Suvarna Banik: বঙ্গে সুবর্ণবণিক সমাজের উদ্ভব - Pralipta


প্রলিপ্ত ডেস্ক: কুশল আঢ্য নামে এক বণিকের বসবাস ছিল অযোধ্যার রামগড়ে। তিনি ছিলেন প্ৰচুর ধনসম্পদশালী বহু সদ্, গুণ সম্পন্ন এক বৈশ্যকুলোদ্ভব বণিক, হীরা মুক্তা প্রবাল মাণিক সোনা রূপা ইত্যাদিসহ তিনি ছিলেন সে যুগের ধনকুবের। তারই এক পুত্র — সনক আঢা অযোধ্যা থেকে ৪৬ ঘর বৈশ্য সহ বসবাস উঠিয়ে নিয়ে আসেন এই বাংলায়। এই সনক আঢ্যই হচ্ছেন আজকের ‘সুবর্ণ বণিক’দের বঙ্গে আনয়নের ভগীরথ। কিন্তু ‘আঢ্য’ কথাটি সম্বন্ধে এবার কিছু জানা দরকার। বৈদিক সংস্কৃত ভাষাকে কিছু সংস্কার সাধন করেন ‘ পাণিনি ' নামক বৈয়াকরণিক, তারপরে ঐ ভাষার নাম হয় 'সংস্কৃত’ ‘আঢ্য' কথাটি পাণিনির পূর্ব যুগেও ব্যবহৃত হতো। কাশ্মীরের ব্রাহ্মণ কবির নাম - 'গুণাঢ‍্য’। এইখানেই পাওয়া যাচ্ছে ‘আঢ্য’ কথাটি প্রাচীনতম ব্যবহার এবং বোঝা যাচ্ছে কথাটি প্রাক্ পাণিনি যুগের বৈদিক ভাষা। অতএব আর্য্যদের মধ্যে আঢ্যদের স্থান সুনিশ্চিত। আর্য‍্য কথাটির ধাতুগত অর্থ কৃষিকাৰ্য‍্য , আঢ্য কথাটি ধাতুগত অর্থ 'অনেক', (আঢ‍্য < অটল < অঢেল)।

অৰ্থাৎ কৃষিকার্যের দ্বারা যিনি অঢেল সম্পদের অধিকারী তিনি আর্যদের মধো ‘আঢ‍্য’। তখন কর্মগত বর্ণ বিভাগের ভিত্তিতে সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরাই ‘ব্রাহ্মণ’ ছিলেন কুলগত বর্ণ বিভাগ তখনও ছিল না। সেই মতে আর্য্য শ্রেষ্ঠদের মধ্যে 'আঢ্য’ গণ্য ছিলেন আদি ব্রাহ্মণ, তাছাড়া মনুসংহিতার মতে ‘ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য সূর্য্য বর্ণা দ্বিজাতয়'। তাই কবি প্ৰতিভা সম্পন্ন গুণাঢ্য ব্রাহ্মণ রূপেই পরিচিত। এই ‘আঢ‍্য’গণের কয়েকটি শাখা, ভারতের অন‍্যান্য অঞ্চলে প্রসারিত হয়। এই প্রসার লাভের পিছনে বৌদ্ধধর্মের তাড়না থাকতে পারে, কারণ ব্রাহ্মণ - রূপে একদল ‘আঢ‍্য’ গেছেন দক্ষিণাত‍্যে, আর বৈশ্যরূপে যে আঢ্যদল পূর্ব ভারতে আসেন, তাদের মধ্যে বিশিষ্টজন হলেন পূৰ্ব্বোক্ত ‘কুশল আঢ্য'। দাক্ষিণাত্যে এখনও সাত ঘর আঢ‍্য আছেন। কমরেড ই . এম - এস নামুদ্রিপাদ ঐরূপ একজন ‘আঢ্য’। এখানে ‘আঢ্য' কথাটি নামের শেষে উপাধিরাপে ব্যবহৃত হয় না। এখানে 'আঢ্য' কথাটির অর্থ প্রচুর ভূ - সম্পত্তির অধিকারী এবং তারা সকলেই এখনও ‘ ব্রাহ্মণ ' যতদূর মনে হয় যে সব 'আঢ‍্য’গণ পূর্ব - ভারতে আসেন , তাঁরা বৌদ্ধধর্মের ব্রাহ্মণ - বিরোধী অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে দেশ ছাড়া হয়েছিলেন। ‘আঢ‍্যরা' একে ব্রাহ্মণ তার ওপর ধনী। অতএব তাদের ওপর অত্যাচারের তাড়না বেশীই হয়েছিল। তাই বোধহয়, তাঁরা বৈশ্যরূপে পূর্ব্বভারতে অযোধ্যায় এসেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ যে ‘আঢ্য’ উপাধি একমাত্র বৈশ্যদেরই আছে। বস্তুত পক্ষে কুশল আঢ্য যে সময়ে অযোধ্যার রামগড়ে এসে বসতি স্থাপন করে সেটি ছিল বৌদ্ধ মনোভাবাপন্ন সম্রাট হর্ষবন্ধন এবং গৌড়রাজ শিবভক্ত শশাঙ্কের সংগ্রামের পরবর্তীকালে 'বল্লাল চরিত’ রচয়িতা আনন্দভট্ট এই বৌদ্ধ তাড়নার কথা স্পষ্ট করে স্বীকার করেছেন।

দশম শতকে কুশল আঢ্যের পুত্র সনৎ আঢ‍্য ও 'বৌদ্ধ বিপ্লবে কাতর' হয়ে অযোধ্যা ত্যাগ ক'রে আসেন বঙ্গদেশে । তাঁর আগমন সম্বন্ধে অযোধ্যা জানা যায় যে অযোধ‍্যা নিবাসী বহু লোক ছিল তাঁর পদাতিক 'আশোরার’ (অশ্বারোহী) বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। শতশত গাড়ী বোঝাই ধনরাশি সমেত কয়েকশত হাতীর পিঠে কার্ণাৎ - ঘেরা তাঁবু নিয়ে সনক আঢ্য যাত্রা করেন পূর্ববঙ্গে। এই সময় সনক আঢ‍্যের সঙ্গে ছিল তাঁর বরাটিকা নামী স্ত্রী, জ্ঞানচন্দ্র মিশ্র নামক কুলপুরোহিত এবং ১৬ ঘর প্রধান বৈশ্য যাদের উপাধি ছিল দে, দত্ত, চন্দ্র, আঢ্য , শীল , সিংহ , ধর, বড়াল , পাল , নাথ , মল্লিক , নন্দী , বর্ধণ , দাস , লাহা ও সেন। এ ছাড়া আরও অপ্রধান ৩০ ঘর বৈশ‍্য বাংলায় আসেন সেই সঙ্গে। মোট এই ৪৬ ঘর বৈশ্য সনক আঢ‍্যের নেতৃত্বে বাংলায় প্রথম আগমন করে। সনক আঢ্য ছিলেন খাঁটি হিন্দু এবং দান , ধর্ম - পরায়ণ উচ্চমমা হৃদয়বান ব্যক্তি। বাংলায় আগমনের পূর্বে পথে তিনি উক্ত বিরাট বাহিনী নিয়ে গোকুল, হরিদ্বার, বদ্রিকাশ্রম, বারাণসী, গয়া ইত্যাদি তীর্থ ভ্রমণ করেন এবং প্রতিটি - তীর্থক্ষেত্রের উন্নতিসাধনের জন্য অর্থ দান করেন।

চিত্র: একজন বৈশ্য সম্প্রদায়ের মানুষ। চিত্রশিল্পী- ফ্রাঁসোয়া বালথাজার সলভিনস। সাল ১৭৯৯

সদলবলে সনক আঢ‍্য যখন বাংলায় প্রথম এলেন তখন অন্বষ্ঠ জাতীয় আদিশূর ছিলেন শুদ্র বাংলার শাসনকৰ্ত্তা। আর আজও বিখ্যাত বিক্রমপুর বর্তমানে বাংলাদেশে ছিল তাঁর রাজধানী।

‘উত্তরিল পূর্ব্ববঙ্গে ধন অধিকারী,
 সনক কর্ণকদাতা বৈশ্য শুদ্ধাচারী।'

লক্ষণীয়, বংশের ব্রাহ্মণ হুলভ শুদ্ধাচারেই বৈশ্য শনক জীবনযাপন করেছেন। মহারাজ আদিশূরকে প্রচুর ধনসম্পদ, সম্মান এবং আনুগত্য নিবেদন করলে, রাজা সন্তুষ্ট চিত্তে সনককে নদী তীরে সুন্দর ভূমি দান করেন বসতি স্থাপন করে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য। এই জমি ছিল ব্রহ্মপুত্র নদীতটে। বর্তমানে পূর্ব্ববঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদী নেই। মনে হয় সে যুগে আদিশূরের বাংলা বলতে বর্তমান আসামের পশ্চিমাংশ তথা কামরূপ, ধুবড়ী জেলাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সব অঞ্চলের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র বাংলায় ‘পদ্মা’ নাম নিয়েছে। এই পদ্মার জলপথে ব্রহ্মপুত্রের উপরোক্ত সমতল অঞ্চলগুলি পর্যন্ত ব্যবসা - বাণিজ্য চলতো নদীপথে ব্রহ্মদেশ ও সেখানকার চৈনিক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এবং এই বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রভূত অর্থ উপার্জিত হতো সেখানকার ব্যবসায়ীদের হাতে । সম্রাট আদিশূর সনক আঢ্যকে ঐরকম একজন মহাজনী কারবারীরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন তাঁর রাজকোষে ধনাগম বৃদ্ধির জন্য এবং ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতির জন্য।

১৭২৬ সালে Jaques Andre Cobbe -এর আঁকা হুগলীর মানচিত্রের অংশবিশেষ

সম্রাট প্রদত্ত জমির ওপর সনক আঢ‍্য নিজ ব‍্যায়ে ছেচল্লিশটি বাড়ি নির্মাণ করান । চতুর্দিকে প্রাচীর বেষ্টনী এবং গড়খাই তৈরী করে এক সুরক্ষিত ও সুন্দর নগর বসান । মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত মঙ্গল - কাব‍্যগুলিতে মাঝে মাঝে 'বেণে নগর বসান' — এইরকম যে উল্লেখ আছে, তার প্রথম সূত্রপাত সনকের নগর বসানো থেকে। তাছাড়া বর্তমানে সুবর্ণ বণিক সমাজে তীর্থ ভ্রমণের জন‍্য একটি অতিরিক্ত ইচ্ছা - প্রাবল্য যে লক্ষানীয় , তারও সূত্রপাত সনকের পূর্বোক্ত তীর্থ ভ্রমণ থেকেই। যাইহোক, সনকের নগরে বহু লোকজন আর দোকান - পসারী বসে নগর গমগম করতে থাকে লোকের মুখে প্রচার হলো যে রাজধানী বিক্রম পুরের চেয়ে এই নতুন নগর আরো ভালো ইত্যাদি। বলাবাহুল্য, ৪৬ খানি ঐ নব - নির্মিত বাড়িতে মোট ৪৬ ঘর বৈশ্যের পুণর্বাসন করা হয় সনক আঢ‍্যের উদ্যোগে। তাহলে একথা বললে ভুল হবে না যে আজকের সূর্বণ বণিকরা আদিতে 'পূর্ববঙ্গবাসী বাঙাল ছিল'। নগরের বাণিজ্যের রমরমার

‘চীন , মগ , ভোগ আর যত সব বেণে
রজত কাঞ্চন তারা সকলেতে কেনে ।।'

'ভোগ' কথাটি বোধহয় মুদ্রণ প্রমাদ বশত ‘ভোট’
কথাটির বদলের বসেছে। বর্তমানে ভুটানের প্রাচীন ধনীগণ এবং আসামের প্রাচীন জোট রাজবংশদেরই বোঝানো হয়েছে । মহারাজ আদিশূর সনক আঢ‍্যের এইরূপ কীর্তিকলাপে সন্তুষ্ট হয়ে নগরের নাম রাখেন “ স্বর্ণগ্রাম” , পরে লোকমুখে সুবর্ণ গ্রামে পরিণত হলো । মহারাজ সনক এবং তাঁর স্বজাতিগণকে 'সুবর্ণ বণিক' নামে আখ‍্যাত করে রাজা আদিশূর প্রকাশ্য তাম্রফলক প্রদান করেন, আর এই নাম আজও চলে আসছে । শেষ পর্যন্ত সনক আঢ্য হলেন ‘আদিশূরের প্রিয় সখ্য মন্ত্রী শুদ্ধমতি'।

চিত্র: মুদ্রা বিনিময়কারী সুবর্ণ বণিক, চিত্রশিল্পী- ফ্রাঁসোয়া বালথাজার সলভিনস। সাল ১৭৯৯

আদিশূরের কোন সন্তানাদি ছিল না। বন্ধু সনকের পরামর্শক্রমে তিনি পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেন। সে যুগে বঙ্গের ব্রাহ্মণ - কুল বেশী ছিল না এবং খুব আস্থাভাজনও ছিল না তাই শ্রেষ্ঠ কয়েকজন ব্রাহ্মণই মহারাজকে পরামর্শ দেন।

যে বঙ্গেতে নাহিক কেহ যে করাবে যজ্ঞ। 
এ বিষয়ে বঙ্গদেশে সব দ্বিজ অজ্ঞ। 

সনক আঢ‍্যের জানা ছিল তার পূর্বপুরুষদের ‘দেশ’ অযোধ্যা এবং কান‍্যকুব্জের কথা। তাঁরই পরামর্শে সম্রাট আদিশূর কান‍্যকুব্জের রাজার আনুকুল্যে বঙ্গে আনালেন সেই প্রথম সাগ্নিক ও বেদজ্ঞ পঞ্চ ব্রাহ্মণ এবং তাঁদের দাস রূপে পঞ্চ কায়স্থ এবং আদিশূরের অনুরোধেই তাঁরা এখানে বসবাস শুরু করেন। ব্রহ্মপুত্র নদীতীরে অনুষ্ঠিত পুত্রেষ্টি যজ্ঞে প্রত্যেক ব্ৰাহ্মণকে হীরা - মুক্তা - প্রবাল ও ৫০০ স্বর্ণমুদ্রা দান করেন এবং অন‍্যান‍্যদেরও প্রচুর অর্থ দেন এবং খাদ‍্যদ্রব‍্যে আপ‍্যায়ণ করেন। সনক আঢ‍্যে দলভুক্ত হয়ে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ উপলক্ষ্যে যারা 'বঙ্গে' আগমন করেন তাদের অনেকে আজ বঙ্গদেশ ছাড়া। আসাম দেশেরও অন্তর্ভুক্ত হয়ে , আছেন। ধুবড়ী, জলপাইগুড়ি অঞ্চলে ‘বর্ধন' উপাধিকারী সুবৰ্ণ বণিকদের আধিক্য লক্ষনীয়। ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে 'মল্লিক’ পদবী মুসলমান শাসকদের দান সে কথা সত্য হতে পারে; তবে বঙ্গে মুসলমানদের অনেক আগেই যে ‘মল্লিক’ উপাধি প্রচলিত ছিল এবং সনক আঢ‍্যের দলভুক্ত হয়ে এদেশে প্রথম এসেছিল সে সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ রইল না যতদূর মনে হয় দশম শতকের মধ্যভাগেই এই ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। স্বৰ্ণগ্ৰামের অবশ্য এখন আর খোঁজ খবর কিছু পাওয়া যায় না ; মনে হয় ব্রহ্মপুত্রের পরিবর্ত্তনশীল গতিপথে স্রোতধারায় তার অবলুপ্তি ঘটেছে। পুত্র্যেষ্টি যজ্ঞের পুণ্যের ফলে আদিশূরের যে সন্তান হয়, তার নাম বল্লাল সেন। একশত বৎসর পূর্বে ১৮৮৯-৯০ সালে একখানি বাংলা কাব্য পুস্তক প্রকাশিত হয়েছিল। তার নাম ‘সাধু - রঞ্জন সংহিতা আদিশূর বল্লাল উপাখ্যান।' ৫৬ পৃষ্ঠার সমাপ্ত বইখানির লেখক ছিলেন হুগলী ঘুঁটিয়া বাজার নিবাসী সুবৰ্ণ বণিক কুলোদ্ভব শ্রীমধুসূদন মল্লিক মহাশয়। আনন্দ ভট্ট রচিত 'বল্লাল চরিত’কে কেন্দ্র করে উক্ত পুস্তক রচিত। সেখানে উপরিউক্ত ঘটনাবলীর পরিচয় পাওয়া যায়। তারও ৫ বছর আগে এই বিষয়ে আর একখানি বহু মূল্যবান তথ্য সঙ্কলিত পুস্তক রচনা করেছিলেন চুঁচুড়া শহরের শ্রী যাদবচন্দ্র শীলের পুত্র শ্রী নিমাইচাঁদ শীল মহাশয় (বড় শীলের বাড়ী)। তাঁর লেখা ৬ খানি গ্রন্থের মধ্যে ১৮০ পৃষ্ঠার ‘সুবর্ণ বণিক’ নামক গ্রন্থেও উপরোক্ত ঘটনাবলীর কিছু কিছু উল্লেখ পাওয়া যায়। ইনি ছিলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের সহপাঠি। 

গবেষণা এবং স্বত্বাধিকার: প্রলিপ্ত টিম