Mantra and Ojha: গ্ৰামাঞলে ওঝা বা গুনিন সম্প্রদায়ের মন্ত্র চর্চার অজানা বিবরনীর তথ্যপ্রকাশ - Pralipta


কোয়েল সাহা: প্রাচীন অচলায়তনের বেড়াজাল মানবমনকে বাধ্য করে কুঃসংস্কারের পথ অবলম্বন করতে। মানবজাতির কুঃসংস্কারের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আদিকাল থেকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ‌। ভারতের লৌকিক অলৌকিক ইতিহাস হল বহুমুখী। এরই একটি অংশ হল মন্ত্রচর্চা। একটু অবাক হচ্ছেন আর চিন্তা করছেন এ কোন অজানা তথ্যের অংশ কাহিনী? তাহলে চলুন এবার আরো একধাপ এগিয়ে এই বিষয়ে বিস্মৃত কাহিনীর পর্দা উন্মোচন করা যাক।

প্রাচীনকাল থেকেই এই বিশ্বাস বিভিন্ন সমাজে প্রচলিত ছিল যে অতিলৌকিক কোন শক্তি তার কোন নির্বাচিত ব্যক্তিকে কিছু মন্ত্র সুরসহ শিখিয়ে দেয় সেই মন্ত্রগুলোই জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে । মুখে মুখে প্রচলিত এই মন্ত্রসমূহ পরে লিখিত রূপ পেয়েছে । এরাই প্রেরিত পুরুষ , পয়গম্বর বা প্রফেট হিসাবে পরিচয় লাভ করেছেন । অতএব পয়গম্বর বা তাঁদের ধর্মগ্রন্থগুলো যে আসলেই আদিম ফোকলোরের অন্তর্গত এমন সিদ্ধান্তকে অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না । অলৌকিক বা অতিলৌকিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস থেকেই মানুষ যুগে যুগে ধর্মের প্রবর্তন করেছে । ধর্মীয় কোন অলৌকিক সাকার বা নিরাকার শক্তি পৃথিবীতে মানুষ নামক প্রাণীটির সৃষ্টি করেনি , মানুষই ধর্ম ও ধর্মীয় ভগবান বা ঈশ্বরের সৃষ্টি করেছে , ধর্মের বিবর্তনের ইতিহাস এই সত্যকেই প্রমাণ করে । ধর্মীয় বিশ্বাসের মতোই আত্মরক্ষার কারণে বা কল্যাণের ভরসায় কিংবা দৈহিক সুখের আশায় মানুষ এইসব মন্ত্রের সৃষ্টি করেছে । এই মন্ত্রগুলি কখনও সঙ্গীতের মত সুর করে কখনও বা কবিতার মত আবৃত্তি করে উচ্চারিত হতো । “ সংস্কৃত মন্ত্রে শব্দের বিবিধ অর্থ থাকলেও বাংলায় প্রচলিত অর্থে মন্ত্র বা মন্তর শব্দটি লোকসংস্কৃতি বিষয়ানুশীলনের ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় । নিঃশব্দে কিংবা সশব্দে উচ্চারিত অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন শব্দ সমষ্টি ‘ মন্ত্র ’ বা ‘ মন্তর নামে পরিচিত । বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের লোক সমাজে ব্যবহৃত মন্ত্রের অন্তঃকাঠামো প্রয়োগবিধি ইত্যাদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে , মানব সমাজে মন্ত্রের উদ্ভব এবং ব্যবহার অতি প্রাচীন কালের । ” নৃতত্ত্ববিদদের