কোয়েল সাহা: যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যেমন কালের পরিবর্তন হয়ে চলেছে। তেমনি মানব মনেও নবজাগরণের উন্মেষ ঘটেছে। সমগ্ৰ ভারতে মানবজাতির হৃদয়ে আংশিক হলেও কুঃসংস্কারময় আদিম চিন্তাধারার অবসান ঘটেছে। তবে একসময়ে ভারতবর্ষে সনাতন ধর্মের মুখোশের আড়ালে চলত ভয়াবহ নারকীয় হত্যা। শুনেই হয়তো গা ছমছম করে উঠছে আর ভাবছেন কীরকম সেই ঘটনাগুলো? এই নির্মম শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির কারনের উৎস কী? তাহলে চলুন ঘুরে আসা যাক আদিম সভ্যতার কুঃসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ নির্মম এই নারকীয় ঘটনার উৎসস্থলে।
নরবলির প্রথা আমাদের কাছে এখন নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত বলে মনে হলেও হিন্দু ধর্মে এক সময় তা মনে হয়নি। প্রাচীন সমাজে প্রথাসিদ্ধ ছিল। নরবলি দেওয়া হলো দেবতাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে বা ঐশ্বরিক অনুগ্রহ প্রাপ্তির আশায় কিংবা ক্রুদ্ধ দেবতাকে শান্ত করার লক্ষ্যে মানুষ হত্যা। এটি একটি প্রাচীন ধর্মীয় সংস্কার যা বিভিন্ন সভ্যতায় অঙ্গীভূত ছিল কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় অবসিত হয়েছে।
দৈবীশক্তির অস্তিত্ব বিশ্বাস যে অনেক সময়ে মানুষের চিত্তবৃত্তি শান্ত করার পরিবর্তে তার স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি এবং মানবিকতাবোধকে অন্ধকারর অতলে আচ্ছন্ন করে রাখে তার সবচেয়ে জলন্ত নিদর্শন হ'ল ভারতবাসীর মত সনাতন ধর্মপ্রাণ জাতির মধ্যে শত শত বৎসর ধরে সতীদাহ প্রথার মত বিভীষিকাময় কুঃসংস্কারের অস্তিত্ব । তবে সতীদাহ প্রথা মত নৃশংস হত্যার কাহিনীতেই সব কিছুর অবসান নয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে প্রচলিত আমাদের সমাজের অনেক কিছু কুসংস্কারই, — যেমন গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, পুরীর জগন্নাথদেবের রথের তলায় আত্মবলিদান, কুষ্ঠরোগীকে জীবন্ত কবর দান, চড়ক পূজায় শরীরের নানা অংশ বাণবিদ্ধ করে অকালমৃত্যু বরণ, নর্মদার কাছে মহাদেও পর্বতের শিখর হতে লাফিয়ে পড়ে নিজ মৃত্যুকে আহ্বান, উড়িষ্যার খোন্দ জাতির মধ্যে শিশুকন্ঠা হত্যার প্রথা ইত্যাদি — উপরোক্ত ঐতিহাসিক মতবাদের সত্যতাই প্রমাণ করে ।
এক সময় পরশুরাম পুণ্ড্র তথা মহাস্থানের শাসন করতেন। তার প্রাসাদ এখনো টিকে আছে। কাজী মেছের আলীর ‘বগুড়ার ইতিকাহিনী’তে পরশুরামের নরবলির কাহিনীটি পাই। তাতে বলা হচ্ছে, “১০৪৩ সালে মহাস্থানগড়ের পাশে মথুরা নামক গ্রামে মীর বোরহান নামের এক মুসলমান বাস করতেন। বোরহানের কোন সন্তান না থাকায় তিনি মানত করেন, আল্লাহ যদি তাকে একটি সন্তান দান করেন তাহলে তিনি একটি গরু কোরবানি করবেন। এরপর তার এক পুত্র সন্তান জন্মলাভ করলে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বোরহান একটি গরু কোরবানি করেন। একটি চিল এক টুকরা গরুর মাংস নিয়ে পরশুরামের প্রাসাদ চত্বরে ফেলে। রাজা পরশুরাম এতে ক্ষিপ্ত হন এবং বোরহানের দু’হাত কেটে নেওয়া হয় এবং তার শিশুপুত্রকে মা কালীর মন্দিরে নরবলি দেওয়া হয়। মনের দুঃখে বোরহান বিবাগী হয়ে যান, ইতিমধ্যে তার সাথে দেখা হয় শাহ সুলতানের; বোরহানের সব কথা শুনে শাহ সুলতান পরশুরামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং পরশুরামকে পরাজিত ও হত্যা করেন।”
আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে আদি পুণ্ড্রের কৃষিভিত্তিক সমাজে নরবলির ব্যাপক প্রচলন ছিল। সে সমাজে নরবলির রক্ত ছড়িয়ে দিত ফসলের ক্ষেতে। ভাবত ফসলের দেবী তুষ্ট হবেন। ক্ষেতে ভরে উঠবে ফসলে। তাছাড়াও সেই রক্ত দিয়ে উপাসনা স্থান পরিষ্কার করার রীতিও প্রচলিত ছিল। কখনো কখনো গণনরবলিও সংঘটিত হতো; যেমন দ্রাবিড়দের কৃষিভিত্তিক নগর সভ্যতার প্রাক্কালে। ড. আর এম দেবনাথ (সিন্ধু থেকে হিন্দু), শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার (লাইফ ইন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া) সহ অনেক ইতিহাসবিদ মনেকরেন দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী প্রাচীন বাংলায় এসেছিল। তাদের ধর্মীয় রীতিতে নরবলির প্রথা ছিল।
নীহাররঞ্জন রায় উল্লেখ করেছেন এক সময় বাংলাদেশে (পুণ্ড্রবর্ধনসহ) অনেক কাপালিক ছিল। ছিল আরও বিভিন্ন প্রকারের তান্ত্রিক সাধক। শারদীয় পূজার নবমী তিথীতে অথবা জয়ন্তিয়া রাজকুমারদের জন্মাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে নরবলি দেওয়া হত। চরগণ অন্যান্য রাজ্য থেকে বলির জন্য মনুষ্য সংগ্রহ করত। নরবলির জন্য মনুষ্য সংগ্রহকারীদের নাম 'খোজকর' বলা হত।
‘খোজার ভিটা’ নামে একটা স্থান আছে মহাস্থানে তথা পুণ্ড্র এলাকায় যা এখন শিবগঞ্জ উপজেলায়। এছাড়াও নরবলির সাথে সম্পৃক্ততার ইতিহাস পাই বিষমর্দন ঢিবি, ডাকিনির ধাপ, কালীতলা হাট, মানকালীর কুন্ডধাপ, কালীদহ সাগর।
বহু প্রাচীন যুগ হতেই আমরা ভারতীয় সমাজে নরবলির উল্লেখ পাই। রামায়ণে শূদ্রকের ও মহীরাবণের উপাখ্যান এবং মহাভারতে জরাসন্ধের কাহিনী প্রমাণ করে যে মহাকাব্যর যুগেও এই ধরণের ঘটনা আমাদের দেশে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল না। মনুসংহিতায় কলিযুগে ব্রাহ্মণদের পক্ষে গোহত্যা, অশ্বমেধ এবং নরবলি নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এথেকেও মনে হয় যে মনুর পূর্বের যুগে (অথবা মনুর যুগেও) নরবলি আমাদের সমাজে বেশী না হলেও কিছু কিছু ঘটত। উজ্জয়িনীরাজ বিক্রমাদিত্যের নামের সহিত জড়িত উপাখ্যান “বেতাল পঞ্চবিংশতি” রচনাও হয়েছে একটি কাপালিকের কাহিনীকে অবলম্বন করে । হিন্দুরাজত্বের শেষভাগে, গুপ্তোত্তর যুগে, ভারতবর্ষে তন্ত্রধর্মের অভ্যুত্থান হয়।
বারোশো বা তেরোশো শতাব্দীতে রচিত কালিকাপুরাণে নরবলি মানের শাস্ত্রীর আচারগুলি বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। পূর্বভারতের কামরূপ অঞ্চল এই তান্ত্রিক সাধনার একটি প্রধান কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠে এবং সমগ্র মধ্যযুগ ধরে তন্ত্রধর্ম বাংলা, আসাম, উড়িয়ায় অপ্রতিহতভাবে রাজত্ব করতে থাকে। তান্ত্রিক কাপালিকদের সাধনার কল্যাণে এই যুগে নরবলি ব্যাপারটাও খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। সুচিত্রা ভট্টাচার্য লিখেছেন 'ভাঙা ডানার পাখি', সেখানেও আছে কাপালিকদের নরহত্যার বর্ণনা। কালীপ্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষন লিখেছেন গোমতী নদীতে নরবলি দেওয়ার কাহিনী।
বাংলার সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত "কপালকুণ্ডলা" উপন্যাসে কাপালিকের নরবলি কাহিনী উল্লেখিত আছে। জনৈক ইংরাজ লেখকের রচনা থেকে জানা যায় যে ১৮৪১ সালের ৮ই জানুয়ারি তারিখে পাঞ্জাব প্রদেশে একমাত্র পূর্ণিমা উৎসবেই নাকি ২৪০ টি নরবলি হয়েছিল। পাদ্রী ওয়ার্ড সাহেব তাঁর বিখ্যাত বই "View of the History, Literature and Religion of the Hindus" - এর দ্বিতীয় খণ্ডে বাংলাদেশের কোন কোন স্থানে নরবলি দেওয়া হত তার একটি সুদীর্ঘ তালিকা দিয়েছেন। তাঁর এই তালিকা হতে জানা যায় যে বর্ধমানের নিকট ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা দেবীর মন্দিরে, মুর্শিদাবাদের নিকট কিরীটকণায় কালী মন্দিরে, কাটোয়ার নিকট শ্রীরামপুরে তারামন্দিরে, গুপ্তিপাড়ার নিকট স্বম্রা গ্রামে স্থানীয় দেবীমন্দিরে, নদীয়ার নিকট ব্রাহ্মণীতলায় দুর্গামন্দিরে এবং তমলুকে বর্গভীমার মন্দিরে গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকেও নরবলি হত এবং এই সব নরবলির পিছনে কে বা কারা থাকত তা বহু অনুসন্ধান করেও জানা যেত না। ওয়ার্ড বলেছেন যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমল পর্যন্ত নদীয়ায় বহু নরবলি হ'ত।
সেযুগে ইংরেজী সংবাদপত্রগুলিতেও মাঝে মাঝে এ ধরনের সংবাদ পাওয়া যেত। ১৭৮৮ সালের ২০শে এপ্রিল তারিখে Calcutta Gazette - এর সম্পাদকীয় পত্রে চিৎপুরে চিরেশ্বরীর মন্দিরে একটি নরবলির সংবাদ প্রকাশিত হয়। এক্ষেত্রে নরবলি দেওয়ার সময়ে দেবীর অঙ্গ বহুমুল্য বস্ত্র ও সোনারূপার গহনায় সাজানো হয়েছিল এবং শাস্ত্রের আদেশমত একজন চণ্ডালকেই বলি দেওয়া হয়। শাস্ত্রীয় নির্দেশমত পূজার উপযোগী পাত্রাদিও বলির স্থানে পাওয়া যায়। এথেকে মনে হয় যে বলির পিছনে কোনো ধনী এবং শাস্ত্রজ্ঞ লোকের হাত ছিল। চিৎপুরের সর্বমঙ্গলা দেবীর মন্দির সতেরোশো শতাব্দীর সূচনাতেও মন্দিরে যথেষ্ট নরবলি হ'ত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ১৬৩৭ সালে চিত্রেখরী দেবীর সেবায়েত মনোহর ঘোষের মৃত্যু হয়। এই সময়ে মন্দিরে এত নরবলি হ'ত যে মনোহরের পুত্র রামসন্তোষ ঘোষ রোজ সকালে মন্দিরে গিয়ে বহু নরমুণ্ড দেখতে পেতেন এবং তাই তিনি চিৎপুর ত্যাগ করে বর্ধমানে চলে যান। চিৎপুরে চিত্রেশ্বরীর মন্দির ছাড়াও কলকাতায় আরও একটি স্থানে নরবলি হত, —সেটি হচ্ছে কালীঘাটের কালী মন্দিরে। ওয়ার্ড এবং লঙ্, উভয়েই কালীঘাটে নরবলির কথা উল্লেখ করেছেন। ওয়ার্ড বলেছেন যে ১৮০০ সালে দু’জন হিন্দু কালীমন্দিরে দেবীর কাছে নিজেদের জিহ্বা বলি দেন। ১৮২৭ সালের ২১শে এপ্রিল ‘সমাচার চন্দ্রিকা'তেও জনৈক পশ্চিমদেশীয় ব্যক্তির কালী প্রতিমার চরনে জিহ্বাদানের সংবাদ পাওয়া যায়।
লঙসাহেব ১৮৩২ সালে সংঘটিত একটি বীভৎস কাহিনীর উল্লেখ করে বলেন। কালীঘাটের জনৈক হিন্দু, এক মুসলমান নাপিতকে মন্দিরে ডেকে এনে তাকে বলির ছাগলটি চেপে ধরতে বলেন। নাপিত ঐ রকম করলে হিন্দু ভদ্রলোকটি ছাগলের উপরে খাড়া না চালিয়ে নাপিতের উপরেই চালান। ফলে নাপিতের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয় এবং বিচারে সদর নিজামত আদালত হিন্দু ভদ্রলোকটির ফাঁসির আদেশ দেন। নয়াদিল্লীর ভারত সরকারের মহাফেজখানায় কালীমন্দিরে নরবলির বিষয়ে দুটি চিঠি পাওয়া যায়। প্রথম চিঠিখানা ১৮৫৪ সালের ১৭ই জানুয়ারী তারিখে ২৪ পরগণার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিয়েছেন আর দ্বিতীয় চিঠিখানা ডেম্পিয়ার সাহেব ঐ মাসেরই ২১ তারিখে বাংলা সরকারের সেক্রেটারি সিসিল বিডনকে লিখেছেন। প্রথম চিঠিতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব লিখছেন ১৮৫৩ সালের ২১শে ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, কৃষ্ণপক্ষ রাত্রি সাড়ে সাতটার সময় কালীঘাটের মন্দিরে একটি হিন্দুস্থানী আত্মবলিদান করেছে। ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের চিঠিতে জানা যায় যে ১৮৩৬ সালে মন্দিরে এইরূপ আত্মবলিদানের সংখ্যা এত বেড়েছিল যে মন্দিরে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করতে হয়। মন্দিরের সেবায়েত হালদারদের এই ব্যাপারে গোপন সহানুভূতি ছিল বলে সন্দেহ করা হয়। কড়া পাহারা থাকার পরও অন্ততঃ দুবার দুজন লোক প্রহরীকে ফাঁকি দিয়ে নিজেদের জিহ্বাদান করেছিল। যখন দেখা গেল গ্রহরী রেখেও কোনো সুবিধা হচ্ছে না তখন ১৮৫০ সালের এপ্রিল মাসে পাহারা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৮৫৩ সালের ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেটের মনে বিভীষিকার সৃষ্টি হয়।
১৮৬৫-৬৬ সালেও যশোর, হুগলী ও বীরভূম জেলায় ভূতপ্রেত পূজা ও ভাল শষ্য লাভের জন্য নরবলির কাহিনী শুনতে পাওয়া যায়। ছোট ছোট ছেলেদেরই প্রায় এই সব স্থানে বলি দেওয়া হ’ত। অবশ্য এ ধরণের বলি যে খুব বেশী ঘটত তা নয়। হান্টার সাহেব তাঁর Annals of Rural Bengal বইখানিতে ১৮৬৬ সালে যশোরের লক্ষ্মীপাশা গ্রামে কালীমূর্তির সম্মুখে একটি মুসলমান বালকের বলির কথা লিখেছেন। ১৮৬৬ সালের ১৯শে মে সংখ্যার Englishman কাগজে হুগলী জেলাতেও এইরূপ একটি নরবলির কথা পাওয়া যায়। হান্টার বলেছেন যে তিনি বীরভূমের দক্ষিণ - পশ্চিম অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যেও শীঘ্র বৃষ্টিপাত কামনা করে এই ধরণের নরবলি দেওয়া হত বলে শুনেছিলেন। ছোটনাগপুরের কমিশনার ড্যান্টন সাহেব ১৮৬৪ সালের ২০শে অক্টোবর সরকারের কাছে জানান যে ধলভূমের রাজার গৃহদেবী রঙ্কিণীর মন্দিরে মাঝে মাঝে নরবলি হয় বলে তিনি সন্দেহ করেন, এবং বলির জন্য নিকটের গ্রাম হতেই বালক সংগ্রহ করা হয়। ধলভূমের রাজাকে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করা হয় কিন্তু পরে প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার প্রসারের ফলে নরবলি প্রথা বিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশ থেকে একরকম উঠে গেছে বললেই চলে, নরবলি শব্দটি পরিচিত ছিল ‘অতিবলি’ হিসেবেও। কথাসরিৎসাগরে এ-রকম একটি কাহিনি আছে। এক রাজার একটিমাত্র সন্তান ছিল কিন্তু তিনি অধিক সন্তানলাভের জন্য কুলপুরোহিতের পরামর্শ চাইলে পুরোহিতমশাই রাজার একমাত্র সন্তানকে বলি দিয়ে তার মাংসে যজ্ঞ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এক সময় কালীঘাটের মন্দিরে যে বলি হত তা ঐতিহাসিক নিশীথরঞ্জন রায় তাঁর ‘প্রাচীন কলকাতা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। কলকাতার হাটখোলায় ১৬৯৮ সালে আকবরের সভাসদ টোডরমলের আমিন রাজা গোবিন্দসরল দত্তর পৌত্র রাম দত্ত দুর্গাপুজো শুরু করেন। ওই পূজায় প্রত্যেক বছরই নবমীর দিন গ্রাম থেকে একটি তরুণীকে চুরি করে এনে বলি দেওয়া হত। নবমীর রাতে ব্রাহ্মণভূম রাজবংশের দুর্গাপুজোয় নরবলি হত এবং সেই রক্তে বেলপাতা রাঙিয়ে দেবীর অর্চনা করা হত। বীরভূমের বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের বাড়িতে দুর্গাপুজোয় নরবলি দানের প্রথা ছিল। শোনা যায় বীর হাম্বির-এর সময় পর্যন্ত তাদের পোষ্য একটি ডাকাতের দল শক্তি আরাধনার অঙ্গ হিসেবে নরবলি দিত। একটা সময়ে ঝাড়গ্রাম থেকে কিছু দূরে চিল্কিগড়ের কনকদুর্গার মন্দিরে মানুষ বলি দেওয়া হত। প্রধানত সেখানে মায়ের