Chinsurah:চুঁচুড়ার শিবচন্দ্র সোম ট্রেনিং একাডেমী স্কুলের ইতিহাস ও নানা কথা - Pralipta

মৃণালকান্তি চট্টোপাধ্যায়: ষণ্ডেশ্বর শিবের মন্দির ও শ্যামবাবুর ঘাট শ্মশানের মাঝখানে পূর্বমুখো যে বিশাল থামওয়ালা বাড়ীটি যাঅতীতের বহু সাক্ষী বহন করে এসেছে তাই হল প্রখ্যাত স্কুল শিবচন্দ্র সোম ট্রেনিং একাডেমি । ২৬ বছর আগে ( ১৯৯৭-৯৮ সালে )  এর শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান হয়েছিল । বিদ্যোৎসাহী দানশীল হুগলী - চুঁচুড়ার প্রখ্যাত সোমবংশের স্বর্গীয় হেমশশী সোম এ স্কুলের স্থাপনা করেন ১৮৯৭ সালে। পিতা শিবচন্দ্রের স্মৃতিতে ও লর্ড এস্ . পি . সিংহের একান্ত ইচ্ছায় তিনি স্কুলের ঐ নামকরণ করেন । এস . পি . সিংহ ছিলেন হাউস্ অব লর্ডসের প্রথম ভারতীয় সদস্য , শিবচন্দ্র সোম যখন বীরভূম সদর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তখন সত্যেন্দ্র প্রসন্ন ছিলেন তাঁর অনুরাগী ছাত্র । শিবচন্দ্রবাবু পরে হুগলী কলিজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজ করেছিলেন । তিনি নিজ বাটীতে অনেক ছাত্রকে বিনা বেতনে ও তাদের আহারাদি দিয়ে পড়াতেন । হেমশশী সোম মহাশয় বরাবর পিতার সেই ধারাকে বজায় রেখেছিলেন অর্থাৎ তিনিও অনেক দুঃস্থ ছাত্রদের আহারাদি ও বিনা মাহিনাতে নিজ স্কুলে পড়াতেন । স্কুল চালাবার খরচ হিসাবে তিমি কোন সরকারী অনুদান নিতেন না ।

প্রথম জীবনে হেমবাবু এন্‌ট্রান্স পাশ করে পোষ্টাল ডিপার্টমেন্ট সাব অডিটরের কাজ করেছিলেন । তার উপরে তিনি ব্যবসার কাজেও জড়িত ছিলেন । কাঁচড়াপাড়ায় ১০০ বিঘা জমিতে তিনি ধান চাষ করাতেন । চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পরে তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ।সে কাজে তিনি তার সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করেন । প্রথম দিকে বর্ত্তমান স্কুল বাড়ীতে আসার আগে কামারপাড়ায় মণ্ডলদের বাড়ী দ্বারিক শীলের বাড়ী ও ডাঃ ফণী ব্যানার্জীর বাড়ীতে সামান্য পয়সায় ঘরভাড়া নিয়ে তাঁকে স্কুল চালাতে হয়েছিল । তারপর ৭৫ , ভাড়ায় বর্তমান স্কুলের বাড়িতে আসেন । অনেক দুঃখ কষ্ট ত্যাগ স্বীকার করে হেমবাবুকে স্কুলটি পরিচালনা করতে হয়েছিল । শিক্ষক মহাশয়েরাও সে কষ্টের অংশীদার হয়েছিলেন । হেমবাবু ছিলেন স্কুলের সুপারিটেনডেন্ট ও স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন ভোলানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ।

তখন হুগলী - চুঁচুড়ায় যতগুলি স্কুল ছিল তার মধ্যে এই স্কুলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং এর ছাত্রসংখ্যা সবচেয়ে বেশী হয় । আগেই বলেছি হেম বাবু স্কুলের জন্য কোনরূপ সরকারি সাহায্য নিতেন না । ছাত্রদের সামান্য মাহিনা ও স্বপার্জ্জিত সঞ্চিত অর্থ থেকে তিনি স্কুলের যাবতীয় খরচ , শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী- দের বেতন ও স্কুলের ভাড়া মেটাতেন । স্কুল ছাড়াও নিজ পাড়ায় তিনি তাঁর পূর্ব্বপুরুষ মহেশচন্দ্র সোম স্থাপিত ঐতিহাসিক শ্রী শ্রীকরুণাময়ী সূর্য্যমূত্তি কালীবাড়ীর খরচ ও দুঃস্থ ছাত্রদের খরচ চালাতেন । স্কুল ছাড়াও তাঁর একটি ছাপাখানা ছিল , এটি ছিল শ্যামবাবুর ঘাটস্থ ডাঃ ফণী ব্যানার্জীর বাড়ীতে , এখনে কিছু কিছু পাঠ্যবই ও পত্রিকা ছাপা হত ।

