East India Company: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রমানুসারে পরিবর্তনের ইতিকথা - Pralipta


কোয়েল সাহা : ঐতিহাসিক কালের গতি অবিরাম এবং নদীস্রোতের মতোই সে তার আপন গতিতে এগিয়ে চলে। অজানা উল্লেখযোগ্য ঘটনায় ইতিহাসের পাতা আজ রামধনুর মতো রঙিন ও উজ্জ্বল। এই রঙিন পাতায় স্বর্ণ অক্ষরে খোদিত ভারতবর্ষের অনেক কাহিনী আজও আমাদের কাছে বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের সদৃশ্য। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্বায়ত্তশাসন।
বাণিজ্যের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রবেশ করে কয়েক শতাব্দী শাসন ও শোষণের দ্বারা পুরো উপমহাদেশ কবজা করে রাখবার ইতিহাসই এই নামটিকে এনে দিয়েছে চিরস্থায়ী পরিচিতি।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বলা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং প্রথম কর্পোরেশন কোম্পানি। শুরুতে এর নাম ছিল ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৬০০-১৭০৮)। পরবর্তীতে এর নাম বদলে করা হয় অনারেবল কোম্পানি অব মার্চেন্টস অব লন্ডন ট্রেডিং ইনটু দ্য ইস্ট ইন্ডিজ অথবা ইউনাইটেড কোম্পানি অব মার্চেন্টস অব ইংল্যান্ড ট্রেডিং টু দ্য ইস্ট ইন্ডিজ (১৭০৮-১৮৭৩)। তবে উপমহাদেশে সেটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামেই অধিক পরিচিত ।

গোঁড়ার কথা :

বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি ও ভারতের অমিত ঐশ্বর্যের আকর্ষণে খ্রিস্টীয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ইউরোপীয় বণিকরা দলে দলে ভারতে আসতে থাকে। ভারতের নানা স্থানে তাদের বাণিজ্য কুঠি নির্মিত হয় — এমনকি অনেকে দুর্গ নির্মাণ করে নিজ নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পোর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি, দিনেমার প্রভৃতি। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর পতনোন্মুখ মোগল রাজতন্ত্র এবং অকর্মণ্য প্রাদেশিক রাজন্যবর্গের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা ভারতীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে এবং কালক্রমে ভারতে ইংরেজ বণিকদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাণিজ্যিক পুঁজির বিকাশে উদ্যোগী ভূমিকা ছিল স্পেন ও পোর্তুগালের। কিন্তু সপ্তদশ শতকে ওলন্দাজরা সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। সপ্তদশ শতকে ওলন্দাজদের অভ্যুত্থান ও বাণিজ্যিক পুঁজির বিকাশ অবশ্যই একটি চমকপ্রদ কাহিনি। উত্তর সাগরের তীরবর্তী হল্যান্ড ও জিল্যান্ডের (Zeeland) মানুষ সব সময়েই ছিল দুঃসাহসিক সমুদ্রযাত্রায় উৎসাহী এবং তাদের বিভিন্ন ধরনের অনেক জাহাজ ছিল। ব্যবসা বাণিজ্যেও তারা ছিল অগ্রণী। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ডাচ প্রজাতন্ত্র ছিল ক্ষুদ্র একটি দেশ এবং জনসংখ্যা ছিল মাত্র দুই মিলিয়ন। এখানে যুগার বা মেদিচির মতো কোনো ধনকুবেরের আবির্ভাব ঘটেনি। কিন্তু যৌথ কারবারি সংস্থার আদলে ১৬০২ সালে গঠিত ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল সমস্ত কাজ কারবারের কেন্দ্রে। ছোটো - বড়ো বহু বিনিয়োগকারী এর ছত্রছায়ায় সমবেত হয়েছিল। ১৬২১ সালে গঠিত হয়েছিল ওয়েস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে তারা এক বিশাল বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিল। 

সপ্তদশ শতকের গোড়াতেই তারা পোর্তুগিজদের মশলার বানিজ্য থেকে উৎখাত করেছিল। পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও সিংহলে তাদের প্রাধান্য স্থাপিত হয়েছিল। প্রাচ্য দেশ থেকে তারা চিনামাটি, চা, তুলা, রেশম, কফি প্রকৃতি আমদানি করত। পশ্চিম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অবশ্য খুব একটা সাফল্য পায়নি। পশ্চিমে পোর্তুগালের আধিপত্যে তারা ভাগ বসাতে পারেনি। যাই হোক, আমস্টারডাম ছিল সদা কর্মব্যস্ত। একটি শহর ও বাণিজ্যিক পুঁজির প্রধান কেন্দ্র । কিন্তু ওলন্দাজ অর্থনীতিতে বর্হিবাণিজ্যর চেয়েও উত্তর সাগরের বাণিজ্য ছিল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ । তাদের মাছের ব্যবসায় প্রচুর লাভ হত । তারা ফ্রান্স থেকে আনত নুন আর নরওয়ে থেকে কাঠ । প্রথমটি কাজে লাগাত মাছ সংরক্ষণে দ্বিতীয় জাহাজ তৈরির কাজে । সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে ওলন্দাজদের ষোলো হাজার বাণিজ্যপোত ছিল, যা মোট ইউরোপের বাণিজ্যপোতের প্রায় অর্ধেক । তাদের কাজকর্মের ধারাই ছিল আলাদা । তারা একসঙ্গে অনেক পরিমাণ জিনিস , বিশেষত কাঁচামাল কিনে শিল্পকাজে ব্যবহার করত,এরপর তারা তৈরী জিনিস বিক্রি করত।

ভারতে ইংরেজ বনিকদের আগমন ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে প্রভাব বিস্তার

পূর্বে ইউরোপের মানুষের কাছে ভারতীয় উপমহাদেশ 'ইস্ট ইন্ডিয়া' নামে পরিচিত ছিল। সেই সময় ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল মশলা, কাপড় এবং দামি রত্নের জন্য বিখ্যাত এক স্থান। এসব উপকরণ ইউরোপে বেশ চড়া দামে বিক্রি হতো। কিন্তু সমুদ্রে শক্তিশালী নৌবাহিনী না থাকার দরুণ ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসতে ব্যর্থ হয়।

সেই সময়ে স্পেন এবং পর্তুগাল ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে মশলা ও কাপড় নিয়ে পূর্বের দূরবর্তী দেশ সমূহে বিক্রি করত। কিন্তু ব্রিটিশ বণিকরা উপমহাদেশে আসার জন্য মরিয়া হয়ে ছিলেন। অবশেষে ১৫৮৮ সালে ব্রিটিশরা পথের দিশা পায়৷ স্প্যানিশদের হারিয়ে তাদের নৌবহরের দখলে নেয় তারা। এই নৌবহর ব্রিটিশদের ভারতের আসার পথ তৈরি করে দেয়। এবং সেই সাথে তাদের নৌশক্তিকে বহুগুণ বেড়ে যায়। তখন প্রাচ্য দেশে বানিজ্যের জন্য ইংল্যান্ডের কিছু বণিক উৎসাহ দেখায়। মার্চেন্ট অ্যাডভেঞ্চারস (Merchant Adventurers) নামে একটি বনিক সঙ্ঘ এই উদ্দেশ্যে ১৫৯৯ খ্রিঃ স্থাপিত হয়।
১৬০০ সালের ৩১ জুলাই, স্যার থমাস স্মাইথের নেতৃত্বে লন্ডনের একদল বণিক রাণী প্রথম এলিজাবেথের কাছে এক আর্জি নিয়ে হাজির হন৷ তারা রাণীর কাছে পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবসা করার জন্য রাণীর সম্মতি ও রাজসনদ প্রদানের জন্য অনুরোধ করেন। রাণী প্রথম এলিজাবেথ এই বণিক সমিতিকে সনদ প্রদান করেন। এই সনদ প্রাপ্তির পর এই সমিতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে পরিচিত হয়। রানি এলিজাবেথ স্বয়ং এই কোম্পানির একজন অংশীদার হন। একজন শাসনকর্তা ও ২৪ জন সদস্যের দ্বারা এই কোম্পানির কার্যকরী পরিষদ গঠিত হয়। কোম্পানির ব্যবসা ছিল একচেটিয়া। ১৯৯৬ সালে আর একটি প্রতিদ্বন্দ্বী বাণিজ্যিক সংস্থা স্থাপিত হলেও তা দশ বছর পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে মিশে যায়।এ সনদ কোম্পানিটিকে ২১ বছর পর্যন্ত পূর্ব ভারতে একচেটিয়া বাণিজ্য করার প্রাধিকার অর্পণ করেছিল। তবে পরবর্তীকালে এ কোম্পানি ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং ১৮৫৮ সালে বিলুপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করে। অত:পর ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারত শাসন শুরু করে।

একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার :

৭০ হাজার পাউন্ড পুঁজি নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়। রানি এলিজাবেথ যখন সনদ প্রদান করেন তখন ভারতের শাসনকর্তা ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। আকবরের অধীনে তখন প্রায় সাত লক্ষ ৫০ হাজার বর্গ মাইলের বিশাল এক দেশ।

আকবরের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তি ও সামর্থ্য দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছিল। সেই সময়ে মুঘল সম্রাটের যে পরিমাণ ধনসম্পদ ছিল, তার কাছে পুরো ইউরোপের সম্পদ বলতে গেলে নস্যি! বহু মূল্যবান রত্নের পাশাপাশি ভারত ছিল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। যার ভাণ্ডারকে মনে করা হতো অশেষ।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে বাণিজ্য স্থাপনের লক্ষ্যগ্ৰহন :

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে জেমস ল্যাঙ্কাষ্টারের নেতৃত্বে পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে বাণিজ্যিক অভিযান পাঠায় । সুমাত্রা, জাভা ও মালাকায় এই কোম্পানি কুঠি স্থাপনের চেষ্টা করে । কিন্তু ওলন্দাজ বণিকরা এই অঞ্চলে শক্তিশালী ছিল । তীব্র প্রতিযোগিতা ও শক্তি প্রয়োগের দ্বারা স্থাপনের লক্ষ্য গ্রহণ ওলন্দাজরা মশলা দ্বীপপুঞ্জ থেকে ইংরাজ বণিকদের বিতাড়িত করে । এর ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ভারতে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনে মন দেয় । ১৬০৮ খ্রিঃ থেকে কোম্পানি ভারতে বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের চেষ্টা চালায় । ইতিমধ্যে ইংলণ্ডের রাজা প্রথম জেমসের পত্র বহন করে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হকিন্স মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরে দরবারে হাজির হন । তিনি তুর্কী ভাষা বলতে পারতেন । জাহাঙ্গীরের অনুমোদন পেয়ে তিনি ১৬০৮-১১ খ্রিঃ মোগল দরবারে থাকেন । হকিন্স সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের জন্য বাদশাহের কাছে দরবার করে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা ছিল বাণিজ্য কুঠি বা কারখানা ভিত্তিক।পর্তুগিজদের প্রতিবাদের ফলে বাদশাহ এই কুঠি তৈরীর আবেদন নাকচ করে দেন । হকিন্স বিফল মনোরথ হয়ে সুরাটে চলে আসেন । তিনি সুরাটে ইংরাজ ক্যাপ্টেন বেষ্ট - এর নেতৃত্বে দুখানি যুদ্ধ জাহাজের সাহায্য পান । হকিন্স বুঝতে পারেন যে, পর্তুগিজদের পরাস্ত না করলে মোগল সাম্রাজ্যে ইংরজদের বাণিজ্য বিস্তার করার সম্ভাবনা নেই । ক্যাপ্টেন বেষ্ট সুরাটের নিকট সোয়ালির (Swally) নৌযুদ্ধে ১৬১২ খ্রিঃ পর্তুগিজদের পরাজিত করেন । এর ফলে মোগল দরবারে ইংরাজের মর্যাদা বাড়ে । ১৬১৫ খ্রিঃ ইংরাজ নৌবহর পুনরায় সুরাটের নিকটে নৌযুদ্ধে পর্তুগিজদের পরাজিত করে । এর ফলে সম্রাট জাহাঙ্গীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সুরাটে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের আদেশ সম্বলিত ফর্মান দেন । মোগল বাদশাহ পর্তুগিজদের একচেটিয়া নৌ - প্রাধান্য নষ্ট করার জন্য ইংরাজদের বিকল্প নৌশক্তিকে পরোক্ষ ব্যবহারের নীতি নেন । তাছাড়া পর্তুগিজ ও ইংরেজের মধ্যে রপ্তানিযোগ্য মাল খরিদের জন্য প্রতিযোগিতা হলে ভারতীয় বিক্রেতারা ভাল দাম পাবে বলে বাদশাহ মনে করতেন । ইংরেজ কোম্পানি প্রথম সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে এবং এই কুঠির পরিচালকের খেতাব দেওয়া হয় প্রেসিডেন্ট বা সুরাটে ব্রিটিশ বণিক গোষ্ঠীর সভাপতি । ইতিমধ্যে মোগল সম্রাটের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির দ্বারা ভারতে ব্রিটিশ বাণিজ্য পাকা ভিতের ওপর স্থাপনের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের দূত হিসাবে স্যার টমাস রো (Sir Tomas Roe) ১৬১৫ খ্রিঃ জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন। টমাস রো - ছিলেন সুভাষিত, বুদ্ধিদীপ্ত, কূটনীতিতে দক্ষলোক। তার সুমিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা মোগল সম্রাটকে প্রভাবিত করে । তিনি তিন বছর মোগল দরবারে অবস্থান করেন । তাঁর প্রভাবে সুরাট ছাড়া গুজরাটের অন্যত্র যথা - ভারুচ, আমেদাবাদ এবং উত্তরপ্রদেশের আগ্রা প্রভৃতি স্থানে ইংরাজ বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয় । যদিও স্যার টমাস রো মোগল সম্রাটের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনে ব্যর্থ হন, তাঁর সময় থেকেই ভারতে প্রকৃতপক্ষে কোম্পানির বাণিজ্য বিস্তৃত হতে থাকে । তবে স্যার টমাস রো তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দ্বারা বোঝেন যে, শুধুমাত্র আবেদন ও ভালোমানুষির দ্বারা ভারতে কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা ও ক্ষমতা বিস্তার করা যাবে না । তিনি বিলাতের কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেন যে, এ দেশের মানুষের স্বভাব তিনি যা বুঝেছেন তা হল, তারা ভীতি প্রদর্শন ও বলপ্রয়োগ ছাড়া অন্য কিছুর দ্বারা বশীভূত হয় না । সুতরাং কোম্পানির উচিত প্রয়োজনমত তরবারি ব্যবহার করা । স্যার টমাস রো প্রকল্পিত দুমুখো নীতি, যথা - আবেদন ও বলপ্রয়োগ উত্তরকালে কোম্পানির ভারতীয় নীতিতে পরিণত হয় ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুরুতে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে মশলার ব্যবসায় প্রভাব তৈরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা সেখানে গিয়ে দেখেন তাদের আগেই সেসব ডাচদের দখলে চলে গেছে৷ ডাচদের শক্ত ভীতের কাছে টিকতে না পেরে তারা পুরোপুরি ভারতের দিকে মনোনিবেশ করে।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের অনুমতির পর তারা পূর্ব ভারতে এবং পশ্চিম ভারতের সমুদ্রের উপকূলে ছোট ছোট কুঠি নির্মাণ করতে শুরু করে কোম্পানির বণিকদল। ১৬২৩ সালে আমবয়না গণহত্যার পর ডাচরা ভারত থেকে তাদের ব্যবসায়িক প্রতিনিধি প্রত্যাহার করে নেয়। উল্লেখ্য, ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ ইস্ট কোম্পানি কর্তৃক ব্রিটিশ, জাপানিজ ও পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনাকে আমবয়না গণহত্যা বলা হয়।
স্যার টমাস রোর প্রভাবে ইংরেজ কোম্পানির সাফল্য দেখা দিলে পর্তুগিজরা ঈর্ষান্বিত হয় । ভারতে ব্রিটিশদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল পর্তুগিজরা। ১৬২০ খ্রিঃ এক তীব্র নৌযুদ্ধে পর্তুগিজরা তৃতীয় বার ইংরাজের হাতে পরাজয় বরণ করে । এদিকে ইউরোপে কূটনৈতিক পরিবর্তনের ফলে ভারতে ইঙ্গ - পর্তুগিজ বিরোধ হ্রাস পেতে থাকে । ইঙ্গ পর্তুগিজ চুক্তির (১৬৪২ খ্রিঃ) দ্বারা উভয় দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয় । ইংলণ্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস পর্তুগিজ রাজকন্যা ক্যাথারিন ব্রাগাগ্লাকে বিবাহ করলে পর্তুগালের রাজা তাঁকে বোম্বাই বন্দর যৌতুক হিসাবে দেন ।রাজা দ্বিতীয় চার্লস বোম্বাই বন্দর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বার্ষিক ১০ পাউণ্ড খাজনায় ১৬৬৮ খ্রিঃ বন্দোবস্ত দেন । কোম্পানির অধীনে বোম্বাই বন্দরের দ্রুত উন্নতি হয় । ভারতের পশ্চিম উপকূলে ব্রিটিশ বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র সুরাট থেকে বোম্বাইয়ে স্থানান্তরিত হয় । বোম্বাই - এর বাণিজ্যের এতই শ্রীবৃদ্ধি হয় যে, নিকটবর্তী মোগল বন্দর সুরাটের গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে । পশ্চিম ভারতে ব্রিটিশ শক্তি ও বাণিজ্য বোম্বাইকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত হয় । মারাঠারা প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসাবে ইংরাজকে বাধা দেয় । মারাঠা নৌ - সেনাপতি কহ্নোজী আংরে নৌ আক্রমণ দ্বারা বোম্বাইয়ের ব্রিটিশ বাণিজ্যকে বিপন্ন করার চেষ্টা করেন । মালাবারের জলদস্যুরাও বোম্বাই - এর বাণিজ্যকে বিপন্ন করে । কিন্তু ব্রিটিশ নৌবহর কহ্নোজীর নৌবহরকে বিধ্বস্ত ও তাঁর নৌঘাঁটি ঘেরিয়াকে চূর্ণ করলে পশ্চিম উপকূলের বাণিজ্যে বোম্বাই - এর অবিসংবাদী প্রাধান্য স্থাপিত হয় । বোম্বাই রক্ষার জন্য কোম্পানি দুর্গ নির্মাণ করে । ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে বোম্বাই ইংরাজদের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়।
ভারতের দক্ষিণ ভাগে মোগল আধিপত্য সুদৃঢ় না থাকায়, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলে তাদের বানিজ্য কুঠি ও ঘাঁটি স্থাপনের নীতি নেয়। দক্ষিণের স্থানীয় শক্তিগুলির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ কূটনীতি ও বলপ্রয়োগের দ্বারা কোম্পানি কুঠি ও সুরক্ষিত ঘাঁটি স্থাপনের নীতিকে সফল করে । দক্ষিণ ভারতের মসুলিপটমে ১৬১২ খ্রিঃ ইংরাজের প্রথম কুঠি স্থাপিত হয় । এরপর ওলন্দাজ কুঠি পুলিকটের নিকটে, আর্মাগাঁওয়ে মসুলিপটমে ইংরাজের অপর একটি ইংরাজ কুঠি স্থাপিত হয় । ওলন্দাজের বিরোধিতার ফলে এই স্থানে বাণিজ্যের অসুবিধা দেখা দেয় । গোলকুণ্ডার নবাবের নিকট ১৬৩২ খ্রিঃ এক ফর্মান লাভ করে কোম্পানি মসুলিপটমে তাদের শক্তি দৃঢ়ভাবে স্থাপন করে । মসুলিপটম ছিল গোলকুণ্ডা রাজ্যের প্রধান বন্দর ।

