কোয়েল সাহা: বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্র্যময়তা আজ নতুন নয়, দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে খাদ্য সংস্কৃতির বিবর্তন। মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অন্যতম অঙ্গ হল মুড়ি।এটি বাঙালির পাঁচ বেলার খাবার আবার একে দরিদ্রশ্রেনীর প্রতিদিনের খাদ্য আর স্বচ্ছলদের শখের খাবারও বলা যেতে পারে।
চপ, বেগুনির,সঙ্গে মুচমুচে মুড়ি— এ যেন এক অনন্য যুগলবন্দী।সকালবেলায় দুধ দিয়ে, বিকেলে বা সন্ধ্যার আড্ডায় তেল মুড়ি মাখা যখন ঘরে খাওয়ার কিছু নেই, এক বাটি ডালের সঙ্গে, এমনকি সকালে পান্তা ভাতে টান পড়লে তখন তাতে মুচমুচে মুড়ি খাওয়া অথবা চায়ের কাপেও মুড়ি ফেলে খাওয়ার চল এখনও রয়েছে বহু পরিবারে। কৈশোরে স্কুল ছুটির সময়ে ঝালমুড়ির খাওয়া কারোরই অজানা নয়। কিন্তু জানেন কী মুড়ির আসল ইতিহাস কিংবা মুড়ির গুণাগুণ কিংবা এর তৈরির পদ্ধতি? জেনে নিন -
ভারতের ইতিহাস পর্বে মৌর্য যুগেরও বেশ কয়েক বছর আগে মগধের উত্থানপর্ব থেকে মুড়ির প্রচলন হয়েছিলো। বৈদিক যুগে দেবতাদের নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হত চাল ভাজা যা হল মুড়ির আদি রূপ।খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৩০০ অব্দেও ভারতীয় উপমহাদেশে মুড়ি তৈরি হতো, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সেই সময়ে একে বলা হতো মিসিতা বা ধানিধাকা।দাক্ষিণাত্যে মুড়ির প্রচলিত নাম হল পোলিং।ধারণা করা হয় হিব্রু সভ্যতার সাথে মুড়ির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে।হিব্রু ভাষায় মুড়িকে পিপুজে ওরেজ (pitzputzey orez) বলা হয়।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিষ্ণুপুর ২ নম্বর ব্লকের অন্তর্গত একটি গ্রাম , নাম বড়গগনগোহালিয়া । নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গ্রামটি আয়তনেও বড় এবং লোকসংখ্যাও বেশী । বর্তমান লোকসংখ্যা আনুমানিক ৮ হাজারেরও কিছু বেশী । পাশাপাশি দুটি গ্রাম ছোটগগনগোহালিয়া এবং কদম্বতলাতেও মুড়ি উৎপাদন হয় কিন্তু বড়গগনগোহালিয়া গ্রামটি মুড়ি উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র । এই গ্রামের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ মুড়ি শিল্পের সাথে যুক্ত থেকে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করেন । মুড়ি তৈরীর জন্য যে সমস্ত কাঁচামাল লাগে তা হল- ধান , চাল , লবণ , ইউরিয়া সার , জল , বালি , বড় সাইজের লোহার কড়াই , বড় ধরণের মাটির পাত্র যা ‘ খোলা ' নামে পরিচিত , নারকেল পাতার কাঠি থেকে তৈরী বিশেষ ধরণের জিনিস যাকে বলা হয় কুঁচি । এছাড়া জ্বালানির জন্য লাগে কাঠ , কাঠের চোলা , কাঠের গুঁড়ো ইত্যাদি । চাল যেখানে মজুত করে রাখা হয় তাকে বলা হয় চালের ‘ গোলা ’ । আর মুড়ি প্রতিদিন সন্ধ্যায় বড় বড় বস্তায় ভর্তি করে যে দোকানে নিয়ে গিয়ে বিশাল দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হয় তাকে বলা হয় ‘ খটি । গুণমান অনুযায়ী মুড়ির নামও আছে যেমন মোটামুড়ি , চালের মুড়ি , সার দেওয়া মুড়ি , সার ছাড়া মুড়ি ইত্যাদি । দামও গুণমান অনুযায়ী নির্ভর করে বর্ধমান , কালনা ও অন্যান্য জায়গা থেকে চাল আনা হয়।চালের আবার বেশ সুন্দর নামও আছে , যেমন- শাস্তি , শ্রীবর , শ্রীদুর্গা , মল্লেশ্বর , ললাট , বিশালক্ষী- এছাড়া হোগলা , হামাই , গেঁড়িমুটি ধান তো রয়েছেই । চালের গুণমান অনুযায়ী দাম নির্ভর করে ।
প্রক্রিয়া
ধান থেকে মুড়িতে রূপান্তরের কাজ করাটা কেবল কষ্টকরই নয়, অসম্ভবও। মুড়ির ধান মাড়াইয়ের পর তা পরিষ্কার করে রোদে শুকানোর নিয়ম। রোদে ধানের রস টানার পর তা ভাপ দিয়ে হালকা সেদ্ধ করা হয়। এরপর তিন থেকে পাঁচ দিন পানিতে ভিজিয়ে আরেক দফা ভাপে সেদ্ধ করতে হবে। বড় হাঁড়িতে ফুটন্ত পানির ওপরে ছিদ্রযুক্ত পাত্রে ধান রেখে ঢেকে দেওয়া হয়। জলের ভাপে ধান সেদ্ধ হতে থাকে। এ সময় ধানের মুখ ফাটলে তা তুলে ফেলা হয়। সেদ্ধ ধান একটু আঠালো হলে তাতে মুড়ি ভালো হয়। বেশি সেদ্ধ হয়ে ধান ভাতের মতো গলে গেলে তাতে মুড়ি হবে না। এরপর সেদ্ধ করা ধান আবার রোদে শুকানো হয়। চাল শক্ত হয়ে এলেই চলে। পরে কলে বা ঢেঁকিতে ভানাতে হবে। তুষ-কুঁড়া পরিষ্কার করে নিলেই মুড়ির চাল পাওয়া যাবে।আবার অনেকে প্রথমে চালের গোলা থেকে বস্তায় করে চাল কিনে আনে । এক বস্তায় থাকে ১ পেটি চাল , যার ওজন ৮০ কিলোগ্রাম । কাঠের গোলা থেকে কাঠের গুঁড়ো ও কাঠ কিনে আনে ।মাটির ‘ দুপাকা ’ উনান ব্যবহার করা হয় কারণ একই সঙ্গে দুজন ভাজুনিকেই কাজ করতে হয় । প্রথমে কাঠের গুঁড়ো দিয়ে উনান জ্বালানো হয়।ভাজার আগে একটি মাটির পাতিলে চালে লবণপানি ছিটিয়ে এমনভাবে মাখাতে হবে, যেন তা ভালোমতো চালের সঙ্গে মিশে যায়। ৫০ কেজি চালে প্রয়োজন ১ কেজি লবণ।পরিমাণমতো নুন যেমন মুড়ির স্বাদ বাড়াত, তেমনি তার গুণে মুড়ি হত একেবারে পাঁপড়ের মতো মোলায়েম। মাটির পাত্রে তাপ দিয়ে এসব চাল একটা কাঠির সাহায্যে অনবরত নাড়তে হয়। আগুনের তাপে চালগুলো যখন লাল হয়ে ওঠে, তখন পাশে আর একটি চুলায় রাখা পাত্রের গরম বালির মধ্যে ঢেলে দিলে মুড়ি হয়ে যায়। পাশে ছিদ্রযুক্ত আরেকটি পাত্রে ঢেলে শলা দিয়ে নেড়ে মুড়ি থেকে বালি আলাদা করা হয়। আবার চুলায় বসিয়ে তাতে একইভাবে ভাজা চলতে থাকে।মুড়ি ভাজার কাঠি তৈরি হয় তিনরকমভাবে। প্রথমত, ঝাঁটার কাঠির মতো ফালি ফালি করে কাটা বাঁশ দিয়ে। এই কাঠি তৈরি করে ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ। নারকেল পাতার শিরা কেটে যে অংশটি দিয়ে খ্যাংরা ঝাঁটা বানানো হয়, তাই দিয়ে। আবার 'লুকুই' নামের এক ধরনের ঘাসের কাঠি দিয়েও তৈরি করা হয়, মাঠ, টাঁড় ও জঙ্গল থেকে এই ঘাসের কাঠি সংগ্রহ করে স্থানীয় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষজন।
কিন্তু জানেন কী অনান্য বাজারের মতন হরেক রকম মুড়ির বাজার হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমারে এই বাজার বসে।দুশোর বেশি মুড়ি ব্যবসায়ী আসেন নন্দকুমারের এই মুড়ির বাজারে। তাদের হাতে তৈরি বিভিন্ন ধরনের ভাজা মুড়ির পসরা নিয়ে।এই মুড়ির বাজারকে কেন্দ্র করেই কয়েক হাজার মানুষের জীবিকা নির্বাহ করে।এখানকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল হাতে ভাজা বিভিন্ন ধরনের মুড়ি।ধানের জাত অনুযায়ী মুড়িরও নামকরণ করা হয় কাঁকর, মতি, শ্যামলী, বর্ষা ইত্যাদি।তবে বাজারে কাঁকর,মতি ও শ্যামলী মুড়ির চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি অন্যদের থেকে।ধানের দাম আর মুড়ির গুনমানের ওপর নির্ভর করে মুড়ির দাম ঠিক করা হয়।
মুড়িকে নিয়েই গড়ে ওঠেছে বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী মেলাও।উত্তর চব্বিশ-পরগণার সরদারহাটি গ্রামের মুড়ির চাকের মেলা। এই মেলা শতবর্ষ প্রাচীন,মুড়ির চাকই হল এই মেলার বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া বাঁকুড়ার পুখুরিয়া গ্রামের মুড়ি মেলা,চার দিন ধরে প্রতিদিন সকালে সপরিবারে মেলা লোকের ভিড় হয় এখানে। বাড়ি থেকে মুড়ি ও মুড়ি মাখার সামগ্রী নিয়ে এসে এখানে বসে জাতিবর্ণ নির্বিশেষে মুড়ি খান গ্রামের মানুষেরা।
রাঢ়-বাঁকুড়ার একটি বিলুপ্তপ্রায় জীবিকা হল 'ভাজাভানা' বা 'ভাচাভানা'। দু’একজন অভাবী সংসারের মহিলারা যারা লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অথবা নিজের বাড়িতেই অন্যের জন্য মুড়ি ভেজে দিতেন। কিন্তু কালের নিয়মে এখন সবই বিলুপ্তির পথে।এখন মেশিনে ভাজা মুড়ির চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। ধীরে ধীরে মানুষিক শক্তি বনাম মেশিন শক্তির লড়াইয়ে মানুষ হেরে যাচ্ছে।
তথ্যসূত্র ও ছবি: ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত