Feature: সেকালের সাদাকালো দুনিয়ায় বিজ্ঞাপনের ভূমিকা - Pralipta

কোয়েল সাহা : সময়টা ছিল ৭০এর দশক, যখন মানুষ টেলিভিশন বা ইন্টারনেটের রঙিন দুনিয়ার হাতছানিতে বিভোর ছিল না।তাদের কাছে বিনোদনের মাধ্যম বলতে ছিল রেডিও অনুষ্ঠান এবং খবরের কাগজের মধ্যে থাকা সাদা কালো বিজ্ঞাপনের মোড়ক। সেকালের মানুষ হাতে তৈরি সাদা পাতায় কালো কালিতে লেখা বিজ্ঞাপনের প্রতি আকৃষ্ট হত। এই বিজ্ঞাপন লেখনীর মধ্যে দিয়ে লেখকের অঙ্কনশৈলী ও লেখন দক্ষতার পরিচয় ফুটে উঠত।বিজ্ঞাপন প্রচার হতো নানান জায়গায়- বাজারে, জনতার ভিড়ে কবিতা আবৃত্তি করে, গান গেয়ে শোনানোর মাধ্যমে, দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকে কিংবা পাথর, কাঠ, স্টিলের পাতে খোদাই করে। নির্দিষ্ট কিছু পণ্য, সেবা, ইভেন্টের প্রচার-প্রসার, এমনকি রাজনৈতিক ক্যাম্পেইন, আসামী ধরার কাজেও বিজ্ঞাপনের ব্যবহার হতো সীমিত পরিসরে।

সূত্রপাত 

সেসময়ে বিজ্ঞাপন প্রচারের কাজে প্যাপিরাসের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।সুপ্রাচীন কালে মিশরে, যখন কাগজ আবিস্কার হয়নি, তখন গাছের ছালে লিখে পন্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হত ।প্রাচীন আরবের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্যাপিরাসে লেখা বাণিজ্যিক বার্তা এবং রাজনৈতিক ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্যে তৈরি লিফলেট ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।ভারতেও খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় চার হাজার বছর আগের পাথরে খোদাই করা নোটিশ আবিষ্কৃত হয়েছে।পূর্ব চীনের জিনান শহর থেকে সং রাজবংশের সময়কার তৈরি তামার পাতে লেখা একটি বিজ্ঞাপন উদ্ধার করা হয়।চীনের ইনান শহর থেকেই সেই অর্থে খৃষ্টপূর্ব সাত শত বছর আগে বিজ্ঞাপনের শুরু। লিউ ফ্যামিলি নিডেল শপ (Jinan Liu’s Fine Needle Shop) ব্রোঞ্জের প্লেটে খোদাই করে বিজ্ঞাপন প্রচার করে সর্বপ্রথম। 
সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের প্রস্তাব ঠিক আয়নার মত। তার মধ্যে সমাজের প্রতিচ্ছবি যেমন দেখা যায়, সংবাদের' মধ্যে সমস্যা আত্মগোপন করে, 'বিজ্ঞাপনের' মধ্যে আত্মপ্রকাশ না করে তাদের উপায় নেই। কারণ 'বিজ্ঞাপন' হল 'বিশেষভাবে জ্ঞান', নিরাভার আত্মপ্রকাশ, লুকোচুরি অবকাশ নেই তার মধ্যে।বিজ্ঞাপনের ভিতর দিয়ে সেকালের সমাজের এমন সব অদ্ভুত বিচিত্র দেখা যায়, যা কোনো ইতিহাসগ্রন্থে পাওয়া যায় না। 


তখনকার দিনে বিজ্ঞাপনগুলি ছিল এরকম -

বর্তমানে সংরক্ষিত বাংলা ভাষায় প্রথম বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয় ইংরেজি পত্রিকা ‘কলকাতা ক্রনিকল’য়ে, ১৭৭৮ সালে। পঞ্চানন কর্মকার কর্তৃক প্রকাশিত বিজ্ঞাপনটি একটি বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ক বইয়ের ছিল।
৯ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮ ঢাকা প্রকাশ পত্রিকায় প্রকাশিত সব্যাখ্যাত বিজ্ঞাপনটি বিক্রয়ের জন্য নয়। পোষ্য প্রদানের জন্য : 

পোষ্যপুত্র

আমি কুলীন ব্রাক্ষণ। আমার পাঁচ পক্ষে সাতাইশটী পুত্র ও আটটি কন্যা। আমার যেরূপ অবস্থা, তাহাতে এই পুত্রগণকে লিখাপড়া শিখাইয়া বড় মানুষ করিতে পারি, এমন সম্ভাবনা নাই। অথচ পুত্রদানের ফলও আমার জানা আছে। এজন্য ইচ্ছা করি যে, যেসকল বড়লোক পৌষ্যপুত্র গ্রহণের অভিলাষী তাহাদিগকে ষোলটী পুত্র দান করিয়া বাকী এগারটি পিতৃঋণ পরিশোধ্য জন্য রাখি। এ বিষয়ে অন্য কোন জ্ঞাতব্য বিষয় থাকিলে সাক্ষ্যৎকারে জানাইব। যথেষ্ট সম্পত্তির পরিচয় পাইলে কূলীন, কাপ, শ্রোত্রীয় অভেদে পুত্রদানে ব্রতী আছি।

                                শ্রী কৃষ্ণকমললাহিড়ী
                         ২৫ভাদ্র১২৯৫,সেপ্টেম্বর১৮৮৮

শ্রী মতিলাল বসু এণ্ড কোম্পানির এক বিজ্ঞাপনে ছিল “লক্ষ্মীবিলাস তেল” এ যাবতীয় শিরঃপীড়া ও হাত-পা জ্বালা বন্ধ হওয়া, সুগন্ধী ‘গোলাপ সার’-এর সুগন্ধে মাথা ঠাণ্ডা হওয়া, গাছগাছড়ায় প্রস্তুত কুইনাইন বর্জিত ‘সুধাসিন্ধু রসে’ প্লীহা ও যকৃত সংক্রান্ত জ্বর, ম্যালেরিয়া ও পুরাতন জ্বর থেকে আরোগ্য লাভ হয়।”


ক্যালকাটা কেমিক্যালের মার্গো সোপ-এর বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়েছিল আনুমানিক বাংলা ১৩৪৪ সনে। প্রথম থেকেই নিম গাছের উপকারিতা সমৃদ্ধ এই কোম্পানি অনেক কিছুতেই নিমকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিলেতি সাবান ও টুথপেস্টের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগুলোর বিক্রিও খারাপ হতো না। মার্গো সাবান ও নিম টুথপেস্ট পরে একসময়ে হেঙ্কেল ইণ্ডিয়া লিমিটেড কিনে নেয়। সেই হেঙ্কেল ইণ্ডিয়া এখন জ্যোতি ল্যাবোরেটরিজ লিমিটেড কোম্পানি নামে পরিচিত।
মানুষের রূপচর্চার অন্যতম বিষয় হল চুলের পরিচর্যা। 


১৯১৬সালের ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকায় জবাকুসুমের বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল: ‘দারুণ গ্ৰীষ্মে মাথা ঠিক রাখিবার একমাত্র উপায় জবাকুসুম তৈল।… জবাকুসুম তৈলের গন্ধ স্থায়ী। একবার মাখিলেই গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয়। মহারাজাধিরাজ থেকে দরিদ্র ব্যক্তি পর্য্যন্ত সকলেই জবাকুসুমের গুণে মুগ্ধ। মহিলাগণ কেশের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করিবার জন্য আদরের সহিত নিত্য জবাকুসুম তৈল ব্যবহার করেন।’১৯৫২ সালে জবাকুসুমের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিজ্ঞাপনের ছবি এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়। দুটি সমান বৃত্তাকারে আঁকলেন কবিরাজ বংশের ঐতিহ্যকে, একটি বৃত্তে এক পুরুষ ভেষজ বাঁটছেন, অন্য বৃত্তে আরশি হাতে এক মহিলা প্রসাধনে ব্যস্ত, দুই বৃত্তের পরিধিতে ফুলের নকশা।চিরুনির দাঁড়ায় ও জলের ধারায় চুল উঠে যাওয়া বা ঝরে যাওয়ার যে ভয়, তার এক ও অদ্বিতীয় সমাধান হল— ‘জবাকুসুম’’। 

কেয়োকার্পিন’ তেলের নেপথ্যেও এক সাধারণ মধ্যবিত্ত উদ্যমী বাঙালি, নাম ভূপেন্দ্রনাথ দে। বিজ্ঞাপন চিত্রে আঁকা তেলের ফোঁটায় লেখা হয়, ‘হালকা, দাগ পড়ে না, পুষ্টি জোগায় প্রতিদিন’। পণ্যের পরিচিতিতে লেখা, ‘অনেকদিনের প্রিয়/ আর প্রতিদিনই পাচ্ছে নতুন নতুন বন্ধু’। মধুসূদনের কৃষ্ণকুমারী, একেই কি বলে সভ্যতা এবং গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবুবিলাস নাটক অভিনীত হয়। এরপর উদ্যোক্তাগণ সমকালীন সমাজের সমস্যা নিয়ে রচিত নাটক আহবান করে পুরস্কারসহ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। 

সেই সময় লেখার জন্য বাজারে পাওয়া যেত সুলেখা কালি। ডট পেন, জেল পেন ইত্যাদি তখনও বাজারে আসেনি। ঝর্ণা কলম বা ফাউন্টেন পেনে এই কালি ভরে লোকে লিখতো। সুলেখা কালির বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।”


বোর্ন ভিটার বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। বিজ্ঞাপনে কবির স্বহস্তে লেখা চিঠিতে দেখা যাচ্ছে তিনি লিখেছেন, “বোর্ন-ভিটা সেবনে উপকার পাইয়াছি।”


দিল্লি থেকে বাঁশিদা মনে করিয়ে দিচ্ছেন আরেকটি ভুলে যাওয়া জিঙ্গল- "ঘৃত দুই প্রকার- শ্রী ও বিশ্রী", হাসির রাজা শিব্রাম চকরবরতি একসময় শ্রী ঘিয়ের বিজ্ঞাপণের জন্যে লিখেছিলেন লাইনটি।


সত্যজিৎ রায় বাটার জন্যে লিখেছিলেন- "হাঁটা মানেই বাটা"।
১৯২৯ সালে গৌরমোহন দত্ত, জিডি ফার্মাসিউটিক্যালে তৈরি করেন ‘বোরোলিন’। সবুজ রঙের টিউবে গন্ধযুক্ত সাদা অ্যান্টিসেপটিক মলম। ডাক্তারি সামগ্রী হলেও, সাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায় বোরোলিন।শুষ্কতার, রুক্ষতার অবসান যদি চান,
বারোমাস সারা অঙ্গে মেখে নিন।


নয়ের দশকে শারদীয়ার বিজ্ঞাপনের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল কোকাকোলা বিপণন সংস্থার আনা একটি বিজ্ঞাপন।

সত্যজিৎ রায় প্রথম বিজ্ঞাপনে ভারতীয় ধাঁচের ক্যালিওগ্রাফিক উপাদান ব্যবহার করা শুরু করেন। ১৯৫০-এর জুলাই মাসে ডি. কে.-নরেশ গুহ-সত্যজিৎ রায়ের ত্র্যহস্পর্শে এই বিবৃতিপত্রের আত্মপ্রকাশ। প্রথম সংখ্যায় লেখা হল সুকুমার রায়ের ‘খাই-খাই’ বইটির কথা: “…প্রতি পাতায় সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ছবি। সত্যজিৎ রায়ের পিতা সুকুমার রায়। 
সত্যজিতের করা অসাধারণ একটি বিজ্ঞাপন-অঙ্কন: ‘সিগনেট বুকশপ শনিবার সারাদিন খোলা থাকে।’ মুদ্রণ-জগতের পরিভাষায় একে ‘টেলপিস' বলে।


পরবর্তী সত্যজিৎ-কৃত ২৩তম সংখ্যার টেলপিসটি ছিল এরকম যামিনী রায়-ঘেঁষা এক আয়তচক্ষু ঘোমটা পরা বধূ, বুকের কাছে দুই হাতে ধরে আছেন একটি বই। ক্যাপশনে লেখা: ‘মনের মতো বই পাবেন’।
বিজ্ঞাপন থেকে সমকালীন সমাজের চেহারাটাও বোঝা যায়, সমাজ ও জীবনের বিবর্তনের ইতিহাস রচনায় নানান উপাদান পাওয়া যায় বিজ্ঞাপন থেকে । সেকালের বিজ্ঞাপন আজও আমাদের মনে স্মৃতি হিসাবে দাগ
রেখে গেছে।

তথ্যসূত্র ও ছবি: ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত