প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়: ১৯২০ সালে পরমশ্রদ্ধেয় মাষ্টার মশাইকে আমি প্রথম দেখি চুঁচুড়ার লেডী ডাক্তার হৈমবতী সেনের বাড়ী , তাঁর বড় ছেলে ধ্রুবজ্যোতি সেন ছিলেন মাষ্টার মশাইয়ের হুগলী কলেজের প্রিয় ছাত্র । তাঁর কলেজের বন্ধু ছিলেন আমার মেজ দা অবিনাশ বন্দোপাধ্যায় , মাষ্টার মশাইয়েরই ছাত্র । বিপ্লবাচার্য্য ছিলেন ঐ সময়ের একজন কিম্বদন্তিঃ পুরুষ । বৃটিশ সরকারের কত বিভৎস অত্যাচারের ভয়ঙ্কর প্রয়োগের কাহিনী তখন আমাদের মনে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশের প্রতি ঘৃণা তীব্রভাবে মনের কোনায় বাসা বেঁধেছিল তার সীমা পরিসীমা নেই । পুলিশ আর সাহেব দেখলেই নাক কুঁচকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতাম ।
১৯১৭ সালের ৩ রা জানুয়ারী সকালে মাষ্টার মশাই Defence of India Act এ গ্রেপ্তার হন এবং ছাড়াপান ১৯২০ সালের প্রথম দিকে , দীর্ঘ তিন বছর চরম অত্যাচার ভোগ করেন । ছাড়া পেয়ে কখন চুঁচুড়ায় , কখন চন্দননগর কখন কলকাতায় থাকেন । স্বভাবত : চুঁচুড়ায় যখন থাকতেন তখন কয়েক জায়গায় থাকতেন , বিশেষ করে ধ্রুবজ্যোতি সেনের বাড়ীতেই থাকতেন বেশী । ঐ খানেই বিপ্লবাচার্য্যের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তখন আমার বয়স পনের ।
এলো ১৯২১ সাল , গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন । বহু যুবক , বালক এই আন্দোলনে সামিল হলেন । হুগলীতে কংগ্রেস অফিস , বিদ্যামন্দির খোলা হল । মাষ্টার মশাই সেখানে আশ্রয় পেলেন । কথাটা সম্মানজনক নয় , কিন্তু অহিংসবাদীদের প্রতিকূলতায় অনেকের প্রচেষ্টায় বিদ্যামন্দিরে তিনি থাকবার অনুমতি পেলেন , সঙ্গে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হলেন যে বৈপ্লবিক কাজ , প্রচার করতে পারবেন না । বর্তমানের অহিংস কাজে সহিংস প্রফুল্ল সেন তখন বিদ্যামন্দিরে , তাঁর তীক্ষ্ণ নজর ছিল মাষ্টার মশাইয়ের নির্জন ঘরটির দিকে , কারা যায় আসে তার দিকে । বিদ্যামন্দিরে তাঁকে যুবক ও কিশোরের দল ঘিরে থাকতো । সর্বক্ষণ তারই মধ্যে মাষ্টার মশাইয়ের মনের কথা আলাদা আলাদা ভাবে বলতেন বিজয় মোদক , নদীয়ার অনন্ত হরি মিত্র , দিনাজপুরের ব্রজগোপাল । শ্রীরামপুরের গোপীনাথ সাহার সঙ্গে আর সকলে মাষ্টার মশাইয়ের কাছে নানা রকম কাহিনী শুনে মনে মনে তৈরী হত । পরে অনন্ত হরি মিত্র ও গোপীনাথ শহীদ হন । মাষ্টার মশাইয়ের সঙ্গ লাভে আমাদের বৈপ্লবিক উত্তাপ সঞ্চারিত হতে থাকে , – বিজয়- মোদক তাকে সংগঠনের মাধ্যমে গড়ে তোলেন ।
বিদ্যামন্দিরের কোন কোন অহিংসবাদী হবু নেতাদের লম্ফঝম্পর জন্য মাষ্টার মশাই সেপ্টেম্বর ১৯২৩ শে পুনরায় গ্রেপ্তার হন । ছারাপান জুলাই ১৯২৮ । এই পাঁচ বছরের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসে । কারণ অনেক বিপ্লবী ' দাদারা ' মাথা মুড়িয়ে টিকি রেখে গান্ধীবাদী বনে যায় । সে জন্য মাষ্টার মশাইয়ের তৈরী ছেলেরা যুগান্তর দল থেকে বেড়িয়ে “ হিন্দুস্থান রিপাবলিকান আর্মি ” দলে , মিশে যান । এ দলটিও মাষ্টার মশাই সূদূর পাঞ্জাবে থাকতে প্রতিষ্ঠা করেন । আমরা বিদ্যামন্দির থেকে বেড়িয়ে আসি । অহিংসাবাদীদের সহিংস অত্যাচারে ।
গান্ধীর সুভাষচন্দ্রের প্রতি অন্যায় ( সহিংস ) ব্যবহারের জন্য সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক দল প্রতিষ্ঠা করলে , মাষ্টার মশাই , গোপেশ মল্লিক ও আরোও অনেককে নিয়ে সুভাষচন্দ্রের পাশে দাঁড়িয়ে বামপন্থী আন্দোলন সক্রিয় ভাবে পরিচালনা করেন । এই সময় আমরা কমিউনিষ্ট আন্দোলনে নজরুল পরিচালিত “ লাঙল ” পত্রিকার মাধ্যমে বিশ্বাসী হয়ে বামপন্থী আন্দোলনের পাশে পাশে থাকি ।
মাষ্টার মশাই শিক্ষকতার ক্ষেত্র থেকে বিপ্লবকে সার্থক করার জন্য সংগঠন কর্মে প্রেরণা দেন । প্রথম যুগে ননীগোপাল বন্দোপাধ্যায় , ধ্রুবজ্যোতি সেন , অভয়শীল , মহাকাল মুখোপাধ্যায় , মধ্যযুগে অভয় দত্ত , জয়পাল প্রভৃতিকে গড়ে তোলেন , চুঁচুড়া যত্তেশ্বর তলার যুগসঙ্ঘ নামে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ।
শেষের দিকে তাঁর হাতে সার্থক রূপে গড়ে ওঠেন শ্রীমান অশোক ঘোষ , শম্ভু , ঘোষ প্রভৃতি । শিক্ষকতা করেন — সোম্ ট্রেনিং স্কুলে , গড়বাটী হাই স্কুলে , দেশবন্ধু হাই স্কুল বিদ্যামন্দির প্রভৃতিতে ।
বর্তমানে তাঁরই হাতে গড়া কিছু কিছু কর্মিরা পূজিবাদ , সাম্রাজ্যবাদ ও দেশের বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে আপোষহীন সংগ্রামে জনগণের অধিকার ছিনিয়ে আপনার কাজে প্রাণপন করে লড়াই করছেন । বিপ্লবাচার্য্যের প্রগতিশীল আপোষহীন আদর্শ জীবন দেশের সমাজতন্ত্র আনবেই ।