পূর্ব ভারতেও বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনের জন্য কোম্পানি গোড়া থেকে লক্ষ্য রাখে । উড়িষ্যার মহানদী উপত্যকায় হরিহরপুর, বাংলার হুগলি, কাশিমবাজার ও বিহারের পাটনায় ইংরাজ কুঠি স্থাপিত হয় । কোম্পানি বাংলা থেকে রেশম, সুতীবস্ত্র, চিনি ও সোনা রপ্তানি করত । বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার কুঠিগুলিকে ১৬৫৮ খ্রিঃ মাম্রাজের শাসনে আনা হয় । ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শাসনকর্তা শাহ সুজার কাছ থেকে ইংরাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বার্ষিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশে বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে । ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শাসনকর্তা শায়েস্তা খাঁ এবং ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব প্রদত্ত ফরমানেও এই অধিকার স্বীকৃত হয় । বাংলা ও বিহারে কুঠি স্থাপন সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় বাণিজ্যে বিশেষ অগ্রগতি ঘটে । ইংল্যান্ড বানিজ্য ও উপনিবেশ বিস্তারের জন্য কোম্পানির কর্মচারীদের বলপ্রয়োগ নীতি গ্রহনের আদেশ দেয় ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস ও দ্বিতীয় জেমস কোম্পানির সনদে কোম্পানিকে নানা প্রকার সুযোগ - সুবিধা দেন । তার ফলে কোম্পানির কাজকর্ম বৃদ্ধি পায় । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক স্যার জোসুয়া চাইল্ড ভারতে কোম্পানির বানিজ্য ও উপনিবেশ বিস্তারের জন্য কোম্পানির কর্মচারীদের বলপ্রয়োগ নীতি গ্রহনের নির্দেশ দেন। মোগল সাম্রাজ্যে অন্তর্বিদ্রোহ ইংরাজ শক্তিকে আবেদন নীতির সালে বলপ্রয়োগ নীতি গ্রহণে সাহায্য করে । বোম্বাইয়ের শাসনকর্তা ওক্সেনডেন ১৬৮৯ খ্রিঃ এক রিপোর্ট দ্বারা ভারতে কোম্পানির বাণিজ্য ও উপনিবেশ বিস্তারের জন্য বল প্রয়োগের সুপারিশ করেন । বোম্বাইয়ের গভর্ণর স্যার জন চাইল্ড ভারতের পশ্চিম উপকূলের মোগল বন্দরগুলি অবরোধ করেন এবং মক্কাগামী ভারতীয় তীর্থযাত্রীপূর্ণ জাহাজ আটক করেন । ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজগুলি লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগরে ভারতীয় বাণিজ্য জাহাজের ওপর আক্রমণ চালায় । কোম্পানি মোগল দরবারের কাছে দাবি করে যে , মোগল সরকারকে ভারত থেকে অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক কোম্পানিগুলিকে বহিস্কার করতে হবে । ভারতীয় মালের উৎপাদক ও বিক্রেতাকে সস্তায় কোম্পানিকে মাল বিক্রি করতে হবে । তাছাড়া কোম্পানির বণিকরা ইংল্যাণ্ড থেকে আমদানি মাল বেশি দামে ভারতীয়দের খরিদ করতে বাধ্য করার চেষ্টা করে । বাংলায় কোম্পানি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মোগল সরকারের বিরুদ্ধে বল প্রদর্শনের চেষ্টা করে । ইংরাজ সেনা বাংলার মোগল বন্দর হুগলি ১৬৮৬ খ্রিঃ দখলের চেষ্টা করে । ইংরাজ ক্যাপ্টেন হিদ পূর্ব বাংলার চট্টগ্রাম বন্দর দখলের চেষ্টা করেন । 
শুরুতে তারা মশলা নিয়ে ব্যবসা করলেও ধীরে ধীরে ক্যালিকো (সাদা সুতি কাপড়), রেশমী কাপড়, নীল, শোরা বা কার্বনেট অব পটাশ এবং চা নিয়ে ব্যবসা করা শুরু করে।ভারতের কাপড় ইংল্যান্ডে খুব জনপ্রিয় ছিল । ১৬৬৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ৭,৫০,০০০ খন্ড কাপড় রপ্তানি করেছিল । মাত্র দু - দশকের মধ্যে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১.৫ মিলিয়ান খন্ডে । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা চিন ও জাপান পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। ধীরে ধীরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার বিস্তৃতি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী দেশসমূহ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

কোম্পানি থেকে শাসক :

ব্যবসায় লাভ করার সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আকার ও প্রভাব বাড়তে থাকে। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে ব্রিটেনের অর্থনীতির বড় এক অংশ ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আয়। সেই সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লন্ডন, তথা ব্রিটেনের সবচেয়ে প্রভাবশালী কোম্পানিতে রূপ নেয়।
শুরুতে মুঘল সাম্রাজ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া ছিল শুধুমাত্র একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশরা ভারতের রাজনীতিতে প্রভাব খাটানো শুরু করে।এদিকে ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো ভারতে তাদের উপস্থিতি বাড়াতে শুরু করে। বিশেষ করে ব্রিটেনের জাতীয় শত্রু ফ্রান্সের ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভাবিয়ে তোলে। ফলে তখন তারা ভারতের রাজনীতি দখলের পরিকল্পনা আঁকতে শুরু করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক দক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলে৷ পাশাপাশি ভারতের উপকূলে তাদের অবস্থান ছিল শক্তিশালী। এছাড়া যেকোনো প্রয়োজনে তাদের ডাকে ব্রিটিশ নৌবাহিনী সাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। সামরিক দিক দিয়ে এগিয়ে থাকার কারণে ভারতের বিভিন্ন যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হয়।
১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কোলকাতা দখল করে নেওয়ার পরে (২০শে জুন) লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়াটসন তামিলনাড়ু থেকে জাহাজযোগে সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসেন ও কোলকাতা পুণরায় দখল করেন (২রা জানুয়ারি, ১৭৫৭)। কলকাতায় কোম্পানির অধীনস্থ বিল্ডিং হল রাইটার্স বিল্ডিং। তিনি প্রথম জীবনে কোম্পানির কেরানি ছিলেন পরে ফ্রান্স-ইংল্যান্ড যুদ্ধ শুরু হলে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন। নিজের যোগ্যতায় পরে উঁচু পদ পান। চন্দননগর দখল করার পরে সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাত করার জন্য সিরাজের পরিবারের কয়েকজন ও মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগত শেঠ প্রমুখদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেন। চুক্তি মতো কাজ হয় ও নদীয়ার পলাশির প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে মেকি যুদ্ধ হয়। সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হয়ে পালাবার সময় ধরা পড়ে নিহত হন। চুক্তি মতো মীরজাফর নবাব হন এবং এরপর যা শুরু হল তাকে “পলাশির লুটপাট” বলে অভিহিত করা চলে । যুদ্ধের পর পরই ইংরেজ সেনাবাহিনী বিশাল পরিমাণ টাকা পায় - ২,৭৫০০০ পাউন্ড । ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোম্পানি মীরজাফরের কাছ থেকে পায় ২২,৫০০,০০০ টাকা । ক্লাইভ নিজের জন্য ৩৪,৫৬৭ পাউন্ড মূল্যের জাগির পেয়েছিলেন (১৭৫৯ খ্রিঃ) । কোম্পানি তার ব্যবসায় বড়সড় পরিবর্তন আনে । ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের আগে কোম্পানি ইংল্যান্ড থেকে সোনা - রূপা আমদানি করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ে টাকার জোগান দিত । কিন্তু ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পরে ইংল্যান্ড থেকে সোনা - রূপা আমদানি করা বন্ধ হয়ে যায় । বরং বাংলাদেশ থেকে সোনা - রূপা চীন ও ভারতের অন্যান্য জায়গায় রপ্তানি করা শুরু হয় । এর ফলে ইংরেজ কোম্পানি তার ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় বেশ সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়াবার সুযোগ পায় । অন্যদিকে পলাশির যুদ্ধ জয়ের ফলে কোম্পানীর কর্মচারীদের কপাল খুলে যায় । শুধুমাত্র জুলুমবাজি করেই নয় দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার করে কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসা চালাত এবং অভাবনীয় রকমের ধনসম্পদ সংগ্রহ করেছিল । কিছুদিন এইভাবে চলার পর মীরজাফর বুঝতে পারেন ইংরেজদের অর্থিক দাবি মেটানো কঠিন । কোম্পানি তাঁকে মসনদ থেকে সরিয়ে দেয় । তাঁর জামাই মীরকাশিমকে মসনদে বসানো হয় ।
পরে ১৭৬০-এ ক্লাইভ দেশে ফিরে যান। এদিকে তার অভাবে ইংরেজরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আবার ক্লাইভের ডাক পড়ে। ক্লাইভ এদেশে আবার ফিরে আসেন। ১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর কোম্পানি বাংলার কর সংগ্রহের ক্ষমতালাভ করে। লর্ড ক্লাইভ ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে এবং ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি তখন দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেন (১৭৬৫, আগস্ট ১)। বিহার-ওড়িশার প্রকৃত শাসন ক্ষমতা লাভ করে, নবাবের নামমাত্র অস্তিত্ব থাকে। ফলে পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে যে শাসন-ব্যবস্থা চালু হয় তা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত। নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। এতে বাংলার নবাব আসলে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে আর এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। ১৭৭০-এ (বাংলা ১১৭৬ সন) অনাবৃষ্টি হয়। দেশে দেখা দেয় চরম বিপর্যয় ও দুর্ভিক্ষ কয়েক লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যান। এটাই ইতিহাসখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত এই দূর্ভিক্ষে বাংলাদেশ শ্মশানে পরিণত হয়। কোম্পানীর কর্মচারিগণ এই সময় বিস্ময়কর উদাসীনতা ও হৃদয়হীনতার পরিচয় দেয় । তারা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দুর্ভিক্ষ - পীড়িত মানুষগুলির কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করে যায়।রাজস্ব আদায় কম হলে, কোম্পানি ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য রাজস্ব ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করে। ফলে বিত্তবানদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় হলও গণ মানুষের মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। এবং ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বঙ্গদেশ, বিহার ও উড়িষ্যায় প্রায় এক কোটি লোক মৃত্যুবরণ করে। কৃষিকার্যের যে ক্ষতি হয়, বিশ বছরের মধ্যে তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে। এরপর পশ্চিম ভারতের মারাঠা এবং মহীশূরের রাজা টিপু সুলতানকে হারানোর পর পুরো ভারতই কার্যত তাদের অধীনে চলে যায়৷ মুঘল সম্রাটরা তখন পুতুল শাসকে পরিণত হয়। ১৮১৮ সালের হিসেব অনুসারে ভারতের দুই-তৃতীয়াংশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে ছিল।
বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম বছরের শাসনই কুখ্যাতি অর্জন করে। কোম্পানির দ্বৈত নীতি এবং কোম্পানির কর্মকর্তা কর্মচারীদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে বাংলায় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়।

এই অবসরে সাধারণ মানুষদের রাজস্ব মওকুফের পরিবর্তে, কোম্পানির পরিচালক সভার নির্দেশের (২৮ আগস্ট ১৭৭১) আওতায় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল প্রশাসনের ক্ষেত্রে নিজেকেই সুবা বাংলার জন্য সর্বোচ্চ সরকার ঘোষণা করে। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানির আঞ্চলিক বিষয়াদি প্রশাসনের জন্য কলকাতায় রাজস্ব কমিটি নামে এক কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। এ কমিটির প্রেসিডেন্ট হন গভর্নর এবং বাংলার ফোর্ট উইলিয়মের প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন হেস্টিংস। ভারতবর্ষে কোম্পানি শাসিত এলাকায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালুর উদ্দ্যশে ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে নিয়ামক বিধি ১৭৭৩ (Regulating Act 1773) পাশ হয়। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট দুটি সমান্তরাল বিষয়ের জন্ম দেয়।
(১) কোম্পানি ব্যবস্থাপনায় ধীরে ধীরে সরকারি (ব্রিটিশ) নিয়ন্ত্রণ প্রবেশ করে এবং (২) ১৮৫৮ সালে কোম্পানির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি হওয়া পর্যন্ত সময়ে কোম্পানির ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ও নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনা কিভাবে চলবে সে বিষয়ে রেগুলেটিং অ্যাক্টে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। কোম্পানি ব্যবস্থাপনায় সরকার প্রয়োজনবোধে যে কোনো সময় হস্তক্ষেপ করার অধিকার সংরক্ষণ করে। ১৭৮৪ সালে সরকার ভারতে কোম্পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের একটি বিশদ আইন তৈরি করে। কোম্পানি ব্যবস্থাপনা তদারকি করার জন্য একটি স্থায়ী সংসদীয় কমিটি বোর্ড অব কন্ট্রোল গঠন করা হয়। বোর্ড অব ডাইরেক্টরদের কোনো সদস্য দ্বারা বাংলার সিভিল সার্ভিসের সদস্য হওয়ার জন্য মনোনীত ক্যাডেটদের কাছ থেকে কোনো উপঢৌকন বা উপহার গ্রহণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। নিয়ামক বিধি অনুযায়ী হেস্টিংস ১৭৭৪-৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলার গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় স্বাভাবিক ফসল উৎপাদনের ধারা চালু হলে, কোম্পানির সাহায্য ছাড়াই দুর্ভিক্ষ দূর হয়ে যায়। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস পদত্যাগ করলে লর্ড জন ম্যাকফারসন (Lord John McPherson) অস্থায়ী গভর্নর জেনারেল হিসেবে এক বছর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানির শাসন চলেছিল মূলত এবং মুখ্যত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টি ও রীতিপদ্ধতিতেই। বেসরকারি ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের চাপে ১৭৯৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার অনেকটা শিথিল করা হয়। কোম্পানির জাহাজসমূহের মধ্যে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের মালামাল পরিবহণের সংরক্ষিত জায়গা রাখার ব্যবস্থা হয়। অ্যাক্ট কোম্পানির অবস্থান পুনঃনির্ধারণ করে এবং ভারতে কোম্পানি পরিচালিত রাষ্ট্রকে ব্রিটিশ রাজা বা রাণীর অধীনস্থ করা হয়। এরপর থেকে রাজা বা রানীর পক্ষে কোম্পানি ভারত শাসন করার এবং বোর্ড অব কন্ট্রোল গভর্নর জেনারেল নিয়োগের ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। ১৭৮৪ সালে উইলিয়াম পিটের ইন্ডিয়া অ্যাক্টের মাধ্যমে কোম্পানির ক্ষমতা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাতে নেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ ছিল।ওই বছরই বাংলার মুখ্য শিল্প, টেক্সটাইল রপ্তানি বন্ধ, ১৮২০ সালে টেক্সটাইলকে আমদানি পণ্য হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩০-এ কলকাতা ডকিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩৮-এ বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যারহাউস অ্যাসোসিয়েশন গঠন এবং ১৮৪০ সালে বেসরকারি খাতে চা-বাগান স্থাপনের মাধ্যমে এ দেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভর করার কার্যক্রম শুরু হয়।

একদিকে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়ার দরুণ এবং অন্যদিকে কর্মচারীদের দুর্নীতির কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার জৌলুস হারাতে থাকে। তবে গভর্নর হিসেবে লর্ড কর্নওয়ালিস আসার পর তার বেশ কিছু পদক্ষেপ কোম্পানির দুর্নীতি কমাতে সাহায্য করে। আবার কোম্পানির আয় রোজগার বাড়তে থাকে। লর্ড ওয়েলেসলী, যিনি কোম্পানির বাংলা ভিত্তিক রাষ্ট্রকে ভারতীয় সাম্রাজ্যে রূপ দেন তাকে বোর্ড অব কন্ট্রোল নিয়োগ দিয়েছিল। ভারতে কোম্পানির ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র একটি অনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া এবং মুক্ত বাণিজ্যের ব্যবসায়ীগণের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় পার্লামেন্ট কোম্পানির স্বার্থ হানিকর কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এদের মধ্যে ১৮১৩ সালের চার্টার আইনের মাধ্যমে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার রদ করার সিদ্ধান্তটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা নামের এই অঞ্চলটি ধীরে ধীরে ইংরেজদের সম্পূর্ণ করায়ত্ব হয় ১৮১৩ সালে। এদিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ নাগাদ ভারতের অর্থনীতি রীতিমত ভেঙে পড়ে। কৃষির উন্নয়নের জন্য কোনো বিনিয়োগ না করে কোম্পানি ভূমি কর বাড়াতে থাকে। যার ফলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। একই সাথে কৃষির অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় কোম্পানির আয়ও কমতে থাকে। কিন্তু কোম্পানি পরিচালনা করার জন্য তাদের বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হত। যা মেটাতে গিয়ে কোম্পানির লাভের পরিমাণ একেবারেই তলানির দিকে যেতে থাকে।

ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণ শুরু থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে মোটাদাগে বড় কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু কোম্পানি এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের ওপর একের পর এক অন্যায় নীতির বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। এক সময় কোম্পানির শাসনের প্রতি অসন্তোষ বাড়তে বাড়তে আগুনে রূপ নেয়। যার ফলস্বরূপ ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে।শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিপাহী বিদ্রোহ সফল হয়নি। কিন্তু এই ঘটনা ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটায়। ১৮৫৮ সালে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ইন্ডিয়া অ্যাক্ট পাশ হয়।

এই আইনের মাধ্যমে ভারতের শাসনভার সরাসরি রাণীর হাতে চলে যায়। ১৮৫৮ সালে আইন পাশ হলেও ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিদায় ঘটে ১৮৭৪ সালে। এরপর তল্পি-তল্পাসহ তারা চীনের দিকে চলে যায়।চীনের সাথে তাদের মূল ব্যবসা ছিল আফিমের। পূর্বে তারা ভারতে আফিম উৎপাদন করে চীনে রপ্তানি করত। তার বিনিময়ে চীন থেকে অন্যান্য পণ্য আমদানি করত। 

মুদ্রার প্রচলন :



১৭১৫ সালে মোগল দরবার থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। ঐ মুদ্রা মোগল সাম্রাজ্যেও চালু হয়। সাম্প্রতিক কালে দাবি করা হয় এই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুদ্রার পিঠে শ্রীরামের প্রতিকৃতি আছে। এছাড়া আছে অনান্য দেবদেবীও। এ মুদ্রা নাকি সেই ব্রিটিশ আমলের। চালু করেছিল খোদ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ‌বর্তমান দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়ামের মুখপাত্র পুরাতত্ত্ববিদ সঞ্জীব সিং জানাচ্ছেন, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুদ্রা চালু করেছিল ঠিকই। বিভিন্ন ধাতুর মুদ্রার প্রচলন ছিল। কিন্তু হিন্দু দেবদেবীর প্রতিকৃতি সম্বলিত কোনও মুদ্রার কথা জানা নেই। গোটা বিশ্বের কোথাও এরকম কোনও মুদ্রা আছে বলেও কোনও তথ্য নেই। এমনকী রিজার্ভ ব্যাংকের যে মুদ্রার তালিকা, সেখানেও এই ধরনের মুদ্রার কোনও তালিকা নেই।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকা :




ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৬০০ এবং ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে। ইংল্যান্ড থেকে গ্রেট ব্রিটেন এবং গ্রেট ব্রিটেন থেকে যুক্তরাজ্যে পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে পতাকাটিও পরিবর্তিত হয়। প্রথমদিকে এটি লাল ও সাদা ডোরাকাটা দাগযুক্ত ছিল যার উপরের বামদিকের কোণাটি ছিল ইংল্যান্ডের পতাকাযুক্ত। পরবর্তীতে জাতির বিকাশের সাথে সাথে পতাকাটি যথাক্রমে ১৭০৭ এবং ১৮০১ সালে গ্রেট ব্রিটেনের পতাকা এবং যুক্তরাজ্যের পতাকা অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে নাগাদ করা হয়েছিল। এটি স্টার অফ ইন্ডিয়া সিরিজের পতাকা দ্বারা সফল হয়েছিল।

১৬০০ সালে রানী প্রথম এলিজাবেথ কর্তৃক ভারত মহাসাগরে বাণিজ্য করার রাজকীয় সম্মতি পাওয়ার পর ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে কোণায় ইংল্যান্ডের পতাকাযুক্ত তেরোটি লাল এবং সাদা স্ট্রাইপের একটি পতাকা গ্রহণ করে। স্ট্রাইপের সংখ্যা হিসেবে ১৩ কে গ্রহণ করার কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেশ কয়েকজন শেয়ারহোল্ডার ছিলেন ফ্রিম্যাসনস, এবং তেরো সংখ্যাটি ফ্রিম্যাসনরিতে শক্তিশালী বলে বিবেচিত হত।
দূর-প্রাচ্যে বাণিজ্য করার সময় পতাকাটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য প্রথম সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেন্ট জর্জ'স ক্রস ব্যবহারের কারণে। জাপানে ১৬১৬ সালে কোম্পানির জাহাজগুলিকে বন্দর থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় কারণ পতাকাটিতে ব্যবহৃত ক্রসচিহ্নটিকে খ্রিস্টান ধর্মের প্রতীক হিসেবে দেখা হত, যা জাপানিরা ১৬১৪ সালেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। টনকিনের ল-রাজবংশ (Lê dynasty) কোম্পানির এই পতাকার ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করে। কেননা তাঁরা বিশ্বাস করত যে ক্রসচিহ্নটি খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের একটি মাধ্যম, যার প্রচার টনকিনিরা নিষিদ্ধ করেছিল। বাণিজ্যে কোম্পানিটির প্রতিদ্বন্দ্বী, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংরেজ কোম্পানির পক্ষে যুক্তি দিয়েছিল যে ক্রসটি ইংরেজ জাতির প্রতীক, খ্রিস্টান ধর্মের প্রতীক নয়। তবে টনকিনিরা পতাকাটি উড়ানো নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত ক্রসটি সরানো না হয়। ১৬৭৩ সালে যখন কোম্পানিটি জাপানের সাথে বাণিজ্য পুনরায় চালু করার চেষ্টা করছিল তখন তারা প্রাথমিকভাবে ঘোষণা করে যে তারা তাদের পতাকা পরিবর্তন করবে না। তবে স্থানীয় পরামর্শ এবং জাপানি কর্তৃপক্ষের কাছে কারণ ব্যাখ্যা চাওয়ার পর সংস্থাটি দূর-প্রাচ্যে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে লাল এবং সাদা স্ট্রাইপযুক্ত একটি পতাকা ব্যবহার করা শুরু করে, তবে তাতে ইংল্যান্ডের পতাকা ছিল না।

১৬৮২ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের বাটাভিয়ায় ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যদল কর্তৃক পতাকা ছিড়ে ফেলার অভিযোগে ইংরেজ ও ডাচ সরকারের মধ্যে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এই পতাকাটি। ১৬০৩ সালে, স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস যখন ইংরেজ সিংহাসনে আরোহণ করলেন, তখন ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডের মুকুটকে একত্রিত করলেন। সে সময় তিনি সংযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রের ব্যবহারের জন্য উভয় জাতির একটি সম্মিলিত পতাকা তৈরি করেন। তবে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট এবং স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্ট ঐক্যবদ্ধ হতে নারাজ ছিল এবং আশা করেছিল যে দেশদুটো আলাদা থাকবে। কিং'স কালারস হিসাবে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য জেমস গ্রেট ব্রিটেনের পতাকাটির ব্যবহার অব্যাহত রেখেছিলেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংল্যান্ডের পতাকার সাথে তাদের নিজস্ব চিহ্নের ব্যবহার বজায় রাখে। ১৬৬৮ সালে, রাজা দ্বিতীয় চার্লস বোম্বাই পরিচালনার ভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে ন্যস্ত করেন। এরপর কোম্পানিটি কিং'স কালার্স সহ একটি নতুন পতাকা গ্রহণ করেছিল। যেমনটি দেখানো হয়েছিল বোম্বাইয়ের দুর্গের জন্য সেখানকার জন্য প্রধানত নীল রংযুক্ত (যাতে সাদা ও লাল রং ও ছিল) একটি নতুন পতাকা তৈরি করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল "যদি সেখানে কিং'স কালারস রাখা হয়; 'যদি তা না হয় তবে সাদা এবং লালই যথেষ্ট হবে''।পরবর্তীতে রাণী অ্যানের নির্দেশে অ্যাক্টস অব ইউনিয়ন ১৭০৭ দ্বারা কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন গঠিত হওয়ার পর কিং'স কালারসই আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেট ব্রিটেনের পতাকা হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পতাকা গ্র্যান্ড ইউনিয়ন পতাকাকে অনুপ্রাণিত করেছিল বলে ধারণা করা হয়। কারণ দুটি পতাকার নকশা একইরকম ছিল। এই সাদৃশ্যের জন্য অসংখ্য উৎসকে দায়ী করা হয়।পেন্সিল্‌ভেনিয়ার বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন একবার একটি বক্তৃতাতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা হিসাবে কোম্পানির পতাকা গ্রহণ করাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১৮০১ সালে গ্রেট ব্রিটেন ও কিংডম অব আয়ারল্যান্ড একীভূূত হয়ে ইউনাইটেড কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড গঠনের ফলে সেন্ট প্যাট্রিকের ক্রসকে অন্তর্ভুক্ত করতে ইউনিয়নের পতাকাটির পরিবর্তন করা হয়। সেই অনুসারে কোণায় নতুন পতাকা প্রদর্শন করার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকা নবায়ন করা হয়েছিল।

