কোয়েল সাহা : রহস্যঘেরা পৃথিবীতে এমনও অনেকস্থান রয়েছে যাকে ভাষায় সম্পূর্ণ প্রকাশ করা কখনোই সম্ভব নয়।পৃথিবীর এককোনে পড়ে থাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ আফ্রিকা হল তেমনি একটি স্থান। এই আফ্রিকা মহাদেশে এমন অনেক দুর্গম অঞ্চল রয়েছে যেখানে উন্নত সভ্যতার বিকাশের আলো এসে পৌঁছায়নি। আফ্রিকা মহাদেশ নিয়ে আমাদের মতো কৌতুহলী মানুষের জানার শেষ নেই। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমনও অনেক অজানা জনগোষ্ঠী আছে যাদের নিজেদের কোন রাষ্ট্র নেই অথচ তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এবং নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দিয়ে তারা তাদের সমাজব্যবস্থাকে বৈচিত্র্যময় করে তোলে। এমনিই একটি বিশ্বের অবশিষ্ট উপজাতি হাডজার কথা আজ আলোচনার বিষয়বস্তু। কী এই হাডজা উপজাতি তারা কী মাসাই গোষ্ঠীর অন্তর্গত, তাদের জীবনযাত্রা কেমন ধরনের এরকম অজানা প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে প্রবেশ করতে হয় রহস্যময় তানজানিয়ার অন্দরমহলে।
ঐতিহ্যবাহী শিকারী সংগ্ৰাহক উপজাতি হল হাডজা। এরা উত্তর তানজানিয়ায় বসবাসকারী যাযাবর ও শিকারি সংগ্ৰাহক আদিবাসী সম্প্রদায়। তবে এরা মাসাই উপজাতির অন্তভূর্ক্ত নয়,এদের জন্মভূমি সেরেঙ্গেটি সমভূমির প্রান্তে, নোগোরোঙ্গোরো ক্রেটারের ছায়ায় অবস্থিত। সেরেঙ্গেটি হল এক অনন্য বাস্তুতন্ত্র সহ আফ্রিকার একটি জনহীন স্থান, যা বিশ্বের সবচেয়ে এক প্রাচীনতম স্থান। তবে জমি মালিকানার ক্ষেত্রে অনান্য উপজাতিদের মতো হাডজাদেরও কোন মালিকানার দাবিদাওয়া ছিল না। তবে তারা নিজেদের শিকারের ও বসবাসস্থলকে নিজেদের স্থান বলে দাবি করে। হাডজা গোষ্ঠীর জন্ম কবে কীভাবে হল তার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না, তবে আদিবাসীদের জিনগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অনুমান করা হয় তারা ৫০০০০ থেকে ৭০০০০ বছর আগে বংশ বিস্তার করেছিল।
প্রায় ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত, তানজানিয়া একচেটিয়াভাবে হাডজার অনুরূপ শিকারী-সংগ্রাহকদের দখলে ছিল। আনুমানিক ১০০০ জন ব্যক্তি আছেন যারা হাদজা হিসাবে আত্ম-পরিচয় দিয়েছেন। আনুমানিক ৩০০ জন যাযাবর সম্প্রদায় এর মধ্যে অন্তভূর্ক্ত এবং জীবিকা নির্বাহ করে শিকার করে, অবশিষ্ট ৭০০জন ব্যক্তি গ্রামের কাছাকাছি অবস্থিত আধা-বসতিপূর্ণ হাডজা শিবিরে বসবাস করে ও কৃষিকাজ ও পশুপালনের মাধ্যমে দিনপাত করে।
এই উপজাতির কোন লিখিত ভাষা নেই, হাডজার ভাষা, যাকে হাডজান বলা হয়, তিনটি ভাষা পরিবারের প্রায় ত্রিশটি ভাষাতে ক্লিক ব্যঞ্জনবর্ণ রয়েছে। এই দুটি ভাষা ছাড়া বাকি সবকটি ভাষাতে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষজন কথা বলে থাকে। অন্য দুটি ভাষা হল সান্দাওয়ে এবং হাদজা, এই দুটি ভাষাকে নিজস্ব ভাষা পরিবার হিসাবে মনোনীত করা হয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে, এই ভাষাগুলিকে খোইসান ভাষা হিসাবে গোষ্ঠীভুক্ত করা হয়েছে, এটি এমন একটি বিভাগ যেখানে সমস্ত বিদ্যমান আফ্রিকান ক্লিক ভাষাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে হাদজা লেক্সিস এবং ব্যাকরণগত কাঠামোর বিশ্লেষণে প্রকাশ করা হয়েছে যে এটি অন্য কোনো ক্লিক ভাষার সাথে সম্পর্কিত নয়।অধিকাংশ হাদজা তাদের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে সোয়াহিলিতে কথা বলে।
হাডজা ভাষার সমস্ত বিশেষ্য লিঙ্গযুক্ত, একবচন এবং বহুবচন। হাদজা একটি একবচন পুরুষবাচক বিশেষ্য, যা মূল হিসেবেও কাজ করে।হ্যাডজানে ক্লিক ব্যঞ্জনবর্ণের তিনটি রূপ রয়েছে: ডেন্টাল, অ্যালভিওপ্যাটাল এবং পার্শ্বরীয়। বিপন্ন আফ্রিকান ভাষাগুলির মধ্যে হাডজাকে তুলনামূলকভাবে প্রাচীন ভাষা বলে মনে করা হয়।
হাডজার জীবনে পরিবার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুরা প্রাথমিকভাবে তাদের পিতামাতা এবং ভাইবোনদের সাথে থাকে তবে প্রায়শই দাদা-দাদি বা খালা এবং চাচাদের সাথে থাকতে পারে। শিশুরা বড় বয়স না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের বয়সী সঙ্গীদের সাথে একটি কুঁড়েঘরে ঘুমাতে পারে। তারপর তারা ওই ঘরে বিবাহিত জীবনের পূর্ব অবধি সব ভাইবোন মিলে একসাথে বসবাস করে। এরা পরিবারে বয়ঃজ্যেষ্ঠ ব্যাক্তিকে কোনো সম্মান দেয় না। কিছু হাদজা নিওলোকাল, তারা স্বামী বা স্ত্রীর কোনো আত্মীয় ছাড়াই ক্যাম্পে বসবাস করতে পছন্দ করে। শিশুদের একটাই কাজ দলবেঁধে খাবার কুড়ানো আর খেলা করা।তবে এই সম্প্রদায়ের মধ্যে শিশুদের মধ্যে পড়াশোনার চল একদমই নেই, তারা তাদের সন্তানদের ইস্কুলে যেতে দেয় না, কারন তারা মনে করে বিদ্যালয়ে যাওয়ার থেকে হাতে হাত মিলিয়ে ঘরের কাজ করা বেশি জরুরি। তবে অনান্য সমাজের তুলনায় এই উপজাতির পিতারা শিশুদের প্রতি অত্যাধিক যত্নবান।
যেহেতু এরা যাযাবর প্রকৃতির তাই তারা একস্থানে বেশিদিন থাকে না, তারা খুব পরিশ্রমী হয়, তারা সকালে খাদ্যের সন্ধানে বেড়িয়ে যায় আর রাতে বাড়ি ফিরে খাবারের পর একসাথে বসে পরিবারের অন্যান্য মানুষদের সাথে গল্প করে।
হাদজা সমাজব্যবস্থায় সবক্ষেত্রেই নারীদের কথাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং তারা সবক্ষেত্রে পুরুষদের সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।
হাদজাকে এমন একটি জনসংখ্যা হিসাবে বর্ণনা করা হয় যাদের কোন প্রতিষ্ঠিত ধর্ম নেই। এই সম্প্রদায়ে ওঝা বা গুনিন নেই এরা পরলোকে বিশ্বাস করে না, তারা শুধু মনে করে সূর্য সব কিছু সৃষ্টির মূলে আছে। তাই তারা শিকারে বেরোনোর আগে ইশোকোর (সূর্য) কাছে প্রার্থনা করে যাতে তারা শিকার সংগ্ৰহে সফল হতে পারে। তারা অনেক সময় মনে করে থাকে তাদের উৎপত্তি বাওবাব গাছ থেকে বা জিরাফের ঘাড় থেকে, তবে কতটা সঠিক তা গবেষকরা এখনও বলতে পারেনি।
হাদজারা অত্যন্ত মৌসুমী পরিবেশে বাস করে, শুকনো মৌসুমে তারা বাইরে থাকে এবং বর্ষাকালে গাছের ডাল ও শুকনো ঘাস দিয়ে কুঁড়েঘর তৈরি করে। বাইরে বসবাস করার পাশাপাশি, তারা কম জনসংখ্যার ঘনত্বেও বাস করে। তাদের খাদ্যের অন্তভূর্ক্ত আছে বেবুন, জিরাফ, নেউল, ইঁদুর। তারা মাটির নীচের শিকড় পোড়া খায়। তাদের সবচেয়ে পছন্দের খাবার হল মাংস ও মধু। তাদের খাদ্য, যা অত্যন্ত সুষম, এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদজাত খাবার (যেমন কন্দ, বেরি, ফল, লেবু, বাদাম এবং বীজ)। তারা ভুট্টার দানা দিয়ে দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের মতো জিনিস তৈরি করে, তার মধ্যে মধু ব্যবহার করে, তারা গাঁজার নেশায় আসক্ত। তারা স্বাস্থ্যবান নারী পুরুষ, তাদের শরীরে প্রচুর শক্তি, তাদের বিশেষ কোন রোগ নেই বললেই চলে,হাডজারা অপুষ্টিতে ভোগে না এবং প্রকৃতপক্ষে প্রতিবেশী উপজাতিদের চেয়ে তারা স্বাস্থ্যকর। অনুমান করা হয় এদের আয়ু ৭০-৮০ বছর, তারা নিজেদেরকে নিয়ে সচেতন নয়। তাদের গড় আয়ু বলা মুশকিল। একটি নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে যে হাদজা পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্মের সময় গড় আয়ু ৩৩। ২০ বছর বয়সে আয়ু ছিল ৩৯ এবং শিশুমৃত্যুর হার ছিল ২১%।
এই উপজাতির মধ্যে বিয়ের রীতিনীতি তেমনভাবে নেই বললেই চলে। মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৭-১৮ বছর, আর ছেলেদের বয়স ২০-২১ বছর নির্ধারন করা হত। অবশ্য তার আগে এদের নিজের সঙ্গী পছন্দ করার অধিকার আছে। প্রথম বিয়ের পর বিবাহিত জীবনে যখন এদের ভাঙন ধরে তখন এরা নতুন জীবনসঙ্গী খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।বিয়ে করার জন্য কোন আচার অনুষ্ঠানের দরকার নেই, শুধু ভালোবাসার মানুষের সাথে একসাথে থাকলেই হলো, তবে সেক্ষেত্রে মা-বাবার অনুমতি নিতে হয়। হাডজাদের শিকারের পদ্ধতি অন্যরকম তারা প্রথমে তীরের গায়ে বিষ মাখিয়ে রাখে, এবং সেই তীর ছুড়ে দেয় তাদের শিকারের উপর, তার ফলে সেই পশুটির মৃত্যু হয়। তবে তারা সিংহ ও গন্ডার শিকারে ভয় পায়। তাদের সম্প্রদায়ের কেউ মারা গেলে মৃতদেহকে কবর দেয় নয়তো পাহাড়ে রেখে দিয়ে আসে।
অবাক হওয়ার বিষয় হল এই হাদজার একটি বৃহত্তর অংশ নিজেদেরকে বৃদ্ধ মনে করে।মহিলাদের উর্বরতার সময়কাল কম থাকে এবং প্রজননের জন্য জৈবিক খরচ বেশি হয়। মহিলাদের মধ্যে পুরুষদের তুলনায় দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার একটি ক্রস-প্রজাতির প্রবণতা রয়েছে।নারীরাও নিজেদেরকে পুরুষদের তুলনায় বেশি বুড়ো বলে মনে করে। আধুনিক যুগে তারা নিজেরাই যেন পর্যটন শিল্পে পরিনত হয়েছে, তাদের এই বৈচিত্র্যময় রূপ ও সংস্কৃতি দেখার জন্য বহু পর্যটক ভিড় করছে তানজানিয়ায়, তারা তাদের সংস্কৃতির গান নাচ করে পর্যটকদের মনোরঞ্জন করে।
সত্যি বলতে হাডজা উপজাতি প্রকৃতিকে নিজের সন্তানসম মনে করে। তারা নিজেদের ভালবাসা দিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশকে সুরক্ষিত ও সংরক্ষণ করে রেখেছে বাইরের লোভী লালসাময় জগতের হাতছানি থেকে। পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য এই উপজাতিকে রাষ্ট্রপুঞ্জ তিনলক্ষ আমেরিকান ডলার দিয়েছে। এই টাকা দিয়ে সেদেশের সরকার এই উপজাতির উদ্দেশ্যে স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র বানাতে চায়। বাইরের সভ্যজাতি এই শিকারি জাতিকে সভ্য ও আধুনিক বানানোর চেষ্টায় মত্ত। গবেষণায় দেখা গেছে পূর্ববর্তী দশকগুলিতে, বহিরাগতদের দ্বারা হাডজা মহিলাদের ধর্ষণ বা বন্দী করা সাধারণ ছিল বলে মনে করা হত। পর্যটনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং একশ্রেণীর মানুষের অত্যাচার তাদের ঐতিহ্যগত জীবনধারায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।
তাহলে কী এসব কারনেই অদূর ভবিষ্যতে এই শিকারী বিলুপ্তপ্রায় উপজাতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে চলেছে?
...
তথ্যসূত্র ও ছবি: ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত