Sarat Chandra Chattopadhyay:হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের ছাত্র শরৎচন্দ্র - Pralipta

গোপালচন্দ্র রায়: শরৎচন্দ্র কৃষ্ণপুর , রাধাপুর এবং দীঘড়া তিনটি গ্রামের কথা বলেছেন ৷ এখানে কৃষ্ণপুর আছে , কিন্তু রাধাপুর নেই । মনে হয় , কৃষ্ণপুরের পাশের গ্রাম দেবানন্দপুরকেই তিনি রাধাপুর বলে লিখে গেছেন।

শরৎচন্দ্র বইয়ে লিখেছেন — দীঘড়া সরস্বতী নদীর অপর পারে অর্থাৎ পশ্চিম পারে । দেবানন্দপুরের ঠিক পাশেই সরস্বতী নদীর উপর বাঁশের পুল আজও রয়েছে । - কিন্তু এখানে দীঘড়া নামে কোনও গ্রাম নেই । দীঘড়া গ্রাম আছে দেবানন্দপুর থেকে ১০ বা ১২ মাইল দক্ষিণে । মনে হয় , এই গ্রামের নামটা নিয়েই শরৎচন্দ্র তাঁর বইয়ে সরস্বতীর অপর পারের দীঘড়া বলে গেছেন ।

শরৎচন্দ্র হয়ত ছেলেবেলায় কারও কাছে এই দীঘড়া গ্রামের নামটা শুনে ছিলেন। তা নাহলে, ছেলেবেলায় যখন সরস্বতীতে নৌকা বেয়ে বেড়াতেন , তখন নৌকায় কোনদিন দীঘড়ার কাছে বা দীঘড়ায় গিয়েও থাকতে পারেন ।কারণ , এই গ্রামের পাশ দিয়ে যে ঘুঙ্গীর খাল বা ঘুমির খাল আছে , সেটা মাইল চার পশ্চিমে বিঘাটি ও মালিয়াপাড়া গ্রামের কাছে সরস্বতী নদীতে গিয়ে মিশেছে ।

হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের পুরাতন অ্যাড মিশন রেজিষ্টারে এক জায়গায় ছাত্রের নাম , বয়স , পিতার নাম , পিতার পেশা , বাড়ী , ছাত্র ভর্তির তারিখ , ভর্তির ক্লাস এবং ভর্তি ফি'র ঘরগুলিতে যথাক্রমে লেখা আছে- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , ১১ , মতিলাল চট্টোপাধ্যায় , চাকরি , দেবানন্দপুর , ১০ ই জুলাই ১৮৮৯ , ফোর্থ ক্লাস ও এক টাকা আট আনা ।

এই লেখা থেকে পরিষ্কার জানা যায় , শরৎচন্দ্র কবে এই স্কুলের কোন্ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন ।

কিন্তু স্কুলে সেই সময়কার কোন রেজাল্ট বুক বা ছাত্রদের প্রমোশনের খাতা না পাওয়ায় জানা গেল না শরৎচন্দ্র কতদিন এই স্কুলে পড়েছিলেন । তবে নানা সূত্রে জানা যায় শরৎচন্দ্র এই স্কুলে সেকেণ্ড ক্লাস অর্থাৎ বর্তমানের নবম শ্রেণী পর্যন্ত তো পড়েছিলেনই , হয়ত ফাষ্ট ক্লাস বা দশম শ্রেণীতেও কয়েকদিন পড়েছিলেন । তারপর ভাগলপুরে মামার বাড়ীতে চলে যান এবং সেখানে তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে , ঐ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন ।


শরৎচন্দ্র হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলে পড়ার সময় বেশ কিছুদিন দেবানন্দপুরে না থেকে হুগলী শহরে তাঁর এক মেসোমশায় ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ীতে ছিলেন এবং সেখান থেকে ব্রাঞ্চ স্কুলে যাতায়াত করতেন ।

দেবানন্দপুর থেকে ব্রাঞ্চ স্কুলের দূরত্ব মাইল তিন । এতটা কাঁচা রাস্তা হেঁটে যাতায়াত করা বালক শরৎচন্দ্রের পক্ষে কষ্টকর হবে ভেবে তার বাবা - মা ভোলানাথবাবুর বাড়িতে শরৎচন্দ্রের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন ।

শরৎচন্দ্র সম্বন্ধে লিখবার সময় আমি একদিন তথ্য সংগ্রহের জন্য শরৎচন্দ্রের ঐ মেসোমশায়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম । আমার সঙ্গে ছিলেন দেবানন্দপুর শরৎ স্মৃতি পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক দীনবন্ধু ঘোষ ।

আমরা যেদিন যাই , তাঁর কয়েক বছর আগেই শরৎচন্দ্রের মেসোমশায় ও মাসীমা উভয়েই দেহত্যাগ করেছেন । আমরা গেলে ভোলানাথ বাবুর পুত্র ( শরৎচন্দ্রের মাসীমার সপত্নী পুত্র ) প্রফুল্লচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন —
শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর কয়েক বছর পরে , আমাদের বাড়িতে তাঁর থাকাকে স্মরণ করে এই বাড়ির রাস্তার দিকের দেওয়ালে একটা স্মৃতিফলক লাগানো হয়েছে । সেই স্মৃতি ফলক লাগানো উৎসবে সেদিন তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী বিমলচন্দ্র সিংহ পৌরোহিত্য করেছিলেন । তাছাড়া তখনকার সেচমন্ত্রী ভূপতি মজুমদার , সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতিও সেদিনের সভায় এসেছিলেন ।

শরৎচন্দ্র আমাদের বাড়িতে ছিলেন বলে , এখানে এই হুগলীতে তাঁর নামে একটা রাস্তা '"শরৎ - সরণীও" হয়েছে । যেদিন এখানে এই রাস্তার নামকরণ উৎসব হয় , সেদিন সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন তখনকার পূর্তমন্ত্রী ভূপতি মজুমদার।


প্রফুল্লবাবুর মুখে এই সমস্ত কথা শোনার আগেই তাঁদের বাড়িতে গিয়ে বাড়ির বাইরে যে ফলকটি আছে সেটি দেখেছিলাম । সেই প্রস্তর ফলকে এই কথাগুলো লেখা আছে—

অমর কথাশিল্পী 
শরৎচন্দ্রের
ছাত্রজীবনের কয়েকটি বৎসর
এই বাসগৃহে
অতিবাহিত হয় ৷

৭ ই জ্যৈষ্ঠ  
১৩৫৫

হুগলী শরৎ স্মৃতিরক্ষা সমিতি
(ফ্রেণ্ডস লাইব্রেরী) কর্তৃক এই ফলক স্থাপিত

হুগলীর তেওয়ারী পাড়া লেনে ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে যেমন এই স্মৃতিফলক আছে এবং শরৎচন্দ্রের জন্মস্থান দেবানন্দপুরেও যেমন শরৎচন্দ্রের স্মৃতিরক্ষার নানা ব্যবস্থা হয়েছে । হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের কর্তৃপক্ষও তেমনি তাঁদের স্কুলে শরৎচন্দ্রের স্মরণে এক আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করেছেন ।