প্রসঙ্গক্রমে জানাই যে অধ্যাপক জ্যোতিষ ঘোষ , সবার প্রিয় মাষ্টারমশাই রাজনৈতিক কারণে লিপ্ত থাকার জন্য হুগলী মহসীন কলেজ হতে বিতাড়িত হলে হেমবাবু ব্রিটিশ রাজরোষ উপেক্ষা করে তিনি জোতিষচন্দ্রকে নিজ স্কুলের শিক্ষকের পদে বহাল করেন এটা আনুমানিক ১৯১৩-১৪ সনে ।

১৯৩৪ সনে হেমবাবুর আহ্বানে ব্রতচারীর প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্ত এখানে কিছুদিন ব্রতচারী ক্যাম্প করেছিলেন । গুরুসদয়বাবুও ইংরেজ রাজের কুনজরে ছিলেন ।

প্রাসঙ্গিকভাবে অতীতের দিকে ফিরে চাইলে আমরা এই স্কুল বাড়ীটির কিছু ইতিহাস জানতে পারি । এই বাড়ীটি ৺হেনবাবুর পূর্বপুরুষ ৺শ্যামরাম সোম তৈরী করিয়েছিলেন । পলাশী যুদ্ধের কিছুকাল আগে শ্যামরামবাবু গঙ্গার তীরে এই মনোরম বাগানবাড়ী ও সুন্দর সুসজ্জিত তার সংলগ্ন বাগান তৈরী করিয়েছিলেন । তখন ওলন্দাজদের আমল ও নবাব সিরাজদৌল্লা সগৌরবে রাজত্ব

করছিলেন । শ্যামরামবাবুর এক ভ্রাতা নবাবের অধীনে দেওয়ানের কাজ করতেন । তিনি বাগানবাড়ীটির উত্তরদিকে একটি পুরুষদিগের স্নানের ঘাট ও দক্ষিণদিকে একটি মহিলাদের স্নানের ঘাট তৈরী করিয়েছিলেন । তখন একই ঘাটে পুরুষ মহিলা স্নান করতেন না , তাই ঐ ব্যবস্থা । আজ ঘাট দুটিই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ও বাড়ীটির উত্তর দিকের ঘরগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে , সে সব ঘরেও আগে আমাদের ক্লাসরুম ছিল ।

এখন বর্তমানের দিকে ফিরে আসা যাক্ । হেমবাবুর সময়ে ও তার পরেও কিছুকাল স্কুলের প্রশাসন ও পঠনপাঠন উন্নত- স্তরের ছিল । তিনি তখন পাঠ চলাকালীন শ্রেণীতে শ্রেণীতে গিয়ে পড়া শুনতেন । স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষায় অনেক ছেলে প্রথম ডিভিশনে পাশ করতো । ৬০ এর দশকে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী শম্ভু ঘোষ এ স্কুলের সেক্রেটারি ও প্রসিদ্ধ শল্য চিকিৎসক মুরারীমোহন মুখোপাধ্যায় এখানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন । তিনি অর্থ দিয়ে স্কুলের নতুন বিজ্ঞান ভবনটি তৈরী করে দেন । তাঁরা চলে যাওয়ার পর স্কুলের সে মান আর নেই । পরীক্ষার ফল ও সেরকম আর ভাল হয় না ।

এখন স্কুলের প্রধান সমস্যা হচ্ছে যে ১৯৯২ সালে সরকার বাড়ীটি ডি - রিকুইজিশন করে দিয়েছেন ও হাইকোর্টের মামলার রায় হিসাবে সরকার স্কুল কর্তৃপক্ষকে স্কুল - বিল্ডিংটি বাড়ীর মালিককে ' ছেড়ে দিতে বলেছেন । অবশ্য , স্কুলের আবেদনে মালিকপক্ষ আনুমানিক ১২ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাড়ীটি বিক্রি করতে রাজী হয়েছেন । কাজেই , স্কুল - কর্তৃপক্ষের কাছে গুরু দায়িত্ব হল এই বিরাট অংকের টাকা যোগাড় করা । স্কুলের ল্ডিং ফাণ্ড যা আছে তা যৎসামান্য । শতবর্ষের অনুষ্ঠানে মন্ত্রী নরেন দে কিছু আশ্বাস দিয়েছিলেন , তার রূপায়ণ হয় নি । শ্রীরূপচাঁদ পাল ( এম . পি ) কিছু টাকা গ্রান্ট হিসাবে দিয়েছেন যাতে কিছু কিছু মেরামতির কাজ চলছে । অধুনা রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এই নামী স্কুলটি আজ যে সংকটের মুখে পড়ে তা থেকে আশু পরিত্রাণের উপায় কি ? সকল অভিভাবক , শিক্ষকবৃন্দ , হুগলী চুঁচুড়ার নাগরিকবৃন্দ ও সরকারী হিতৈষীব্যক্তিরা যদি একযোগে স্কুল বাড়ীটি ক্রয় করা ও সঙ্গে সঙ্গে পঠনপাঠনের মানকে উন্নত করার জন্য এগিয়ে আসেন তাহলে স্কুলের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কাজটি অগ্রসর হতে পারে ॥