাহ্মণ সমাজকে নিজের পাশে না পেলে যত টাকা আর যত ক্ষমতাই থাক, গোত্রপতি হওয়ার স্বপ্ন দিবাস্বপ্নই থেকে যাবে।
সংগ্রহ ও সংকলন: অনির্বাণ সাহা