সামনে বন্দি শত্রুকেই বলি দেওয়া হত বলে কথিত আছে। বর্ধমানের ক্ষীরগ্রামে যোগাদ্যা (দুর্গা)-র পুজোয় কয়েকশো বছর ধরে নরবলি হয়েছে, এমন ইতিহাস আছে। এই নরবলি প্রসঙ্গে কোচবিহারের রাজবাড়ির দুর্গাপুজো বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। কেননা, আজও সেখানে মানুষের রক্ত না-হলে পুজো হয় না। ‘মানুষবলির পুজো’ নামে এখনও ওই পুজো পরিচিত। ওই পুজোয় এককালে নরবলি হত। শেষ নরবলি হয়েছিল রাজা রতিকান্ত দেববক্সীর আমলে। যদিও পরবর্তীকালে রাজারাই তা বন্ধ করেন। নরবলি বন্ধ হলেও দেবীকে নররক্ত উৎসর্গের প্রথা কিন্তু আজও রয়ে গেছে। সেই প্রথার রেশ ধরে এখনও অষ্টমীর রাতে রাজবংশী পরিবারের কোনও পুরুষের অঙ্গ থেকে রক্ত নিয়ে গুপ্তপুজো সম্পন্ন করা হয়। গত দু-আড়াই দশক ধরে শিবেন লায়েক নামে এক ব্যক্তির রক্তেই সম্পন্ন হচ্ছে ওই পূজা। আগে ওই রক্ত দিতেন শিবেনবাবুর বাবা। একটি তথ্য এ রকম, গত চারশো বছর ধরে লায়েক পরিবারেরই কোনও না কোনও সদস্যের রক্তে আজ পর্যন্ত রাজবাড়ির পুজো হয়ে আসছে।এ ছাড়া নরবলি দেওয়া হত জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুরের রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয়। সেখানে রাজপুরোহিতের সামনে রাজা একটি কিশোরের শিরচ্ছেদ করতেন তরোয়াল দিয়ে।
হুগলি জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম পাটুলি। পাটুলি গ্রাম অন্য একটি কারণে হয়ে উঠেছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। মদনমোহন তর্কালঙ্কার এক সময় এই গ্রামে কিছু সময়ের জন্য বসবাস করেছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম ডাকসাইটে সমাজ সংস্কারক আবার অন্যদিকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপকও।
এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা চলে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিধবা বিবাহ। যেখানে পাত্র ছিলেন শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং কালিমতী। এই পাত্র-পাত্রীর পরিচয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। কথিত আছে, পাটুলী গ্রামে থাকাকালীন এক রাতে মা দুর্গার স্বপ্নাদেশ পান মদনমোহন। তাঁর সেই স্বপ্নাদেশের ভিত্তিতেই শুভারম্ভ ঘটে দুর্গাপুজোর। এই গ্রামের দুর্গামূর্তিও অদ্ভুত। গাত্রবর্ণ শিউলি ফুলের মতো, তার দশটি হাতের পরিবর্তে রয়েছে দুটি হাত। শোনা যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে দেবী দুর্গা স্বপ্নে এসে আদেশ দেন তিনি দশ হাতের পরিবর্তে দুহাতে খাবেন। সেই থেকেই হুগলির এই প্রত্যন্ত গ্রামের মূর্তি দুহাতের। এমনকি এই গ্রামেই দেবীর ডানদিকে কার্তিক এবং বামদিকে গণেশ বিরাজমান। সব থেকে আশ্চর্যের কথা হল, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মতো সমাজ সংস্কারক যে দুর্গাপুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, সেই দুর্গাপুজোতেও একসময় নরবলি হত প্রতিবছর মহাষ্টমীর অর্ধনরাতে। যদিও বর্তমান সময়ে বন্ধ হয়েছে এই অমানবিক প্রথা, কিন্তু প্রতীকী নরবলির প্রচলন আছে আজও। বর্তমানে চালের পিটুলি দিয়ে তৈরি করা হয় একটি পূর্ণাকৃতি মানুষ। বলি দেওয়া হয় সেই মানবাকৃতির চালের পিটুলিকেই।
একটি পর্তুগীজ জার্নালে ক্যাপটেন নরোনহা নামে এক ধর্মভীরু পর্তুগীজের বিবরণ পাওয়া যায়। মেদিনীপুরের কাছাকাছি কোনো স্থানে ডাকাতদের সঙ্গে গিয়ে তিনি এক বটগাছের নীচে তিনি তাদের আরাধ্যা কালীমূর্তি দেখতে পান। বলি হিসেবে সেখানে দু’টি অর্ধমূর্ছিত বালক ও অদুরে সিঁদুর মাখানো খড়গ দেখে তিনি ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান। আর একটি বিবরণ যার লেখা, তিনি ধর্মে ক্যাথলিক হলেও পেশায় ছিলেন ডাকাত। এক স্থানীয় জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি খুলনা ও নোয়াখালি অঞ্চলে ডাকাতি করতেন, পরে পালিয়ে যান সুন্দরবনের গভীরে। সেখানে তিনি ‘ভবানীপূজা’র আয়োজন করেন বলে জানিয়েছেন, যাতে নরবলির জন্য মানুষ কেনাবেচার কথা পাওয়া যাচ্ছে ও বলির যোগ্য মানুষের লক্ষণ মিলিয়ে সওদা করছেন স্বয়ং পুরোহিত!
মহাকালগড় হল পদ্মার তীরে হারিয়ে যাওয়া এক অঞ্চল যা বর্তমান রাজশাহী জেলার অন্তর্গত। আজকের দরগাপাড়াও এককালে মহাকালগড়ের অংশ ছিল। ১৩ শতকের দিকে সেখানে বিক্রম কেশরী নামে এক হিন্দু জমিদারের রাজত্ব ছিল। বাংলার সুলতানরা তাকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন। পদ্মার তীরে মহাকালগড়ে ধীবর সম্প্রদায় বা জেলেদের বড় অঞ্চল ছিল। মহাকালগড় ছিল এক সমৃদ্ধ জনবসতি যেখানে সব ধরনের লোক বাস করত। নদীর ধারে ছিল এক বিশাল কালী মন্দির যেখানে পূজা দিতে ভক্তদের সমাগম লেগেই থাকত। ভক্তদের বিশ্বাস মৃত্যু, কাল ও রূপান্তর নিয়ন্ত্রণ করেন সনাতন এই দেবী।
এদিকে রাজার ঘরে দুই রাজপুত্র। তাদের একজন হলেন চাঁদ। রাজার এই পুত্ররা নিষ্ঠুর সব আচার পালন করতেন, রাজবংশে যেমনটা প্রায়ই ঘটে। কালী মন্দিরে তারা নরবলির প্রচলন করেন। আধ্যাত্মিক পুণ্যলাভের উদ্দেশ্যে নরবলি দেওয়ার জন্য স্থাপন করা হয় বিশাল এক মঞ্চ। অমাবস্যার রাতে সেখানে ধুমধাম করে আয়োজন করা হয় নরবলির। কালী পূজা দিতে সমবেত হয় হাজার হাজার মানুষ। গান, ছন্দ আর ধূপ-ধুনোর ধোঁয়ায় চারদিক ভারি হয়ে উঠে। রাত বাড়লে দেখা যায় পেছনে হাত বাঁধা হতভাগা একজনকে কালো রুমালের টুকরায় চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মঞ্চের দিকে। ঢাকঢোলের আওয়াজ তীব্র হতে শোনা যায়। জ্বলন্ত ধূপ আর লাল গাঁদা ফুল দিয়ে সাজানো বেদীর দিকে জোর করে টেনে নিয়ে তাকে যূপকাষ্ঠের ওপর ফেলা হয়। তার মাথা তখন দুই স্তম্ভের মাঝে। দুজন লোক পেছনে হাত চেপে ধরে আছে। দ্রুততালে বাজছে ঢাক। হাজার হাজার কাঁচ ভাঙার শব্দে বেজে উঠছে করতাল। জ্বলন্ত মশালের হলদে শিখায় ভক্তদের শরীরের বিন্দু বিন্দু ঘাম চকচক করছে। ঢাকের তালে উন্মাদের মতো তারাও দুলছে।
সেই সময় চকচকে ধারালো খড়গ হাতে উপস্থিত জল্লাদ। তন্ত্রসাধকরা সবাই উচ্চস্বরে মন্ত্র পাঠ করতে শুরু করেছে। জল্লাদ দুই হাতে খড়গটি খুব উঁচুতে তুলে নিয়েছে। ঠিক এরপরই চোখের পলকে দ্রুতবেগে তা নামিয়ে আনা হলো। খুব পরিষ্কারভাবে ধর থেকে মাথা আলাদা হয়ে গেছে। মাংস কিংবা হাড় কাটতে যে ধরনের শব্দ শোনার কথা তা পাওয়া গেল না। কিন্তু মাথাটি ভূপতিত হওয়ার সঙ্গে একটা ভোঁতা শব্দের সঙ্গে রক্তের উজ্জ্বল ধারা দেখতে পেল ভক্তরা। উল্লাসে ফেটে পড়ল উন্মত্ত মানুষের দল।