ধারণায় , প্রাগৈতিহাসিক মানুষ জীবিত ও মৃতের পার্থক্য বুঝতে গিয়ে আত্মা নামক একটি অলৌকিক অস্তিত্বের উপলব্ধি করে । তাদের কল্পনায় এক অদৃশ্য শক্তিই জীব ও জড়ের মধ্যে ক্রিয়াশীল । এই ভাবেই প্রথম Animation বা সর্বপ্রাণবাদের জন্ম হল । মানব সভ্যতার ইতিহাসে এটিই প্রথম ধর্মের উন্মেষ কাল । “ আদিম মানুষের এই সর্বপ্রাণবাদ ও সর্বাত্মার ধারণা এবং যাদু বিশ্বাস বিভিন্ন ধরনের মন্ত্রের উদ্ভবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল । অতিপ্রাকৃত শক্তিকে স্তবস্তুতির মাধ্যমে বশীভূত করা , কিংবা তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা ঐন্দ্রজালিক প্রয়াসের মাধ্যমরূপে মন্ত্রের ব্যবহার খুবই জনপ্রিয় । প্রাচীন যুগের ধর্মবোধ পৃথিবী ও পার্থিব জীবনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল । আর তা মন্ত্রের আকারে স্থান পেয়েছে বেদ ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে । বেদ সমূহের মধ্যে যজুর্বেদে স্থান পেয়েছে যজ্ঞ অনুষ্ঠান পদ্ধতির নির্দেশাবলী ও যজ্ঞে ব্যবহৃত মন্ত্রগুলি । অন্যান্য বেদ যথা ঋক্ , সাম , অর্থব বেদগুলিতে জীবনের বিভিন্ন পর্যায় অর্থাৎ রোগ - ভোগ - শোক প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা , সন্তান কামনা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের কামনায় রচিত হয়েছে মন্ত্র । মধ্যযুগের শিক্ষিত কবির রচনাতেও মন্ত্র - তন্ত্রের কথা আছে । বিশেষ করে মঙ্গলকাব্যের বিভিন্ন রচনা যেমন , মনসামঙ্গল , চন্ডীমঙ্গল , ধর্মমঙ্গল , অন্নদামঙ্গল ইত্যাদি রচনাতেও মন্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে । মন্ত্রের প্রতি আস্থা কেবল লোক বিশ্বাসের অঙ্গ নয় , লোক - ধর্মেরও প্রাণশক্তি । উপজাতীয়দের ধর্ম সম্বন্ধে বলা যায় যে , তাদের ধর্ম দৃশ্যত যত সরল বলে মনে হয় , প্রকৃতপক্ষে তা নয় । রিলিজিয়নের সংজ্ঞা যাই হোক না কেন , আচার যদি তার একটি বহিরঙ্গ বলে গণ্য হয় , তবে দেখা যায় যে কোন কোন উপজাতীয় অধিবাসীর মত এত জটিল আচার কেন্দ্রিক জীবন তথাকথিত অনেক সভ্য জাতির ধর্মেও নাই । সুতরাং তাদের ধর্ম বিষয়ক অভিব্যক্তি যা মন্ত্রের মাধ্যমে উচ্চারিত হয় সেগুলোও সেই অনুপাতেই জটিল হয়ে উঠে । তাই মন্ত্রগুলি যা বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে অথবা বিবর্তিত হয়ে বাংলায় রূপান্তরিত হয়েছে , অন্তর্নিহিত বিশ্লেষণে সেইসব জাতি সম্প্রদায় বা ভারতীয় বিশেষ করে বাঙালির নৃতত্ত্বগত ব্যবহার গুলি স্পষ্ট হবে।



' লোক ' কথাটির প্রকৃত অর্থসন্ধানে গলদঘর্ম গবেষককুল অন্ততঃ একটি ব্যাপারে একমত হয়েছেন ; সেটি হোল , ' লোক ' তাদেরই বলা হবে যাদের অঙ্গে সংস্কৃতির আলো পড়েনি । মন্ত্রের প্রতি আস্থা কেবল লোক বিশ্বাসের অঙ্গ নয় , লোক - ধর্মেরও প্রাণশক্তি । এই মহাসমাজের সাহিত্য লোকসাহিত্য , এদের শিল্প লোকশিল্প ইত্যাদি । লোকসাহিত্যের বিভিন্ন ধারা [ ছড়া , প্রবাদ , ধাঁধা , গান , গীতিকা , প্রবাদ - প্রবচন , কথা কাহিনী ইত্যাদি ] সভ্যতার আদিমতম যুগ বা তৎপূর্ববর্তীকাল থেকে নানাভাবে কখনও পরিবর্তিত বা কখনও বিবর্তিত হয়ে চলে আসছে । আজও তার সজীবতা গ্রামবাংলার প্রান্তে উপাত্তে বর্তমান । বস্তুতঃ আজকের বঙ্গসংস্কৃতি এই লোক সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে । আর্যরা আসার পর অনার্য ও আর্যসংস্কৃতির সমন্বয়কালে লোকসংস্কৃতি অনেকাংশে কুলে উঠলো এমন কথা প্রত্যক্ষভাবে না বললেও পরোক্ষভাবে বলা দোষের হবে না । আর্যোপনিবেশকালে রচিত বেদ উপনিষদ ও স্মৃতিসংহিতার রচনার প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকেই লোকসংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বাহক লোকসাহিত্য নিজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে এসেছে । এ সাহিত্য লোকপরম্পরায় সঞ্চারিত । প্রথম যুগের বেদ মানুষের মুখে মুখেই সঞ্চারিত হলেও পরবর্তীকালে তা পুঁথির রূপ লাভ করেছে । কিন্তু লোকসাহিত্য কোনদিন সে সৌভাগ্য লাভ করতে পারে নি । এখানেই নিহিত আছে তার স্বাতন্ত্র্য এবং নিজস্ব প্রকৃতি । লিখিত সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে অলিখিত লৌকিক ও মৌখিক সাহিত্য সংস্কৃতির এক তির্যক যোগাযোগ যে নেই বা ছিলো না তা নয় । তবু এদের মনন ও চিত্রকর্ষ দ্বিধাখণ্ডিত । নমনীয় , সমন্বয়ধর্মী এবং স্থিতিস্থাপক এই লোকসাহিত্য আর্য সমাজের ভাবদ্বারা কিঞ্চিৎ পুষ্ট হলেও আর্য সমাজের সম্পূর্ণ বহির্ভূত । লোকসাহিত্যের একটি শাখা হল গ্রাম্য ওঝাদের তন্ত্রমন্ত্র। সাপে কাটা , পেঁচোয় পাওয়া শিশুর গায়ে হাওয়া লাগা , কাঁদন পাওয়া , জলপড়া , নুনপোড়া , তেলপোড়া , ভূত বা দিন কাটান , বাগমারা , ইত্যাদির প্রয়োগ বা প্রতিকারকল্পে গ্রাম্য ওঝা বা গুণীনরা এইসব তন্ত্রমন্ত্র সহযোগে ঝাড়ফুঁক করে । একদা এগুলির সাহায্যে মনুষ্য বিশ্বাস বশতঃ ( এবং মন্ত্রশক্তির প্রভাবে ) রোগাক্রান্ত ব্যক্তির রোগ নিরাময় হয়ে যেতো ।এই মন্ত্র গ্রামের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, কুসংস্কার এবং কতিপয় মানুষের প্রতিহিংসাবৃত্তি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গদেশীয় মজুয্যের আদিম ধর্মবিশ্বাস , ভূতপেত্নী , দৈত্য , শয়তান , টোটেম প্রভৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি , আর্য তন্ত্রমন্ত্রবাদ , প্রাচীন লোকঐতিহ্য , পরবর্তীকালের বৌদ্ধ ও জৈন তান্ত্রিকতা , সর্বোপরি অরণ্যবহুল দেশের মানুষের অলৌকিক এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রতি নিষ্ঠাবোধ গ্রাম্য গুণীন বা ওঝাদের তন্ত্রমন্ত্রের প্রতি ব্যাপক প্রভাব এবং বিস্তৃতিকে ত্বরান্বিত করেছে । এই তত্ববাদের সঙ্গে মিশ্রিত হল গাছ গাছালির শক্তিধারণা বা ‘ দ্রব্যগুণবাদ ' । একদিকে মন্ত্রসহযোগে ঝাড়ফুক , অপরদিকে নানা উপকারী গাছের পাতা বা শিকড়ের ছোপ , বা প্রলেপ সাহায্য করতো রোগ নিরাময়ে । নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা এসে এ সমস্ত লোকাচারকে গ্রাস করেছে অনেকাংশে । ফলে ভালো হয়েছে কি মন্দ হয়েছে , সে বিচারের স্থান অন্যত্র । গ্ৰামীন লোকজীবনের সঙ্গে যাঁদের বিন্দুমাত্র পরিচিতি আছে , তাঁরা জানেন গ্রামবাংলায় বিশেষ করে মেদিনীপুর , পুরুলিয়া বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলার ব্যাপক অংশে এই সমস্ত গ্রাম্য ওঝা এবং ওদের তন্ত্রমন্ত্রের প্রভাব পূর্বাপেক্ষা কোনো অংশে কম নেই।

