জয়িতা দাস: হুগলী বিদ্যামন্দিরের সাথে কাজী নজরুল ইসলামের সম্পর্ক জানার আগে বিদ্যামন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জানা আবশ্যক। ১৯১৯-এ ১৩-ই এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড যা সারা দেশে প্রভাব ফেলেছিল এবং সেই সময় ঠিক তার এক বছর পর ১৯২১ সালের ১৩-ই এপ্রিল চুঁচুড়া ময়দানে জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস পালন করা হয়েছিল। বক্তা হয়ে এলেন জামাল উদ্দিন হাশেমী, সেই অনুষ্ঠানে যারা শ্রোতা হয়ে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন চুঁচুড়া কোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, গৌরহরি সোম, নরেন্দ্রনাথ চৌধুরী প্রমুখ। ঠিক সময় মঞ্চ থেকে জামালউদ্দিন বলেন ছাত্ররা এবং যারা কোর্টে আছেন তারা ইংরেজদের কার্যকরণ ত্যাগ করে নিজেদের কার্যকরণের মাধ্যমে সম্পূর্ণ পরিচালনা করুন। সেই সময় একদল ছাত্র এই বক্তৃতায় ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ হল। হুগলী জেলায় তখন যারা বিপ্লবীদের নেতৃত্বে ছিলেন তাদের মধ্যে জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোষ গুরুত্বপূর্ণ মুখ, এই জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোষ তার লেখায় বলেছেন সেই সময় বেশকিছু স্বাধীনতা সংগ্রামী তাদের উপর নিজস্ব শিক্ষালয় গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং চুঁচুড়ার অপর এক বিপ্লবী ভূপতি মজুমদার তার নেতৃত্বে মানুষের কাজ থেকে চাঁদা তুলে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। এই কার্যের সাথে যুক্ত ছিলেন দুজন ভাই যারা বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন - সিরাজুল হক আর হামিদুল হক।
বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় ‘হুগলি বিদ্যামন্দির’।
সিরাজুল হক তার একটি লেখায় লিখেছেন: “ আমরা নিজ নিজ স্কুল বয়কট করে বেরিয়ে এসে কাঁধে কাঁধ রেখে প্রচেষ্টা শুরু করলাম। এখানে একটা জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে। আমি, আমার দাদা হামিদুল হক, বিজয় মোদক, মৃত্যুঞ্জয় মান্না, আশু প্রামানিক প্রভৃতি ঠিক করলাম সাধারণ লোকের থেকে চাঁদা তুলে জাতীয় বিদ্যালয় তৈরি করব। রোজ সকালে ও বিকেলে আমরা স্বদেশী গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে পড়তাম চাঁদা তুলতে। সকলে আকুন্ঠ সাহায্য করলেন আমাদের টাকা পয়সা থেকে আরম্ভ করে চাল-ডাল সবই তুললাম আমরা। ইতিমধ্যে কলকাতা থেকে হাজির হয়েছেন ভূপতি মজুমদার। তিনি আমাদের নেতা ছিলেন, তার মতো একজন বিপ্লবী নেতাকে পেয়ে আমাদের উৎসাহ দ্বিগুণ হল। তার পরামর্শ মতো চলতে লাগলাম।
আমরা স্বদেশী গান গেয়ে রাস্তায় রাস্তায় যখন যেতাম তখন রীতিমতো একটা মিছিল গড়ে উঠত আমাদের। এত বেশি লোক সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যেত, শুধু এই শহর নয়, গঙ্গার ওপারে শ্রমিকদের কোয়ার্টারে কোয়ার্টারে আমরা ঘুরেছি এবং সাহায্য পেয়েছি। সকল শ্রমিকদের মধ্যে উৎসাহ দেখতাম। একজন শ্রমিক তো একদিনের রোজগার আমাদের থলিতে ভরে দিল, বলল – ‘লিজিয়ে বাবু হ্যামারা দিনকা ক্যামাই।' মনে পড়ে শ্রমিক এলাকায় আমরা গান গেয়েছিলাম – ‘ভাইয়া দেশকা এ ক্যায়া হাল।' এই গান তখন শ্রমিকদের মনে আলোড়ন ফেলেছিল এবং এই ভাবেই হুগলি বিদ্যামন্দির তৈরি হয়েছিল।" এই বিদ্যামন্দিরে ভূপতি মজুমদারের আহ্বানে নজরুল এসেছিলেন। সেই সময় বিদ্যামন্দিরের সাথে নজরুলের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এই বিদ্যামন্দির ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ঘাঁটি এখান থেকেই যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ চলত আর এইসব কার্যে বিদ্যামন্দিরের প্রিয় কাজীদাও নিবিড় ভাবে জড়িত ছিল তা বলা যায়।
এই বিদ্যামন্দিরের সাথে বিশিষ্ট অনেক মানুষই নিযুক্ত ছিল - দুর্গাদাস চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, অধ্যাপক অনাথ নাথ বসু, পবিত্র দত্ত, মোক্ষদা চরণ সমাধ্যায়ী প্রভৃতি। কাজী নজরুলের হুগলির কারাবাস কালীন এই বিদ্যামন্দিরের যুবক সদস্যরা নানা জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করত রাজনৈতিক কয়েদিদের। হুগলির শ্রীশচন্দ্র মল্লিক হুগলি বিদ্যামন্দিরকে ধরমপুর অঞ্চলে ৫০ বিঘা জমি দান করেছিলেন। এই জমিতে বিদ্যামন্দিরের সিরাজুল হক নিজের হাতে চাষবাস করতেন আর উৎপাদিত তরিতরকারি মল্লিক কাশেম হাটে বিক্রি করে আসতেন, যা দিয়ে বিদ্যামন্দিরের কার্যকর্ম চলতো।
বিদ্যামন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানা যায় না, কিন্তু যা জানা সম্ভব হয়েছে তা আলোচনা করা হল।
কাজী নজরুল ইসলামের যতবার হুগলী বিদ্যামন্দিরে পদধূলি পড়েছে ততবার হুগলী জেলা সহ বিদ্যামন্দির সমৃদ্ধ হয়েছে। রাজনৈতিক দিক যদি লক্ষ্য করি তবে দেখবো নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক জীবন কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রভাবের পিছনে হুগলী বিদ্যামন্দিরের প্রভাব যথেষ্ট লক্ষণীয়।
তথ্যসূত্র
একাধিক নজরুল বিষয়ক গ্রন্থ,
একাধিক নজরুল বিষয়ক প্রবন্ধ,
এবং ইণ্টারনেট
ছবি
ইণ্টারনেট
Project by TFHC