চন্দননগরের নামকরণের ইতিহাস - Pralipta


অনির্বাণ সাহা : চন্দননগর শহরটি একটি বহু প্রাচীন শহর। পরবর্তীকালে এখানে ফরাসিরা তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে। ১৬৭৩-৭৪ সালে নবাব সায়েস্তা খাঁয়ের কাছ থেকে ২০অরপাঁ জমি ৪০১ টাকায় কিনে এক ফরাসি নাবিক দ্যুপ্লেসি তাদের কুঠি স্থাপন করেন তালডাঙ্গায় ও ব্যবসা শুরু করেন। বিভিন্ন কারণে তাদের ব্যবসা বিশেষ লাভজনক না হওয়ায় খুব অল্পদিনেই তারা সেই স্থান ত্যাগ করে। পরবর্তীতে ১৬৮৬ সালে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের অনুমতি নিয়ে তারা দ্বিতীয়বার এখানে কুঠি স্থাপন করে। তখনও পর্যন্ত এই শহর "চন্দননগর" নামে পরিচিত হয়নি। ছোট ছোট তিনটি গ্রামের (বোড়, খলিসানি ও গোন্দলপাড়া)  সম্মিলিত রূপ হিসাবেই এই শহরকে দেখা হতো। প্রাচীনকালের বিভিন্ন পুঁথি বা গ্রন্থে পৃথকভাবে এই তিনটি গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেগুলি হলো :
আনুমানিক ১৪৯৫-৯৬ সালে বিপ্রদাস রচিত মনসামঙ্গল কাব্যে "বোরো"। 
আনুমানিক ১৫৮৪-৯৫ সালে মুকুন্দরাম রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে "গোন্দলপাড়া"। 
আনুমানিক ষোড়শ শতকে কবিরাম রচিত দিগ্বিজয়-প্রকাশ গ্রন্থে "মহাগ্রাম" যা প্রকৃত পক্ষে হলো খালিসানি।

চণ্ডীর কথা নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে "বোড়তে বোড়াইচন্ডী করিলা স্থাপন"।
কিন্তু "চন্দননগর" নামটি কোথা থেকে ও কিভাবে এলো সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে । অনেকে মনে করেন ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী এই শহর অনেকটা অর্দ্ধ চন্দ্রের মতো আকৃতির বলে ফরাসিরা একে "চন্দ্রনগর" বলে অভিহিত করেছিল, যেখান থেকে অপভ্রংশীত হয়ে "চন্দননগর" নামের উদ্ভব হয়েছে। তৎকালীন যুগে ফরাসিরা এখানে চন্দনকাঠের ব্যবসা করত, যা বেশ লাভজনক ছিল। "Land of Sandal Wood" বা "Ville du Bois de Sandal" ও "Ville de la Lune" - এইসব গ্রন্থে এই স্থানটিকে চন্দনকাষ্ঠ-এর দেশ বা "চন্দননগর" নামের অভিহিত করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ডক্টর সুকুমার সেনের মতে বোড়াইচন্ডীতলায় অবস্থিত মা চণ্ডীর মন্দিরের নাম থেকে এই শহরের নাম চণ্ডীরনগর, পরবর্তীতে চন্দননগর হয়েছে । ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষের মতে চন্দ্র রাজবংশের সময়কালে এই শহরের সৃষ্টি হতে পারে, সেই কারণেই এই শহরের নাম চন্দননগর হয়েছে । আরও একদল ঐতিহাসিক যারা মনে করেন স্যার উইলিয়াম জোন্স যখন গরুটি (বর্তমান গৌড়হাটি) "Ghiretta House" নামক প্রাসাদে আমোদ-প্রমোদে যোগ দিতেন, তখন তিনি একটি রোজনামচা লিখে গেছেন। সেখান থেকে জানা যায় যে, ফরাসিরা তাদের "চন্দন সো লিপোয়ায়ে ধাম" প্রথানুসারে শহরকে সুসজ্জিত করত বলে এই শহরের নাম হয়েছে "চন্দননগর"। যদিও তার লেখা থেকে "চন্দন সো লিপোয়ায়ে ধাম" এর প্রকৃত অর্থ জানা যায় না। এছাড়াও এই শহরের পূর্বে বয়ে চলা ভাগীরথীর ঠিক ওপারে অবস্থিত তৎকালীন "স্যানেনগড়" (Sanengad) বা "সম্মুখগড়" যা বর্তমানে "শ্যামনগর" নামে পরিচিত তার সাথে সদৃশ্য রেখেই শহরের নামকরণ এইরূপ বলে মনে করা হয়।

