Ghetu puja: গ্ৰামবাংলার লুপ্তপ্রায় উৎসব ঘেঁটুপূজা ও ঘেঁটুগানের মাহাত্ম্য - Pralipta

কোয়েল সাহা : বাংলায় সকল নিত্য নৈমিত্তিক পূজার্চনার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে কিছু গ্ৰামবাংলার সংস্কৃতি। সেই সব পূজা এবং তার লোকগান আজও স্মৃতিময় ও দুষ্প্রাপ্য। আসুন জেনে নিই গ্ৰাম বাংলার লুপ্তপ্রায় লৌকিক অলৌকিক পূজার কাহিনী।

ঘেঁটুপূজা হল বাংলার এক অন্যতম লৌকিক দেবতা ঘেঁটুঠাকুরের উদ্দেশ্যে বাৎসরিক পূজা ও উৎসব। বাংলার লোকসংস্কৃতিতে বসন্ত ঋতুতে আবির্ভূত ছোঁয়াচে চর্মরোগের (খোস-পাঁচড়া) নিবারণের জন্য ফাল্গুন মাসের সংক্রান্তিতে ঘেঁটুর পূজার্চনা করা হয়। 
 
আবার অনেকে মনে করেন ঘেঁটু হল বাংলার জনসমাজের কল্পিত অলৌকিক দেবতা ,ইনি মহাদেবের অনুচর ।মঙ্গল দেবতা বিষ্ণুর বিপরীতে এই কাল্পনিক বিদ্বেষী দেবতার অবস্থান, অনেকটা কার্তিকী অমাবস্যায় অনুষ্ঠিত অলক্ষ্মীপূজার মত। শোনা যায় ঘাঁটু সূর্য ও ধর্মঠাকুরের লৌকিক রূপ। কারণ, সূর্য ও ধর্মঠাকুর দুজনই কুষ্ঠ ও নানারকম চর্মরোগ থেকে মুক্তি দেন।পূজার অন্যতম উপকরণ ঘেঁটু ফুল (ভাট ফুল) থেকে দেবতার এরূপ নাম হয়ে থাকতে পারে। ঘেটু ফুলের বাইরের রং সাদা ও ভিতরের রং গোলাপী।


                                                      (ছবি ইন্টারনেট থেকে গৃহীত)


ঔষধি :

বসন্ত কালে কয়েকদিন কচি ঘেটু পাতার তিতো রস সেবন ও পাতা বেটে তার হলুদের সঙ্গে মিলিয়ে গায়ে মাখা - এটাই হল বঙ্গদেশের লোকৌষধ। এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদী জ্বর, গেটেবাত, আমাশয় ও পেট ব্যথায় ভাঁটের কচি ডগার রস কয়েক দিন সকালে খেলে রোগ ভালো হয়ে যায়। ভাঁটপাতার রস কৃমিনাশক। এর পাতা অ্যাজমা, টিউমার, সাপের কামড় ও চর্ম রোগে ব্যবহার হয়। মূলের নির্যাস দাঁতের ক্ষয়রোগ, পেটব্যথা, ও হিস্টিরিয়ার উপশম করে।


পূজার আয়োজন : 

এই পূজার জন্য আলাদা করে পুরোহিতের দরকার হয় না, গৃহস্থ পুরুষ-মহিলারাই করতে পারে। দিনের বেলায় গ্ৰাম্য পথের ধারে অথবা জলাশয়ের পাড়ে ভাঙ্গা হাঁড়ি উল্টে তার ওপর গোবরের মণ্ড করে নির্মিত হয় দেবতার মুখ ,তাতে সিঁদুরের টিপ দেওয়া হয় আর কড়ি দিয়ে চক্ষু দান করা হয়। গায়ে হলুদ ছোপের এক টুকরো কাপড়।পূজার উপকরণ ঘেটুফুল, দূর্বা ঘাস, সামান্য বাতাসা। আর ভাঙাহাড়ির ভেতর জ্বালানো হয় মোমবাতি। খুব ভোরে অর্ঘ্য দেন কোন এক নারী।এলোমেলো চুলে থাকা ওই নারীর হাতে থাকা মাটির পাত্রে রাখা হয় সেদ্ধ চাল, মসুরের ডাল। কোন এলাকায় চাল আর গুড় দেয়া হয়।পূজা পায় চৈত্র মাসের শেষ দিন। পূজা শেষ হলে ছোট ছেলেমেয়েরা লাঠি দিয়ে ঘাঁটুর আসন মানে মাটির হাড়িটা ভেঙে দেয়। এরপর গোবরের টুকরো আর কড়ি বাড়ির চৌকাঠের ওপর রেখে দেয়া হয়। এর মানে এই পরিবারে এবার কারো চর্ম রোগ হবে না। পূজা শেষ হয়ে গেলে শিশুর দল কলার মান্দাসে তৈরি করে পাল্কি।তা কাঁধে নিয়ে তারা গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়।গান শুনে বাড়ির কর্তা ছেলেদের চাল দেয়। কেউ দেয় চাল ডাল দুটোই। তারা রাতে সংগ্ৰহ করা চাল ডাল নিয়ে খিচুড়ি বানিয়ে ভোজন করে।


                                                            (ছবি ইন্টারনেট থেকে গৃহীত)


ঘেঁটুগান :

"ঘেটু যায় ঘেটু যায় গৃহস্থের বাড়ি এক কাঠা চাল দাও কুমড়োর বড়ি ।
যে দেবে থালা থালা তার হবে কোঠা বালা ,যে দেবে মুঠো মুঠো তার হবে হাত ঠুটো।
যে দেবে এক পলা তেল তার হবে সোনার দেল।
যে দেবে শুধু বকুনি ঘেটু দেবে খোসচুলকানি।"

বছরের নির্দিষ্ট সময়ে গ্রামের গরিব পরিবারের ছেলেদের যাদের গলায় গান তাদের নিয়ে ঘেঁটুগানের দল গঠন করে। এরপর দলের ছেলেদের নাচ শেখানো শুরু হয়।এই দলে যারা স্থান পায় তাদের বলে ঘাটু।
এও দেখা যায় দলপতি টাকার বিনিময়ে ঘাটু বালকদের নিয়োগ দেন।
ঘেঁটুগান একসময় মেয়েরা করতো। পরে বালকরা মেয়ে সেজে এই নৃত্যগীত করে।
বর্ষা ও শরৎকালে ঘেঁটুগানের চল বেশি। এই সময় বর্ষার পনিতে চারদিক থইথই করে। হাওড়-বাওড়ের যে দিকে চোখ যায় পানি আর পানি। মাঠে ফসল থাকে না। চাপ থাকে না কাজের। এরকম অলস দিনে নৌকার পাটাতনের ওপর আসর বসে। 
তবে এখনকার গানের কথা অন্যরকম।

‘আমি উড়িয়া বেড়াই দুনিয়ার মাঝে
মনের মানুষ পাইলাম না।’
গানের সুরে কথায় মনের মানুষ খুঁজে বেড়ায় ঘেঁটু গানের বালকেরা।
পায় কি মনের মানুষ?
প্রাণের আকুতি ফুটে ওঠে গানের কথা আর সুরে।
‘আমার দুঃখের কথা কারে জানাই, লো সই
যাইতে যমুনার ঘাটে, ওলো সই, আমি তোরে
দুঃখের কথা শুনাই।
চোখের জলে ভইরাছে আমার কাঙ্খের কলসি, লো সই
কোনখানে যে বাজে বাঁশি, শুইনা হয় মন উদাসী
ঘরে যাইতে, বারেবারে পথ ভুইলা যাই
দুঃখের কথা কারে জানাই,ওলো সই।’
এই নৌকা ভেসে বেড়ায় গ্রাম থেকে গ্রামে।
শিল্পীরা নৌকার ওপর গান করতেন। দর্শকেরা নদীর পারে দাঁড়িয়ে শোনে ঘেঁটুগান।
গানের দুটি অংশ। প্রথম অংশে বালক ঘাটু একক সংগীত পরিবেশন করত। অন্যটি ঘেঁটু দলের শিল্পীরা একসাথে গান করে। ওই সময় গানের তালে তালে নাচে ঘাটু বালক। পরনে থাকে নারীর পোশাক। মাথায় লম্বা চুলের বেণী। গলায়, কানে, হাতে অলংকার।


                                                         (ছবি ইন্টারনেট থেকে গৃহীত)


ঘাঁটু গানের বিষয়বস্তু : 

ষোড়শ শতকের শেষের দিকে ঘাটু গানের প্রচলন হয় বলে মনে করা হয়। ঘেটু গান মূলত রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক।শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শুনতে পেয়ে রাধা যখন যমুনার জল আনতে গেলেন, তখন তিনি জলের মধ্যে কৃষ্ণের মুখচ্ছবি দেখতে পান।কৃষ্ণ তখন কদমডালে। বাঁশিতে সুর তুলেছেন।

ফাল্গুন সংক্রান্তির দিন দুই বর্ধমান, বাঁকুড়া, দুই ২৪ পরগনা , ত্রিপুরা এছাড়াও বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে ঘেঁটু বা ঘণ্টাকর্ণ পুজোর রীতি প্রচলিত রয়েছে। হারমোনিয়াম,খোল করতাল বাঁশি সহযোগে ছড়াগান ,সব মিলিয়ে ঘেঁটু পূজোকে উপলক্ষে রীতিমতো বিনোদনের আবহ তৈরি হত গ্রামবাংলায়। এই ঘেঁটুকে লোকসংস্কৃতি গবেষক গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু ‘আর্যেতর সমাজ থেকে উদ্ভুত অপ্রধান লৌকিক দেবতা’ বলে অভিহিত করেছেন।


                                                          (ছবি ইন্টারনেট থেকে গৃহীত)



প্রচলিত কাহিনী :

প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, ঘেঁটু হলেন এক জন অভিশপ্ত দেবতা। তিনি কোনও একটি কুকর্মের জন্য ভগবান বিষ্ণুর রোষানলে পড়েন এবং দেবলোক থেকে নির্বাসিত হয়ে পিশাচকুলে জন্মগ্রহণ করেন। আজীবন এই অভিশাপের বোঝা বয়ে বেড়ানোর জন্য তিনি ঘোরতর বিষ্ণুবিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। এমনকি, বিষ্ণুর নাম পর্যন্ত যাতে শুনতে না হয়, সে জন্য তিনি কানে ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখতেন। সেই থেকেই ঘেঁটুর অপর নাম হয় ‘ঘণ্টাকর্ণ’। মনে করা হয় সংস্কৃত শব্দ ঘন্টাকর্ণ থেকে ঘেটু শব্দের উৎপত্তি।
এছাড়াও কথিত আছে ঘণ্টেশ্বর কোন কারণে অভিশপ্ত হয়ে উজ্জয়িনী নগরে মানুষরূপে জন্ম নেন । সেই সময় উজ্জয়িনীর রাজা ছিলেন বিক্রমাদিত্য । তাঁর রাজসভা অলংকৃত করতেন নয়জন মহাপণ্ডিত । এই নয় জনকে পরাজিত করে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসাবে প্রতিপন্ন করার জন্য ঘণ্টাকর্ণ শিবের আরাধনা শুরু করেন । সন্তুষ্ট হয়ে শিব বর দিতে গেলে ঘণ্টাকর্ণ চাইলেন তিনি যেন নবরত্ন সভার সর্বশেষ্ঠ পণ্ডিত রূপে পরিগণিত হন । শিব এই বর দিতে চাইলেন না , কারণ অন্য পণ্ডিতদের নিয়ে কোনও ভাবনা না থাকলেও শিব চিন্তিত ছিলেন কালিদাসকে নিয়ে । কালিদাস ছিলেন সরস্বতীর বরপুত্র । তাই ঘণ্টাকর্ণর প্রার্থিত বর দিয়ে শিব নিজ কন্যার বিরাগভাজন হতে চাইলেন না । এদিকে ঘণ্টাকর্ণ নিজের চাহিদায় অটল থাকলেন । বারংবার কালিদাসকে পরাজিত করার বর চেয়েও না পেয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে শপথ নিলেন আর কোনদিন শিবের নাম নেবেন না । এই মনোভাব নিয়ে ঘন্টাকর্ণ চললেন নবরত্ন সভার পণ্ডিতদের পরাজিত করতে । একে একে সকলকে পরাজিত করে উপস্থিত হলেন কালিদাস সকাশে । কালিদাস জানতেন ঘন্টাকর্ণ শিবের নাম নেবেন না , তাই তাকে বললেন তিনি যদি দীর্ঘছন্দে শিবের স্তব করেন তবেই কালিদাস তাঁর সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন । সকলকে বিস্মিত করে ঘন্টাকর্ণ একবারও মহাদেবের নাম না নিয়ে শিব বন্দনা করলেন দীর্ঘছন্দে । এই জন্য ঘন্টাকর্ণের আর এক নাম হয় মহাবীর ঘণ্টেশ্বর । ঘন্টাকর্ণ এবার তাঁর শাপমুক্তির প্রার্থনায় উপস্থিত হলেন বদরিকা আশ্রমে শিবদুর্গার কাছে । সেই সময় বিষ্ণুও উপস্থিত ছিলেন সেখানে । ঘন্টাকর্ণের মনোবাঞ্ছা জেনে শিব তাকে মুক্তির জন্য বিষ্ণুর আরাধনা করতে বলেন । শিবের আদেশ মতো ঘন্টাকর্ণ বদরিকা আশ্রমে উপনীত শ্রীকৃষ্ণরূপী বিষ্ণুর স্তব করেন । এতে খুশি হয়ে বিষ্ণু আশীর্বাদ করে বলেন চৈত্র সংক্রান্তিতে ঘাঁটু বা ঘন্টাকর্ণের বা ঘাঁটু কুমারীর পুজো করলে সর্বপ্রকার চর্ম রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে ।

এই প্রাচীন ধর্মীয় সংস্কৃতির লৌকিক আচারে আজও বিশ্বাসী গ্ৰাম বাংলার মানুষ।।