অলৌকিক নানা কথা দক্ষিণবঙ্গের গ্রাম্যমানুষের মুখে শোনা যায় । গ্রাম্য তন্ত্রমন্ত্রকে যারা টিকিয়ে রেখেছেন তাঁরা মূলতঃ ' শবর ' শ্রেণীর মানুষ । হান্টারের Statistical Accounts of Bengal এর বর্ণনাহসারে ১৯৫২ সালের লোকগণনা থেকে জানা যায় কেবলমাত্র মেদিনীপুর জেলাতেই শবর জাতির প্রায় ২০০০ মানুষ বাস করতেন । সাম্প্রতিক লোকগণনায় (১৯৬১ ) শবরের সংখ্যা দাঁড়ায় ২১৮১ জন । ইউরোপীয় নৃতাত্বিকদের বর্ণনা এবং বিবৃতি অনুসারে লম্বা মাথা , চওড়া নাক এবং কাঁকড়া চুল বিশিষ্ট ওঁরাও , লোধা , ভূমিক , সাঁওতাল প্রভৃতি আদিবাসীদের সঙ্গে শবর , ব্যাধ , মাল , শিকারী , কাকমারা প্রভৃতিদের সাদৃশ্য লক্ষিত হয় । এই ' শবর ' সম্প্রদায়ের মানুষগুলির জীবন বড় বিচিত্র ,মাদুলী ও মন্ত্রের সাহায্যে গোপন রোগ ও সর্পদংশনের চিকিৎসার মাধ্যমে এদের জীবিকা নির্বাহ হয় । এছাড়া শিকার , চাষবাস ও মজুর বৃত্তিও এরা করে থাকে । তবে এরা মন্ত্রচর্চা পরিত্যাগ করেনি একেবারে, প্রথমদিকে এই মন্ত্রচর্চা যাকে গুনিনগিরি বলা হয় তা শব্দের করায়ত্ত ছিল।এরা সাপ দেখেই তার নাম বলে দেয় । বোড়া সাপের ২৪ রকমের নাম এরা জানে- পাথরাজ , তেলতেলা , নাগ , ঘড়া লাগ , ঘোড়া , দক্ষ , বোল , গোড়্যা , লুটুলাা , ঘ্যাটা , শাকামুটি , মোহরা , ময়াল , ফালা , লাল , হলুদ , সাদা , তেঁতুলে , বালি , দোঁয়াশলা ইত্যাদি । শুধু শবর ব্যতীত আরো কিঞ্চিদধিক অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষ এই ঝাড় ফুঁককে উপজীব্য করে বেঁচে আছে । এসব ঝাড় ফুঁকের মন্ত্র শিষ্য পরম্পরায় মুখস্ত রাখার কথা। প্রয়োজনে লিখতে হলে নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে তার লিখতে হবে , কালো রক্তের বদলে আলতা কালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গ্রামে গ্রামে এক একজন ' ওস্তাদের ' শিষ্যসংখ্যাও কম নয় । পরে পরে মাহিয়্য কৈবর্ত্ত , বাগী , ডোম , চামার , মুচী , বাউরী , কাহার , ছলে , দামলী , হুড়ি , হুগলী প্রভৃতি সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ এই সমস্ত তন্ত্রমন্ত্র শিখে নিয়ে তথাকথিত ' মানুষের উপকার করে বেড়ায় । মন্ত্র প্রয়োগের মানুষের ভালো ও মন্দ দুই করা যায়। তবে তামা আর তুলসী পত্র দিয়ে দিব্যি করে মন্ত্র গ্ৰহন করা যায়।বিভিন্ন রোগ নিরাময়কালে এরা যে সমস্ত মন্ত্র ব্যবহার করে থাকে । কেবলমাত্র নৃতত্ত্বের দিক থেকে নয় , বাংলা ভাষার গোড়ার দিকের পরিচিতি বা অবয়বের ধারণাও এগুলি থেকে পাওয়া যেতে পারে । এই মন্ত্রগুলির উচ্চারণ বা গ্রন্থনা বড়ই কৌতূহলোদ্দীপক । মন্ত্রের মধ্যে মূলতঃ অনার্য , দেবদেবীর নাম , বর্ণনা এবং বন্দনা পরিলক্ষিত হয় মহাদেব - পার্বতী , ডাকিনী , যোগিনী , গন্ধর্ব , গরুড় , হহুমান , মহাবীর , মন্দোদরী , লক্ষণ , রাম , মনসা , হাড়িঝি , কামাখ্যা , কালী , তারা প্রভৃতি দেবদেবীরূপে এসমস্ত মন্ত্রে উচ্চারিত হন । শাস্ত্রকথিত দেবদেবীদের এই জাতীয় মন্ত্রে স্থানলাভের কারণটি নিঃসন্দেহে আর্য অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণের সূত্রটির মধ্যেই নিহিত আছে । কে বা কারা সর্ব প্রথম এই সমস্ত মন্ত্র রচনা করেছিল বা কেন করেছিল , এই সৃষ্টিকর্মের পেছনে সত্যিকার কোন দৈবপ্রভাব ( মঙ্গল কাজ করেছিলো কিনা এ বিষয়ে কোনো গবেষণা হয়নি।