১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে জাতীয়করণ এবং ভারতের অভ্যন্তরে তাদের সমস্ত সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে ভারত সরকার আইন ১৮৫৮ পাস করে, যেখানে তারা আইনত ব্রিটিশ রাজের অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়। এইভাবে কোম্পানিটিকে বিলুপ্ত করা হয় এবং তাদের পতাকাটি সরকারীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

প্রতীক :



ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়, সমসাময়িক রাজ্যের পতাকার উপর ভিত্তি করে একটি ক্যান্টন এবং 9-থেকে-13টি পর্যায়ক্রমে লাল এবং সাদা ডোরার একটি ক্ষেত্র।

1600 সাল থেকে, ক্যান্টনটি ইংল্যান্ড রাজ্যের প্রতিনিধিত্বকারী সেন্ট জর্জ ক্রস নিয়ে গঠিত । অ্যাক্টস অফ ইউনিয়ন 1707 -এর সাথে , ক্যান্টনটিকে নতুন ইউনিয়ন পতাকায় পরিবর্তিত করা হয় - একটি ইংরেজি সেন্ট জর্জ ক্রস এবং একটি স্কটিশ সেন্ট অ্যান্ড্রু'স ক্রস - গ্রেট ব্রিটেনের রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করে । 1800 সালের অ্যাক্টস অফ ইউনিয়নের পরে যা গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডের যুক্তরাজ্য গঠনের জন্য গ্রেট ব্রিটেনের সাথে আয়ারল্যান্ডে যোগ দেয় , ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকার ক্যান্টনটি সেন্ট প্যাট্রিকস সল্টাইর অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সেই অনুযায়ী পরিবর্তন করা হয়েছিল ।

পতাকার ক্ষেত্রে স্ট্রাইপের সংখ্যা এবং ক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। ঐতিহাসিক নথি এবং পেইন্টিংগুলি 9-থেকে-13 স্ট্রাইপের বৈচিত্র দেখায়, কিছু ছবিতে উপরের স্ট্রাইপ লাল এবং অন্যরা সাদা দেখায়।

আমেরিকান বিপ্লবের সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকা প্রায় গ্র্যান্ড ইউনিয়ন পতাকার মতোই ছিল । ইতিহাসবিদ চার্লস ফসেট যুক্তি দিয়েছিলেন যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকা আমেরিকার তারা এবং স্ট্রিপগুলিকে অনুপ্রাণিত করেছিল ।

অস্ত্রের কোট :



১৬০০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আসল কোট অফ আর্মস দেওয়া হয়েছিল। "আজুর, তিনটি মাস্তুল সহ তিনটি জাহাজ, কারচুপি করা এবং সম্পূর্ণ পাল এর নীচে, পাল, পেন্যান্ট এবং এনসাইনস আর্জেন্ট, প্রতিটি ক্রস গুলেস দিয়ে চার্জ করা হয়েছে; দ্বিতীয়টির প্রধানের উপর একটি ফ্যাকাশে ত্রৈমাসিক Azure এবং গুলেস, 1 এবং 4 তারিখে একটি ফ্লুর -ডি-লিস বা, ২য় এবং ৩য় একটি চিতাবাঘ বা, দুটি গোলাপের মধ্যে গুলেস বীজ বা কাঁটাযুক্ত ভার্ট।"ঢালটি একটি ক্রেস্ট হিসাবে ছিল : "একটি ফ্রেম ছাড়া একটি গোলক, বাঁকে রাশিচক্রের সাথে আবদ্ধ বা, দুটি পেন্যান্ট ফ্লোট্যান্ট আর্জেন্টের মধ্যে, প্রতিটি একটি ক্রস গুলেস দ্বারা চার্জিত, গোলকের উপরে Deus indicat শব্দগুলি" ( ল্যাটিন : ঈশ্বর নির্দেশ করে)। সমর্থকরা ছিল দুটি সামুদ্রিক সিংহ (মাছের লেজ বিশিষ্ট সিংহ) এবং মূলমন্ত্র ছিল Deo ducente nil nocet (ল্যাটিন: where God Leads, Nothing Harms)। 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরবর্তী অস্ত্র, 1698 সালে মঞ্জুর করা হয়েছিল, ছিল: "আর্জেন্ট এ ক্রস গুলেস; ডেক্সটার চিফ কোয়ার্টারে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের ত্রৈমাসিক অস্ত্রের একটি এস্কুচিয়ন, ঢালটি শোভাময়ভাবে এবং নিয়মিতভাবে মুকুট পরানো হয়" ক্রেস্টটি ছিল: "একটি সিংহ প্রবল রক্ষক বা কপালের মধ্যে একটি রাজকীয় মুকুট ধরে রেখেছে", সমর্থকরা ছিল: "দুটি সিংহ প্রচণ্ড অভিভাবক বা, প্রত্যেকে একটি ব্যানার খাড়া আর্জেন্টকে সমর্থন করে, একটি ক্রস গুলেসের সাথে অভিযুক্ত।" নীতিবাক্য ছিল Auspicio regis et senatus angliæ (ল্যাটিন: ইংল্যান্ডের রাজা এবং সেনেটের আন্ডারে)


বনিক চিহ্ন : 
১৬০০ সালে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে চার্টার্ড করা হয়, তখনও স্বতন্ত্র বণিক বা কোম্পানির সদস্যদের জন্য প্রথাগত ছিল যেমন কোম্পানি অফ মার্চেন্ট অ্যাডভেঞ্চারার্সের জন্য একটি বিশিষ্ট বণিকের চিহ্ন রয়েছে যা প্রায়শই রহস্যময় "চারটির চিহ্ন" অন্তর্ভুক্ত করে এবং একটি ট্রেডমার্ক হিসাবে কাজ করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিক চিহ্নে একটি হৃদয়ের উপরে একটি "চারটি চিহ্ন" ছিল যার মধ্যে নীচের বাহুগুলির মধ্যে একটি সল্টার ছিল যার আদ্যক্ষর ছিল "EIC"। এই চিহ্নটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুদ্রার একটি কেন্দ্রীয় মোটিফ ছিল এবং সিন্ধে ডক ডাকটিকিটগুলিতে প্রদর্শিত কেন্দ্রীয় প্রতীক গঠন করে ।
This symbol became known as “the chop”, a word derived from the Hindi छाप ćhāp – which means stamp. The chop was not only a mark of ownership showing that products were from The East India Company, it also became a symbol of the quality of those wares.

কর্মক্ষেত্র হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমিকা

কর্মী সংখ্যার দিক থেকে ব্রিটেনে তখনকার সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল সবার উপরে। দেশীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর পাশাপাশি তারা হাজারো বিদেশি কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিল। যেমন- ভারতে তাদের দু' লক্ষ ষাট হাজার সৈন্যের বিশাল এক বাহিনী ছিল। যার প্রায় অধিকাংশ ছিলেন ভারতীয়। বিশেষ করে সিপাহি হিসেবে যারা কাজ করতেন, তাদের প্রায় সবাই ছিলেন ভারতীয়। এই কোম্পানির অধিকাংশ পদে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের আধিপত্য ছিল। গৃহকর্মী ছাড়া আর কোনো পদে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল না।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মী নিয়োগ করার জন্য প্রতি বছর ২৪ জন শেয়ার হোল্ডারের একটি পরিচালনা কমিটি তৈরি করা হত। কোম্পানিতে যাদের কমপক্ষে দু' হাজার পাউন্ডের শেয়ার ছিল, তারাই এই কমিটিতে জায়গা পেতেন। কোম্পানির গুদামের সাধারণ শ্রমিক থেকে শুরু করে লন্ডনের প্রধান কার্যালয়ের একজন কেরানি নিয়োগের ভার ছিল এই কমিটির উপর। এই কমিটির সুপারিশ ছাড়া কোনো কর্মী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ পেতেন না। 
ইস্ট ইন্ডিয়াতে কোম্পানির চাকরিতে প্রবেশের আগে একজন কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারীকে বিভিন্ন অঙ্কের বন্ড প্রদানের পাশাপাশি বিনামূল্যে পাঁচ বছর মেয়াদে ইন্টার্নশিপ করতে হতো। ১৭৭৮ সালে ইন্টার্নশিপের মেয়াদ কমিয়ে তিন বছর করা হয়। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে এসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের ইন্টার্নশিপে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সারা বছরের জন্য মাত্র ১০ পাউন্ডে ভাতা প্রদান করতো, যা বর্তমান সময়ে ১২,৩৫০ পাউন্ডের সমান। ১৬৮০ এর দিকে ইস্ট ইন্ডিয়ার অধীনস্থ বিদেশি কোনো কারখানার প্রধানকে পাঁচ হাজার পাউন্ড বন্ধক রাখতে হতো। যা এখনকার সময়ে ৩,৬০,৫০০ পাউন্ডের সমান। বন্ধক রাখার পাশাপাশি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে নিয়োগ পাওয়ার জন্য আচার-আচরণকে গুরুত্বের সাথে দেখা হতো। সবমিলিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরির জন্য বন্ড, ব্যবহার ও ইন্টার্নশিপের পারফরম্যান্স ছিল মূল নির্ণায়ক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলেজ :

১৮০০ সালের দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা লক্ষ করলেন, তারা যে সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ দিয়েছেন, তারা সাম্রাজ্য পরিচালনা করার মতো দক্ষ নন। ১৮০৬ সালে স্থপতি উইলিয়াম উইলকিন্সের করা নকশায় হেইলিবারিতে ৬০ একর জমির উপর কোম্পানির অর্থায়নে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজ চালু করা হয়৷ এই কলেজে মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। হেইলিবারির প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রমে ছিল ইতিহাস, আইন, হিন্দি, ফারসি, তেলেগু ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা৷ সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে। ফলে ১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজও বন্ধ হয়ে যায়। 

প্রধান কার্যালয় :

১৭৯০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন তাদের প্রধান কার্যালয় ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসকে নতুনভাবে তৈরি করে, তখন বিশ্ব জুড়ে নব্য ক্লাসিসিজমের উন্মাদনা। তার সাথে মিল রেখে ভবনের প্রবেশমুখে ছ'টি বিশাল কলামের বারান্দা তৈরি করা হয়। এর ওপরের টিমপেনামে রাজা তৃতীয় জর্জের একটি প্রতিকৃতি ছিল, যার মাধ্যমে বোঝানো হয়- ইস্ট ইন্ডিয়ার ব্যবসাকে তিনি রক্ষা করছেন। মূলত এটি ছিল কোম্পানির কর্পোরেট ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ।

ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসের অন্দরসজ্জা ছিল অনিন্দ্যসুন্দর। কার্যালয়ের মূলকক্ষে ছিল মার্বেল পাথরের তৈরী ব্রিটেনের কল্পপ্রতিমা 'ব্রিটানিয়া', যা ঘিরে রয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা ও ভারতের মানচিত্র। দরজার প্যানেলগুলোতে লাগানো ছিল বোম্বের মতো কোম্পানির অধীনস্থ বিভিন্ন বন্দরের ছবি

খাদ্যের সমারোহ : 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান কার্যালয়সহ অন্যান্য অফিস ও কারখানায় কর্মীদের খাবারের ব্যবস্থা ছিল। প্রধান কার্যালয়ে কোনো কর্মী নির্ধারিত সময়ে আগে আসলেই তাদের বিনামূল্যে সকালে নাস্তা দেওয়া হতো। এছাড়া ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়ার যেসব কারখানা ছিল, সেখানে বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হত। তবে তা কখনোই অবজ্ঞামিশ্রিত ছিল না, নিম্নমানের তো নয়ই নয়। অত্যন্ত যত্নসহকারে সবার কথা বিবেচনা করে রান্না করা হতো।

১৬৮৯ সালে সুরাটে কোম্পানির কারখানা পরিদর্শনে এসেছিলেন জন ওভিংটন নামের এক যাজক। তিনি সেখানে রান্নার জন্য একজন করে ইংরেজ, পর্তুগিজ ও ভারতীয় রাঁধুনিকে নিয়োজিত দেখেছিলেন। একসাথে তিনজন রাঁধুনির রাখার উদ্দেশ্য ছিল- কর্মীদের তাদের নিজেদের দেশীয় খাবারের স্বাদ দেওয়া।

খাবার হিসেবে থাকতো পোলাও, কিশমিশ, কাঠবাদাম, পাখির মাংস, গরুর মাংসের রোস্ট, ওয়াইন ও দেশি ভাং। এছাড়া রবিবার ও অন্যান্য ছুটির দিনে খাবার পদসংখ্যা কখনো ষোলোতে পৌঁছে যেতো। যার মধ্যে থাকতো ময়ূরের মাংস, খরগোশের মাংস, হরিণের মাংস, পেস্তাবাদাম, খোবানি (অ্যাপ্রিকট), চেরিসহ আরো অনেক খাবার। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের কর্মীদের দুপুর ও রাতের খাবারে মদ পরিবেশন করতো। 

বেতন : 

অষ্টাদশ শতকের শেষ এবং ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনেক কর্মকর্তার বেতন ছিল ব্রিটেনের সর্বোচ্চ বেতনভুক্তদের তালিকায়। কোম্পানির একজন কর্মী শুরুতে বাৎসরিক ৪০ পাউন্ড বেতনে চাকরিতে যোগদান করতেন। যা বর্তমান সময়ের প্রায় ৩০ হাজার পাউন্ডের সমান। এরপর ১০-১৫ বছর চাকরি করার পর বেতন বেড়ে দাঁড়াত ২২০ পাউন্ডে। আর কেউ যদি ৪০ বছর চাকরি করেন, তাহলে তার শেষদিকে বেতন বৃদ্ধি পেয়ে বছরে ৬০০ পাউন্ড হয়ে যেত। ১৮৪০ সালে কোম্পানির একজন কেরানির বেতন অন্যান্য খাতের একজন শ্রমিকের চেয়ে ১২ গুণ বেশি ছিল। এছাড়াও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মীদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থাও ছিল। কেউ যদি কোম্পানিতে ৪০ বছর কাটান, তাহলে তার চাকরি জীবনের বেতনের চারভাগের তিনভাগ পরিমাণ এককালীন অর্থ নিয়ে অবসরে যেতে পারতেন।

ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে গুরুত্ব বহন করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিদর্শন হল নির্যাতিত শোষিত ভারতবর্ষের ইতিহাসে শিল্প ও কৃষিকাজের অবক্ষয়ের চিত্রপট।


... 
তথ্যসূত্র : বিভিন্ন বই থেকে প্রাপ্ত তথ্য