একদিন শাহ মখদুমের অনুসারী ইরাকি ইসলাম প্রচারক শাহ তুরকান শহীদ বাগদাদ থেকে বোয়ালিয়ায় আসেন। তখন ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ। তিনি এখানে ইসলামের বাণী প্রচার করতে শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই তান্ত্রিক রাজপুত্র অংশু দেও চাঁদবন্দী বর্মাভোজ ও অংশু দেও খেরজুরচাঁদ খড়গ বর্মাগুজ্জভোজের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন শাহ তুরকান। রাজকুমারদের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধলে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। শাহ মখদুম তখন নোয়াখালীতে ইসলাম প্রচারে ব্যস্ত। শাহ তুরকামকে হত্যার খবর পেয়ে তিনি তান্ত্রিক রাজাদের শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নিজ বাহিনী নিয়ে শাহ মখদুম রাজশাহীতে এসে এখানকার রাজাদের সঙ্গে চারটি যুদ্ধ করেন। প্রতিবারই তিনি তাদের পরাজিত করেন। সর্বশেষ যুদ্ধটি হয় রাজশাহীর ঘোড়ামারায়। ঘোড়ামারা নামটি এসেছে এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যেখানে শত শত ঘোড়া নিহত হয়েছিল। পরাজিত রাজারা ইসলাম গ্রহণের পর শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। নরবলির প্রথাও শেষ হয়ে যায়। তবে শাহ মখদুমের অনুসারীরা বলির বেদীটি সংরক্ষণ করে।
উড়িষ্যার খােন্দ উপজাতি তাদের চাষের জমির উর্বরতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নরবলি দিত। বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ এই নরবলি প্রথার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা বিশেষ সফল হয়নি।
সতীদাহ প্রথা :
হিন্দুনারীর জীবনে এক নিষ্ঠুর অভিশাপ ছিল সতীদাহ প্রথা। সে সময়কার সমাজে রক্ষণশীল হিন্দুরা স্বামীর বিধবা স্ত্রীকে বোঝাতেন যে, মৃত স্বামীর সঙ্গে সহমরণে গেলে পুণ্য অর্জন হবে এবং পরলোকে সে তার মৃত স্বামীর সাহচর্য পাবে। রামমোহন রায়ের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি এই নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথা রদ। তিনি বিভিন্ন গুণীজনের স্বাক্ষরিত এক আবেদনপত্রের মাধ্যমে সরকারকে জানান, মানবতাবোধ ও শাস্ত্র সকল দিক থেকে সতীদাহ নিন্দনীয়। এই কাজ নরহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সতীদাহ প্রথার উদ্দেশ্য :
সেসময়কার গোঁড়া ব্রাহ্মণদের সতীদাহ প্রথা চালু রাখার পিছনে কিছু অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। এছাড়া তৎকালীন হিন্দুসমাজের কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস এই প্রথা প্রচলিত থাকার পেছনে দায়ী ছিল মৃত কুলীন পতির বহু বিধবার দায় এড়ানোর জন্য অর্থাৎ বিধবা নারীকে ভরণপোষণ করার যে ঝঞ্ঝাট বা দায়িত্ব থাকে তা থেকে উচ্চবর্ণের পরিবারগুলিকে রেহাই দিতে চাওয়া হয়েছিল। সে সময়কার সমাজের নিয়ন্ত্রকগণ বিধবার সম্পত্তি গ্রাস করতে চেয়েছিল। হিন্দুধর্মের সেসময়ে ভ্রান্ত বিশ্বাস ছিল যে মৃত স্বামীর সঙ্গে বিধবাপত্নীকে একই চিতায় দাহ করতে পারলে পরলোকে গিয়ে পত্নীটি তার স্বামীর সাহচর্য পাবে। সতীদাহ প্রথায় নিজের প্রাণ উৎসর্গ করলে বিধবা নারীটি সতীরূপে সারা গ্রামে পূজিতা হবেন এবং তার নামে কোনো মনস্কামনা করলে তা পূরণ হবে এই ভ্রান্ত বিশ্বাস মানুষের মধ্যে প্রচলিত ছিল।
সতীদাহ প্রথার বিবরণ :
বাংলার সমাজে সতীদাহ নামে যে - নিষ্ঠুর ও অমানবিক প্রথাটি প্রচলিত ছিল, সেটি ছিল এরকম – উচ্চবর্ণের পরিবারে কোনো বধূ স্বামীহারা হলে মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় সেই বিধবা নারীটিকে নববধূর সাজে সাজিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে পুড়িয়ে মারা হত। জ্বলন্ত চিতায় অগ্নিদগ্ধ হওয়ার সময় বিধবাটির চিৎকার যাতে অন্য কারোর কানে না পৌঁছোয় তার জন্য শ্মশানে ঢাক, ঢোল, কাঁসর – ঘণ্টা বাজিয়ে একদল মানুষ পৈশাচিক নাচ নাচেন।