তবে তথ্যগত দিক থেকে দেখলে এই "চন্দননগর" নামের উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় Fan-den-Broke-এর ১৬৬০ সালের একটি মানচিত্রে "চন্দননগরের" উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও মানচিত্রটিতে এই শহরের অবস্থান দেখানো হয়েছে গঙ্গার ওপারে। তবে এই মানচিত্রটি সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয় ১৭২৬ সালে (শ্রীযুক্ত রাধানাথ মিত্র ও শ্রীযুক্ত হরিহর শেঠ মহাশয় এই মানচিত্রে চিহ্নিত অংশটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং এতদিন পরে প্রকাশিত হলেও মানচিত্রটি সংশোধন করা হল না কেন - তাদের এই প্রশ্নটি আজও নিরুত্তর থেকে যায়)। এরই মধ্যবর্তী সময়ে "চন্দননগর" নামের উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬৯৬ সালে ২১শে নভেম্বর তিন ফরাসি (মাট্যাঁ, দেলাদ ও পেলে) কর্তৃক তাদের ডিরেক্টরকে লেখা একটি চিঠিতে। ১৭০৬ সালে হ্যামিল্টন নামক এক ইউরোপীয় বণিক তাঁর ভ্রমণ বর্ণনায় তৎকালীন চন্দননগর শহরকে "চরনগর" বলে উল্লেখ করেন, যা পরবর্তী সময়ে অপভ্রংশ রূপ নিয়ে বর্তমান শহরের নাম নেয় বলে অনেকে মনে করেন। আবার ১৭৫৭ সালের ৩০শে মার্চ ক্লাইভ কর্তৃক চন্দননগর বিজয়ের পর নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লাকে লিখিত চিঠিতে চন্দননগরকে তিনি "ফ্রান্সডাঙ্গী" বলে উল্লেখ করেন। যদিও এটি ফরাসি উপনিবেশ ছিল বলে বা ফরাসিরা আসার পর থেকেই একে "ফরাসডাঙ্গা" বলে অভিহিত করা হতো। তবে প্রাথমিকভাবে ফরাসি এক্তিয়ারাধীন ৭ বিঘা জমিকেই ফরাসডাঙ্গা বলা হলেও পরবর্তীকালে ফরাসডাঙ্গা চন্দননগরেরই একটি সহনাম হয়ে ওঠে। ক্লাইভ "ফ্রান্সডাঙ্গী" বলতে এই ফরাসডাঙ্গাকেই বুঝিয়েছিলেন।

আবার ১৩ই সেপ্টেম্বর, ১৬৭৬ সালে পর্যটক স্ট্রেণস্যাম মাস্টারের (Streynsham Master) লেখা একটি ডাইরি থেকে জানা যায় যে, তিনি জলপথে ভ্রমণকালে হুগলি থেকে দুমাইলের কম পথ আসার পর ডাচকুঠি ও বাগানের দেখা পান, সেখান থেকে কলকাতার দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে এলে ফরাসি অধিকৃত একটি বৃহৎ ভূখণ্ড দেখতে পান। তাঁর মতে সেখানে একটি বৃহৎ গেট ছিল যা ডাচ অধিকৃত ছিল। তিনি ফরাসি অধিকৃত ভূখণ্ডটির যথাযথ নাম উল্লেখ না করলেও অবস্থানগত দিক থেকে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, তিনি চূচূড়া শহর লাগোয়া চন্দননগর শহরের উত্তরের অংশটির উল্লেখ করেছেন তাঁর বর্ণনায়। 
উপরোক্ত সকল তথ্যগুলিকে বিচার করলে দেখা যায় ১৬৯৬ সালের ২১শে নভেম্বর সর্বপ্রথম লিখিতভাবে "চন্দননগর" নামটি পাওয়া যায় (ফরাসি ও বৃটিশরা যেভাবে শহরের নামটি উচ্চারণ করত তারা সেভাবেই শহরের নামেই বানান লিখত। ফরাসিরা ১৩ সংখ্যাকে অমঙ্গল সূচক মনে করত তাই তারা ১২টি অক্ষর দিয়ে এই শহরের বানান লিখত - "CHANDERNAGOR"। আবার বৃটিশরা এই শহরের বানান ১৩টি সংখ্যা দিয়েই লিখত - "CHANDERNAGORE"। এখন আমরা যেভাবেশহরের নামটি উচ্চারণ করি সেভাবেই শহরের নামের বানান লিখি -"CHANDANNAGORE"।) তাই ২১শে নভেম্বরকেই এই শহরের জন্মদিন হিসাবে ধরা হয়। 

... 
তথ্যসূত্র :

→ চন্দননগরের কথা - লিপিকা ঘোষ। 
→ সংক্ষিপ্ত চন্দননগর পরিচয় - হরিহর শেঠ। 
→ চন্দননগর সেকাল ও একাল - শুভ্রাংশু কুমার রায়। 
→ চন্দননগরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস - অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। 
→ ফেসবুকের The Chandannagore - দি চন্দননগর পেজে অভিজিৎ সিংহ রায় মহাশয়ের প্রতিবেদন।
→ ফেসবুকের The Chandannagore - দি চন্দননগর পেজে অজয় দেশী মহাশয়ের একটি প্রতিবেদন। 
→ ইতিহাস অনুসন্ধানী, সুলেখক শ্রীযুক্ত মানস সরকার মহাশয়ের সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য।

(প্রথম প্রকাশ : Golpo.in (A digital platform for story writing), ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২০)