অধিকাংশ মন্ত্র , অর্থহীন কয়েকটি শব্দ বা বর্ণের সমষ্টিমাত্র । মন্ত্রের সঙ্গে ছড়ার নিকট সাদৃশ্য আছে কয়েকটি বিষয়ে । যেমন মন্ত্রের আকৃতি এবং ছড়ার আকৃতি মোটামুটি একই থাকে , যা পরিসরে কখনই দীর্ঘায়িত হয় না । মন্ত্রের সঙ্গে ছড়ার প্রয়োগগত পার্থক্য থাকলেও সাদৃশ্য আছে ভাষার প্রকরণে , যেমন- ছন্দ , অলঙ্কার , ভাষা ইত্যাদির ক্ষেত্রে । এই কারণে অনেক মন্ত্রের গুরুত্ব হারিয়ে গেলেও ছড়ার আকারে প্রচলিত থাকতে দেখা যায় । মন্ত্রের আকারে লেখা ছড়াগুলি তাই বাংলাভাষার এক অপরিহার্য সম্পদ । তাদের মন্ত্রে ভাষার মধ্যে ছোটনাগপুর ও ওড়িশার আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব রয়েছে। 



মেদিনীপুরের ঘাটাল ও চন্দ্রকোনা থানা এলাকার একদল ওঝার মতে , ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ ও বিহারের ছোটনাগপুরে দুটি আদি ' ওঝা ' ঘরানা আছে । সেখানে উপযুক্ত গুরুর অধীনে দীর্ঘদিন সাধনা করার পর তবেই প্রয়োগের শক্তি লাগে । গ্রাম - বাংলার এই ওঝা বা গুনি সম্প্রদায়ের কাজকর্মের সঙ্গে প্রায় সকলেই সমধিক পরিচিত । এঁদের মন্ত্রচর্চার সঙ্গে আয়ুর্বেদের একটি নিগূঢ় সম্পর্ক লক্ষ করা যায় । 


মন্ত্রচর্চার কীভাবে আয়ুর্বেদশাস্ত্রও জড়িয়ে আছে তাও বোধহয় খুঁজে দেখা যেতে পারে । প্রাথমিকভাবে সংগৃহীত তথ্যগুলি নিম্নরূপ -

 ১. গরুর ' বাদল খুরা ' হলে – বেঁউচ শেকড় , বিছুটি শেষড় , শুঁট , পিপুল , - প্রতিটি বস্তু ১ তোলা হিসাবে মিশ্রিত করে বেটে গরম করে খাওয়াতে হবে । ২. সাপে কামড়ালে নিম্নোত্ত বস্তুগুলির যে - কোনও একটি , ওঝার পরামর্শ অনুযায়ী আড়াইটি গোলমরিচসহ বেটে খাওয়াতে হবে আফুলা বেলশেকড় , রসনফুলের শেকড় , খেতকরবীর শেকড় , শ্বেত - ধুতুরার শেকড় , পঞ্চমুখী জবার শেকড় । ৩. যে - কোনও সাপের কামড়ে ধানিলঙ্কার শেকড় , অথবা কুঁড়চি ফুলের শেকড় অথবা টগর ফুলের শেকড় আড়াই তোলা পরিমাণে , আড়াইটি গোলমরিচসহ বেটে রোগীকে খাওয়ালে বিষক্রিয়ার অবসান ঘটবে বলে বিশ্বাস ।

