অঙ্কুর মজুমদার: ষোড়শ শতাব্দিতে কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তার চন্ডিকাব্যে লিখেছেন -
"এইসব সহরে যত সৈদাগর বৈসে।
কত ডিঙা লয়্যা তারা বানিজ্যে আইসে।
সপ্তগ্রামের বণিক কোথায় না যায়।
ঘরে বসে সুখ মোক্ষ নানা ধন পায়।।"
এই কয়কটি পংক্তি অথবা ভেনিসের সওদাগর সিজার ফ্রেরিকের ১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দের বর্ননা থেকে স্পষ্ট যে হুগলী জেলা শিল্প ও বানিজ্যে যথেষ্ট উন্নত ছিল। হুগলী একসময় বৃহৎ শিল্পাঞ্চলে পরিনত হয়। হুগলী জেলার প্রথম জুটমিল স্থাপিত হয় ১৮৫৫ সালে রিসড়াতে, জুটমিলের নাম ছিল 'ওয়েলিংটন জুট মিল'। তবে যন্ত্রশক্তি চালিত তাঁতের (Power Driven Loom) সূচনাকাল ১৮৫৯ সালে, স্যার থমাস্ ডাফ্ নামক স্কচ ব্যবসায়ী প্রথম এই জুট মিল তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
ধীরে ধীরে জুটমিলের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়। ব্যান্ডেল এর সাহাগঞ্জ অঞ্চলে তৈরী হয় একটি আমেরিকান জুট মিল ১৯২১ সালে। সুন্দর পরিবহন ব্যবস্থা, সুলভ শ্রমিক থাকা সত্বেও জুটমিলটি স্থায়ী হয় না। কিছুদিন পর হস্তান্তরিত হয় সেটি, ডানলপ কোম্পানি কিনে নেয় ১৯৩৫ সালে এবং ঠিক একবছরের মাথায় তা পরিবর্তিত হয় ভারতের প্রথম বৃহদায়তন টায়ার তৈরী কেন্দ্র হিসাবে। ক্রমে গুরুত্ব বাড়তে থাকে এবং দ্রব্য সামগ্রীর মান আরও উন্নত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের সময় তার গুরুত্ব যায় আরও বেড়ে। সিঙ্গাপুর পতনের পর ডানলপ কোম্পানীর উপর ন্যস্ত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গনে টায়ার ও রাবার জাত বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী সরবরাহের দায়িত্ব। ধীরে ধীরে কারখানাটির নানা বিভাগ সংযোজিত হয়। বিভিন্ন ধরণের যানবাহনের টায়ার টিউব এর উৎপাদন তো আছেই এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয় ফোমের তৈরী গদি 'ডানলোপিলো', কনভয়ের বেল্ট সমেত নানা ধরণের বেল্ট, বিভিন্ন প্রকার সলিউশ দ্যব্য সামগ্রী ও পাইপ। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের প্রথম এরোপ্লেনের টায়ার তৈরী হয় এই কারখানায়।
কারখানা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আগত মানুষ জনের বসতি বৃদ্ধি পায় কারখানা সংলগ্ন কোম্পানির কোয়াটারগুলিতে। ২৩৮ একর ভূমি সমৃদ্ধ সেই অঞ্চলের জীবনযাপন এর মান বজায় রাখার উদ্দ্যেশ্যে তৈরী হয় স্কুল, হাসপাতাল, গ্রন্থাগার, সিনামা হল, খেলার মাঠ, সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র প্রভৃতি।

তবে আজ প্রায় অনেক দিন হল সেই বিশাল কারখানা চত্বর, মুখ লুকিয়েছে জঙ্গলের আড়ালে। ডানলপ বাঁচাও আন্দোলনেরও হয়েছে অনেক বছর তাও কোন সুরহা হয়নি। প্রচুর শ্রমিকরা হারিয়ে গেছে অন্ধকারে। পেটের দায়ে যে যেমন পেরেছে, এমনকি ফেরিওয়ালার কাজও বেছে নিয়েছে অনেকেই। তবে শ্রমিকরা এতদিনে জেনে গেছে, কারখানাও যেমন নেই, খুলবেওনা কোনদিন।
বাকিটা রাজনৈতিক নেতাদের ময়দান হিসাবে চিহ্নিত করাই যেতে পারে।
Source:
আনন্দবাজার পত্রিকা ২০১৮
বর্তমান পত্রিকা ২০১৩
গ্রন্থিক ১৯৮৬
Image Source:
Google এবং Facebook