Baidyabati: প্রাচীন ইতিহাসে বৈদ্যবাটীর (বৈদ্যপুর) স্থান - Pralipta

                       Old Nimai Tirtha Ghat at Baidyabati

সমীর কুমার দে: বেদ বেদান্ত এবং উপনিষদের চর্চা , অতি প্রাচীনকাল হতে ভারতবর্ষে চলে আসছে । মুনি - ঋষী হতে বৈদান্তিকের দল , গ্রাম বাংলাতেও তার ধারা প্রবাহিত করেছিলেন । আর সেই ধারায় অবগাহন করে এক সময় বৈদ্যবাটী গ্রামখানিও সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল জ্ঞানাগ্নির প্রভায় । সেই জ্ঞান অন্বেষণ মাত্র পাঁচশত বছরের নহে । প্রাচীন পুঁথি হতে লোককথা , শ্রুতি প্রভৃতিতে ছড়িয়ে আছে এর প্রাচীন কাহিনী । যাহা দুই হাজার বছরের অধিক পুরাতন ।

সুপ্রাচীন বৈদ্যবাটীর গাঙ্গেয় সভ্যতার ক্রমবিকাশ এবং সংস্কৃতির ধারা তথা কাব্য ও শাস্ত্রচর্চার সুত্রপাত ঠিক কবে শুরু হয়েছিল , তার সাল তারিখ সঠিক নির্ণয় না করা গেলেও তার প্রাচীনত্বর প্রমাণ পাওয়া যায় নিম্নোক্তভাবে বৈদ্যকুলচূড়ামণি কবিবর বসন্ত রায় সম্রাট শাহজাহানকে তাঁর সংস্কৃত কাব্য পাঠ দ্বারা বিমুগ্ধ করেছিলেন । সম্রাটও কবিকে সম্মান স্বরূপ বৈদ্যপুর মৌজা নিস্কর রূপে দান করেন । বলাবাহুল্য কবি বসন্ত রায় বৈদ্যবাটীর অধিবাসী ছিলেন । 

সম্ভবত বসন্ত রায় বৈদ্যপুর মৌজা লাভ করার পরে অধিক সংখ্যক বৈদ্য ব্রাহ্মণগোষ্ঠী বৈদ্যপুর বা আজকের বৈদ্যপাড়ায় এবং বৈদ্যবাটীতে বসবাস শুরু করেন । তাঁরা বিক্রমপুর ( অধুনা বাংলাদেশ ) হতে আগত হয়েছিলেন । এক সময় এঁদের চিকিৎসা ও ভেষজ চর্চার খ্যাতি সমগ্র বাংলাতে ছড়িয়ে পড়েছিল । কেবল মাত্র বসন্তরায়ই নয় , অনেক বিদগ্ধ কবিরাজ , চিকিৎসক , শাস্ত্রকার , কবি এবং সুপণ্ডিতের বাস গৌরবে বৈদ্যবাটী ধন্য হয়েছে । তাঁদের জ্ঞান ও শিক্ষার প্রজ্জ্বলিত শিক্ষা কেবলমাত্র পূর্ব নয় , সমগ্র বাংলাকেই প্রদিপ্ত করেছিল - বলা যেতে পারে । তার প্রমাণ , কবি বসন্ত রায় , বিষ্ণুকান্ত কবিরাজ , বিশ্বনাথ ভট্টশালী , ঈশান বেদাশ্রয়ী প্রভৃতি ।

                     Old Nimai Tirtha Ghat at Baidyabati

শ্রীমন্ মহাপ্রভুর শিক্ষাগুরু বাসুদেব সার্বভৌম ছাত্রাবস্তায় বিহারের মিথিলায় ন্যায় দর্শন প্রভৃতির শিক্ষালাভ করেন । কারণ তৎকালে বাংলায় ঐ সকল শাস্ত্র চর্চা ছিল না । মহাপণ্ডিত বাসুদেব সর্বপ্রথম বাংলায় ন্যায় , দর্শন , স্মৃতি , ব্যাকরণ প্রভৃতি শাস্ত্রের পঠন - পাঠন শুরু করেন । তাঁর সেই শিক্ষার ঢেউ কেবলমাত্র নবদ্বীপই নয় সমগ্র বাংলাতেই ছড়িয়ে পড়ে । বৈদ্যবাটীও বাদ যায় না । পূর্ব হতে বেদ ও বেদান্তের চর্চা তো ছিলই বাংলার ঋষী ও পণ্ডিত সমাজে । এবার ন্যায় , দর্শন , স্মৃতি শাস্ত্রের চর্চাও রীতিমত শুরু হয়ে যায় । সম্ভবতঃ স্মার্ত রঘুনন্দনের ছাত্র হরিহরানন্দ স্বামী নামে জনৈক পরিব্রাজক সন্ন্যাসী হুগলী জেলার কয়েকটি গ্রামে সংস্কৃত শিক্ষার জ্ঞানাগ্নি প্রজ্জ্বলিত করেন । সুপ্রসিদ্ধ নিমাইতীর্থ দর্শন মানসে হরিহরানন্দ স্বামী বৈদ্যবাটীতে আগমন করেছিলেন এবং ন্যায় দর্শন প্রভৃতি শিক্ষার প্রচার করেছিলেন । এইরূপ অনুমানের কারণ , বিশ্বনাথ ভট্টশালীর একমাত্র পুত্র হরিহরানন্দ স্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণপূর্বক গৃহত্যাগ করেন । বিশ্বনাথ ভট্টাশালী সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁর অধিবাসী বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিলেন । কালাপাহাড়ের ভয়ে ভীত হয়ে , বিগ্রহসহ গঙ্গার কুলে মনোরম বৈদ্যবাটীতে আগমন করেন এবং তাঁর একমাত্র পুত্র সন্ন্যাস গ্রহণ করলে তাঁর বংশ লোপ পায় । 

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সম - সাময়িক সুবিখ্যাত তন্ত্রাচার্য এবং মা জগন্মাতার সর্বপ্রথম সাকার মূর্তির প্রবর্তক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ সুপ্রাচীন তন্ত্র শাস্ত্রের প্রচার ও প্রসার করেন । তাঁর বহু শিষ্য ও ছাত্র দ্বারা উত্তরকালে তাহা নানা দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে । সুপ্রসিদ্ধ সাধক , কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ ও মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাহা ব্যাপকভাবে প্রচার করেন । পরে আন্দুলের প্রেমিক মহারাজও এঁর পদাঙ্ক অনুসরণে তন্ত্র সাধনা সঙ্গীত মাধ্যমে প্রচার করতেন । এই প্রেমিক মহারাজের শিষ্য ছিলেন , তারাগতি তর্কালঙ্কার ও চণ্ডীচরণ ন্যায়রত্ন । এঁরা বর্তমান চতুষ্পাটিলেনে সংস্কৃত শিক্ষার টোল খোলেন । যদিও তার পূর্বে বৈদ্যবাটীতে সংস্কৃত শিক্ষায়তন ছিল । এবং নানা দেশ হতে ছাত্রগণ এখানে শিক্ষা গ্রহণ করতে আগত হতেন । এক সময় বৈদ্যবাটী পঞ্জিকা রচনা ও জ‍্যোতিষ চর্চারও কেন্দ্র ছিল । 

 সুপ্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক চণ্ডীচরণ কেবলমাত্র পণ্ডিত - ই ছিলেন না , তিনি তন্ত্রসাধক রূপেও খ্যাত ছিলেন । সগীতাবাদরহস্যচণ্ডী ' তাঁর রচিত অমূল্য গ্রন্থ । জনশ্রুতি আছে , কুমোর পাড়ার প্রাচীন শ্মশানে তিনি শব সাধনা করতেন । স্বভাব কবি ও শাস্ত্রবিদ এবং মাতৃসাধক এন্টনী ফিরিঙ্গী বৈদ্যবাটী বাসকালে , ব্রাহ্মণ কন্যা সৌদামিনীকে এই কুমোরপাড়ার শশ্মানে সতীদাহ হতে উদ্ধার পূর্বক বিবাহ করতঃ পরবর্তীকালে কালী - সাধনা করতেন । তিনি সংস্কৃতেও সুপণ্ডিত ছিলেন। এন্টনির কাব্য গাঁথায় তাঁর শাস্ত্র জ্ঞান তথা তৎকালীন বৈদ্যবাটী- শ্রীরামপুরের কথার উল্লেখ পাওয়া যায় ।