যাই হোক , ঘাটাল ও চন্দ্রকোণা থানা এবং হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার বিভিন্ন ওঝার কাছ থেকে শতাধিক মন্ত্র ' সংগ্রহ করা গেছে ।

ওঝাদের গুনিন বলেও আখ্যা দেওয়া হয় কারন গুনিন শব্দের দুরকমের অর্থ আছে,একটি যার অর্থ আছে আর অপরটি যে গুন করতে জানে,বংশ বা মুগ্ধ ও স্তম্ভিত করার ক্ষমতা আছে ।

ওঝার মন্ত্র / সাপের বিষ নামানোর মন্ত্র : 



সৰ্প বৈদ্য , বিষ বৈদ্য , সর্প বিষের চিকিৎসক ইত্যাদি অর্থে ওঝা শব্দের ব্যাপক প্রচলন আছে । বুৎপত্তিগত অর্থে ওঝা ব্রাহ্মণের উপাধি বিশেষ , উপাধ্যায়- উজঝাএ > ওজা > ওঝা ।.... পেশাদার অপেশাদার উভয় শ্রেণীর ওঝা আছে । সর্পভীতি বাংলার সর্বাঞ্চলের লোকসমাজে বিদ্যমান , এ কারণে ওঝা সারা বাংলায় লোকসমাজে বসবাস করেন । তবে ভাটি অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে সর্পভীতি ও সর্পাঘাতে মৃত্যুর হার বেশি , এজন্যই ঐ অঞ্চলে ওঝাদের সংখ্যাও বেশি , প্রতিপত্তিও বেশি ।
সর্পদংশনের প্রতিষেধক হিসাবে ওঝাদের ' আড়াইপটি ঝাড়নের ' মন্ত্রটির মধ্যে একটি ছোট্ট কাহিনী বর্তমান
 ‘ ফিঙ্গা বলে ফিঙ্গিলো হেরে দেখ রঙ্গ -
 ফিঙ্গারা বাপে ঝিয়ে লেগে গেছে সঙ্গ ॥
 ফিঙ্গার বচনে ফিঙ্গি পাতিলেন বিষ ভন্ম বারে কালকূট সাপের বিষ।।
 মনসা দেবীর আজ্ঞায় রং রাং রাং সোহায় ।। 

প্রসববের উপশমের মন্ত্র :


প্রসববেদনায় কাতর প্রস্তুতির প্রসব ত্বরান্বিত করতে গ্রামা ওঝারা ' জল পড়া ' দিয়ে থাকে । জলটি পুকুর বা জলাশয় থেকে সংগ্রহ করার সময়ও কিছু কিছু নিয়মকাহন আছে । লোহার কোন অস্ত্র নিয়ে জলাশয়ের পরিষ্কার জলে বর্গক্ষেত্রাকার দাগ টেনে তার মধ্যবর্তী অংশ থেকে তিনবার পাত্রে জলস্তরে আনতে হয় । লোহার অস্ত্রটি ঐ পাত্রে ডোবানো থাকবে । ঐ সময় ' পেছু ডাকা ’ হাঁচি ’ , টিকটিকির আওয়াজ অশুভজনক । তারপর ঐ জলপাত্রটি ওঝা হাতে নিয়ে মন্ত্র পড়ে তাতে ফুঁ দেয় । মন্ত্রটি আটবার উচ্চারণ করা হবে । প্রতিবারে একটি করে ফুঁ দেওয়া হবে পাত্রে শেষবারে তিনটি ফুঁ দেওয়া হবে । অলটি এবার মন্ত্রপুতঃ হবে । পেটের গোলমাল ও বদহজমের জন্য ' নুন পোড়া দেওয়া হয় । পোড়া ' অর্থে মন্ত্রপুতঃ করা । হাতে লবণ নিয়ে ওঝা মন্ত্র উচ্চারণ করে ।
সর্পদংশন বা কোন ক্ষতস্থানে বিষাক্ত কীটাদি দংশনের ফলে শরীরে ' মোয়া ' ( septic ) হয় । মন্ত্রপ্রয়োগে এই ' মোয়া ' ' ঝাড়া হয় । এই ঝাড়নকার্যে অনেক সময় ' বাক্স ' গাছের ডাল , বেগনে গাছের নরম পাতা বা ' আপাং গাছের শেকড় ব্যবহৃত হয় । বস্তুতঃ উক্ত তিনটি গাছই ভেষঙ্গ বিদ্যায় উপকারী বস্তু হিসাবে কফ বা কাশিতে ' তে - বাকস ' ( পাতা , ছাল ও শেকড় ) সেদ্ধ করে খাওয়া , মাথার যন্ত্রণায় বেগুনের পাতার রস কপালে মর্দন এবং পুরোনো ক্ষতে আপাং শিকড়ের প্রলেপ যথেষ্ট উপকার প্রদর্শন করে বলে শোনা যায় । এই ' মোয়া ' ঝাড়নের মন্ত্রটি নিম্নরূপ।

ডাইনি ছাড়ানোর মন্ত্র :

ওঝারা সমাজের ভালো - মন্দ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করত নানাধরনের মন্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে । এইরকমই আর একটি শ্রেণি দেখতে পাওয়া যেত তাদের বলা হোত ডাইনি । ডাইনি সম্পর্কে পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হল- “ প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইউরোপের সমাজে ডাইনিতন্ত্র ( Witchcraft ) বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল । তাদের স্বতন্ত্র জীবনধারা ( life style ) গড়ে উঠেছিল । নানা সামাজিক অপকর্মের সাথে তারা জড়িত ছিল । শয়তান ( devil ) ছিল তাদের উপাস্য দেবতা । খ্রীষ্টান পাদরীরা ধর্মদ্রোহী রূপে ডাইনীদের আখ্যাত করে তাদের বিরূদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন । ডাইনিকে পুড়িয়ে ফেলার বিধান দিলে ডাইনি সন্দেহে অনেক রমণীর প্রাণহানি ঘটে । অথচ একটা সময় ছিল যখন ডাইনি সম্প্রদায়টি সমাজে এমন নিন্দনীয় ছিল না । ডাইনি বা ডাকিনী সম্পর্কে আশুতোষ ভট্টাচার্য্য বলেন- তিব্বতী ভাষায় ' ডাক ' শব্দের অর্থ জ্ঞান বা প্রজ্ঞা , তাহা হইতেই ডাকের বচনের অর্থ জ্ঞানের বচন বা words of wisdom . তত্ত্বজ্ঞানের অনুশীলন করিত বলিয়া বৌদ্ধরা একটি সম্প্রদায়কে ডাক বলিত , সেই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত স্ত্রী চরিত্রকে ডাকিনী বলিত । সাধারণত ইহারা নানা ঐন্দ্রাজালিক ক্রিয়ায় সিদ্ধ ছিল । বৌদ্ধধর্মের অধঃপতনের যুগে তাহারা সকলের নিন্দাভাজন হইল , এখন হইতেই ডাকিনী কথাটি নিন্দাসূচক হইয়া উঠিল , তজ্জাত ডাইনি শব্দ তখন হইতে witch অর্থে ব্যবহৃত হইতে লাগল । ডাইনি শব্দটি এতটাই নিন্দাসূচক হয়ে উঠল যে ডাইনির সামান্য স্বভাব সম্পন্ন নারীরাও হয়ে উঠল সমাজের চোখে নিকৃষ্ট এক জীব । বর্তমানে আদিবাসী সমাজে ডাইনি হত্যার যে সংবাদ মাঝে মাঝেই পাওয়া যায় তা হল এই মনোভাবেরই প্রতিফলন । বর্তমানে ডাইনি হত্যা করা বা ডাইনির প্রভাব কাটানোর জন্যে কিছু মন্ত্র পাওয়া গেছে যেগুলি লোকছড়ায় অর্ন্তভুক্ত করা যায় ।

সভ্যতার প্রসার এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে ও মানুষের বিশ্বাসবোধের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম্য তন্ত্র মন্ত্র একটু একটু করে লোপ পাচ্ছে।