বাংলার শাঁখা শিল্প ও তার সমসাময়িক ইতিহাস সম্পর্কে দু-চার কথা - Pralipta


মৌমিলা দাস : এক অন্যতম প্রাচীনতম হস্তশিল্প হল শঙ্খ শিল্প। বাংলাদেশের ঢাকায় বল্লাল সেনের আমল থেকেই অর্থাৎ ১২০০ শতক থেকেই শঙ্খ শিল্পের প্রচলন শুরু। প্রথমে বাংলাদেশে এই শঙ্খ শিল্পের বিকাশ সবচেয়ে বেশি ঘটে এবং অতঃপর তা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তার লাভ করতে শুরু করে।

শঙ্খ শিল্পের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ হল সমুদ্রের বিশেষ কয়েক প্রজাতির শঙ্খ, করাত, তেপায়া টুল, হাতুড়ি এবং নরুন। এই বিশেষ প্রজাতির শঙ্খগুলি হল - তিতপুটি, রামেশ্বরি, ঝাঁজি, দোয়ানি, মতি-ছালামত, পাটি, গারবেশি, কাচ্চাম্বর, ধলা, জাডকি, কেলাকর, জামাইপাটি, এলপাকারপাটি, নায়াখাদ, খগা, সুর্কিচোনা, তিতকৌড়ি, জাহাজি, গড়বাকি, সুরতি, দুয়ানাপটি ও আলাবিলা। শঙ্খ প্রস্তুতিতে শিল্পীদের অসীম দক্ষতা, নৈপুণ্যতা ও ধৈর্য্য থাকা অতি আবশ্যক। একটি ৬ - ৭ ইঞ্চি একটি শঙ্খতে কোনো প্রতিরূপ ফুটিয়ে তুলতে একটি শঙ্খ শিল্পীর বা শাঁখারীর প্রায় দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগে।

বাংলাদেশে শঙ্খ শিল্পের বিকাশ স্বাধীনভাবেই ঘটে। সতেরো শতকে মুঘলরা ঢাকায় প্রবেশ করলে তখন শাঁখারীদের আনা হয় এবং তাদের ব্যবসার জন্য আলাদা জায়গা বা বাজার প্রস্তুত করা হয় যা শাঁখারী বাজার নামে পরিচিত। বাংলাদেশের হাত ধরেই ভারতবর্ষে শঙ্খ শিল্পের বিকাশ শুরু হয়।

বাঁকুড়ার হাটগ্রামের শঙ্খ দেশ জুড়ে বিখ্যাত।অনেকে মনে করেন মল্ল রাজাদের সময়ে বিষ্ণুপুরের সঙ্গে হাটগ্রামের শঙ্খ শিল্পের কাজ শুরু হয়। বাঁকুড়ার প্রায় ৩০০ জন শিল্পী এই শিল্পকর্মের সঙ্গে যুক্ত। এই হাটগ্রামে এমন কয়েকজন শঙ্খ শিল্পী রয়েছেন যারা শঙ্খের উপর সূক্ষ্ম কারুকার্য করে হিন্দু পুরাণের নানান দেবদেবী ও রামায়ণ-মহভারতের নানান আখ্যান ফুটিয়ে তোলেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। আর এই কাজের জন্য তাদের মধ্যে অনেকেই জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বিষ্ণুপুরে শঙ্খের চাহিদা আগের মতন না থাকলেও বাঁকুড়ায় এই শিল্পের চাহিদা রমরমা।

শঙ্খ দ্বারা উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হল হাতের শাঁখা।এছাড়াও রয়েছে কানের টপ, খোঁপার কাঁটা, চুলের ক্লিপ, শঙ্খের মালা, ঘড়ির চেন, আংটি, বোতাম, ব্রুশ, ব্যাংগেল, ব্রেসলেট ইত্যাদি। এখন ঘর সাজাবার প্রসধনী তৈরিতে শঙ্খকে ব্যবহার করা হচ্ছে যেমন ফুলদানি, আতরদানি ইত্যাদি।

শঙ্খের দাম আগের তুলনায় অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯১০ সালে ১৫০টি শঙ্খের মূল্য ছিল ৪০ - ৪৫ টাকা, ১৯৯৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৪০০০ - ৩০০০০ টাকা। দিনে দিনে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন পরিবর্তিত দ্রব্য যার ফলে ধীরে ধীরে কমছে চাহিদা। পেশার ধরণ পরিবর্তিত হওয়ায় পুরুষেরা এই হস্তশিল্প থেকে দূরে সরে আসছেন। ফলে কমছে শঙ্খ শিল্পীদের সংখ্যা। ভবিষ্যতে এই শিল্পের অবস্থা কিরূপ হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।