রামমোহন সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন হিন্দু শাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থ থেকে উক্তি তুলে ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, সতীদাহ একটি ধর্মবিরুদ্ধ ও অশাস্ত্রীয় কুপ্ৰথা। এই প্রথা বন্ধের লক্ষ্যে তিনি ৩০০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর নিয়ে বড়োলাট বেন্টিঙ্কের কাছে জমা দেন। - রামমোহনের চেষ্টায় সতীদাহ প্রথা - বিরোধী যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার রেশ বেন্টিঙ্ককেও স্পর্শ করে। বেন্টিঙ্ক ১৭ নং রেগুলেশান জারি করে সতীদাহ প্রথা রদ করেন (১৮২৯ খ্রি . ৪ ডিসেম্বর)। ঘোষণা করা হয় সতীদাহ প্রথা হল বেআইনি এবং তা ফৌজদারি আদালতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মাদ্রাজসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে এই আইন কার্যকরী হয়।
ঠগী :
ঠগীদের নৃশংস ইতিহাস ভারতের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। বাহরাম একজন ঠগি ছিলেন। বাহরাম জমাদার অল্পের জন্যে এক হাজার খুন তিনি করতে পারেননি, ৯৩১ এ থেমে গেছেন। ওনাকে নিয়ে বলিউডে সিনেমা বানানো হয়েছে। ঠগিরা মানুষহত্যায় খুবই দক্ষ ছিল। হলুদ রুমাল ভাঁজ করে গলায় পেঁচিয়ে মানুষ মেরে ফেলত, একজন পিছন থেকে মাথা ধরে রাখত, একজন চেপে ধরে রাখত পা। পায়ের হাড় আর শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়ে লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলতো।
ঠগীরা যত মানুষ হত্যা করেছিল পৃথিবীর কোন সংঘটিত খুনি সম্প্রদায় এত নিরীহ মানুষ হত্যা করেনি। কেবল ১৮৩০ সালে ঠগীরা প্রায় ৩০,০০০ মানুষকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে। ঠগিরা ছিল আদিম দেবী কালীর উপাসক, নির্দোষদের হত্যাকে তাদের ধর্মীয় কর্তব্য হিসাবে দেখত। তারা বিশ্বাস করেছিল যে হত্যার বিষয়টি কালীকে সন্তুষ্ট করবে। ঠগীরা সনাতন ধর্ম অনুসরন করত, ঠগীরা বংশপরম্পরায় দস্যুবৃত্তি ও খুন করত। ১২৯০ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত এই ঠগীরা প্রায় ২০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল, যারা সবাই ছিল নিরীহ পথচারী।
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক (ভারতের ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল) জোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার চিফ এজেন্ট ক্যাপ্টেন উইলিয়াম স্লিম্যান বেশ কয়েকটি রাজপরিবারের কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ঠগিদের নির্মূল করেছিলেন। ১৮৩১ থেকে ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত ৩,২৬৬ ঠগি ধরা পড়ে, যাদের মধ্যে ৪১১ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে ১৮৪৭ ও ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ উদ্যোগে এই অমানবিক প্রথার অবসান ঘটে।
পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার প্রসারের ফলে নরবলি প্রথা বিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে বিলুপ্ত প্রায়। তবে আজও এই উন্নত যুগে অনেক প্রত্যন্ত গ্ৰামাঞলে এই অন্ধকার কুঃসংস্কারে আবদ্ধ সনাতন রীতি মেনে নির্মম নারকীয় হত্যা করা হয়।