নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়: মেজদা উপেন্দ্রনাথ নির্বাসিত হবার আগেই অনেকের কাছেই আদর্শ পুরুষ ছিলেন । কাজেই একই পরিবারের মধ্যে থেকে সহোদর ভাই যে আমাকেও প্রভাবিত করবে সে কথা না বললেও চলে । ধরতে গেলে আমার শিক্ষকতার শুরু মেজদার প্রভাবেই । আর সারা জীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে চুপ থাকতে পারিনি সেও মেজদারই প্রভাব। অনেকেই পূর্বে না জেনেও আমার স্বভাবের মধ্যে মেজদার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে জানতে চেয়েছেন আমি উপিনদার ভাই কি না ? উত্তরে হাঁ শুনে বলেছেন দেখেছেন ঠিক ধরেছি ।
আমি বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছি । স্মৃতিশক্তি কমজোরি হয়ে পড়েছে। তবু স্মৃতি থেকে কিছু কিছু উদ্ধার করে আজ লিখছি ।
মেজদা, বিধান রায় ও ভবতোষ ঘটক
বসুমতীর ভবতোষ ঘটক এককালে মেজদার ছাত্র ছিলেন । আন্দামান হইতে ফিরিয়া আসার পর তাঁহার বিশেষ অনুরোধে মেজদা বসুমতীর সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন । অতি অল্প সময়ের মধ্যে বসুমতীর গ্রাহক সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সেইসময় সরকারী কোন কোন কার্য্যের তীব্র সমালোচনার জন্য বসুমতী সরকারী বিজ্ঞাপন হইতে বঞ্চিত হয় । ভবতোষ ঘটক বিধানচন্দ্রের প্রিয়পাত্র ছিলেন । এবং তাঁহাকে গুরুদেব বলিয়া সম্মোধন করিতেন । একদিন ভবতোষের বিশেষ অনুরোধে মেজদাকে বিধানচন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া অনুরোধ করিয়া সরকারী আদেশ প্রত্যাহার করিবার জন্য ভবতোষ ঘটক মেজদাকে রাইটার্স বিল্ডিং - এ লইয়া যান । অনিচ্ছা সত্যেও মেজদা তথায় যান এবং ভবতোষ যখন বিধানবাবুকে বসুমতীর প্রতি সহৃদয় হইতে অনুরোধ করেন, তখন রায় মহাশয় মেজদার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া ইঙ্গিত করেন যে দাদা একটু কলম সংযত করিলেই ইহা সম্ভবপর হয় ৷ মেজদা কিছু না বলিয়া ভবতোষকে বলেন কাহারও আদেশ মানিয়া আমি আমার নিজের আদর্শ হইতে চ্যুত হইব না, যদি তোমার মনে হয় যে আমার সম্পাদনায় তোমার কাগজ আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে , তাহা হইলে আমি এখনই কর্মে ইস্তফা দিতেছি । আমি যোগদান করিবার পূর্বে ও পরে তাঁহাকে কাগজের গ্রাহক সংখ্যায় কি পরিবর্তন হইয়াছে , দেখিও । ভবতোষ ঘটক বিনীত- ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করায় মেজদা সম্পাদক থাকিতে সম্মত হইলেন ৷
উপেন্দ্রনাথ, জহরলাল ও রাজাজী
বঙ্গবিভাগের পর হিন্দুদের নিরাপদে পাকিস্তানে বাস করা অসম্ভব বলিয়া দলে দলে হিন্দু অধিবাসী বাংলায় ফিরিতে আরম্ভ করিয়াছে । ইহা রোধ করিবার জন্য নেহেরু-লিয়াকৎ চুক্তি হইল । কিন্তু তাহা বিশেষ ফলপ্রসূ হইল না । দলে দলে হিন্দুগন পাকিস্তান হইতে পশ্চিমবঙ্গে আসিতে লাগিল । এই সময় বাংলার রাজ্যপাল রাজভবনে নেহেরুর আগমন উপলক্ষ্যে এক সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করেন । আনন্দ বাজারের সম্পাদক সরকার মহাশয়ের বিশেষ অনুরোধে শারীরিক অসুস্থতা সত্বেও উপেন্দ্রনাথ ঐ সভায় যোগ দেন। নেহেরুজী তাঁহার বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে তাঁহার সহিত লিয়াক আলির যে চুক্তি হইয়াছে হিন্দুগনের প্রতি পাকিস্তানের যে দুর্ব্যবহার হইতেছে তাহা শীঘ্র বন্ধ না হইলে তিনি ঐ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করিবেন ( I have got other means up in my sleeve to stop it.)
সকলেই চুপ করিয়া বসিয়া আছেন । হঠাৎ উপেন্দ্রনাথ উঠিয়া নেহেরুজীকে জিজ্ঞাসা করিলেন - May I know Mr. Prime minister what those other means are ? নেহেরুজী এইরূপ অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে আরক্তিম মুখে নিরুত্তর রহিলেন । রাজাজী পরে উপেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করিলেন — আপনি এরূপ অবস্থায় কি করিতেন ? উপেন্দ্রনাথ তেজদীপ্ত ভঙ্গীতে উত্তর দিলেন— Our troops would have occupied the whole of Khoolna to rehabi- late the unfortunate home - less . উত্তরটা বোধহয় রাজাজীর প্রীতিকর হয় নাই । কিন্তু উপেন্দ্রনাথের মৃত্যুর সংবাদে যে সান্ত্বনা - বার্তা পাঠান তাহাতে উপেন্দ্রনাথের তিনি বিশেষ নির্ভিকতার প্রশংসা করিয়াছিলেন ।