সৌভিক রাজ: হুগলি জেলা বহুত্ববাদের আদি ভূমি। কত কত ভাষা, জাতি, ধর্মের মানুষ এখানে এসেছে, থেকেছে। সংস্কৃতির আদান-প্রদান ঘটেছে। পরদেশীদের উৎসবকে আপন করে নিয়েছে এই জেলা। তেমনই একটি উৎসব হল ফ্যাস্তা, যা ছিল ফরাসডাঙার গর্ব। বলা ভাল এটিই ছিল চন্দননগরের চতুর্দশ পাব্বন। আদতে ফ্যাস্তা ফ্রান্সের নিজস্ব উৎসব।
একদা চন্দননগরে ছিল ফরাসি উপনিবেশ, ফরাসি শাসনের অধীনে থাকা চন্দননগরেও ধুমধাম করে পালিত হত ফ্যাস্তা। চন্দননগরবাসী আপন করে নিয়েছিল এই উৎসবকে, রীতিমতো একাত্ম হয়ে গিয়েছিল তাঁরা।
“ফ্যাস্তা” পালন করা হত ফি বছর ১৪ জুলাই। ফরাসিরা একে বলত “লা ফেত ন্যাশিওনাল", ফরাসি শব্দ ফেত বা ফ্যাত থেকে ফ্যাস্তার জন্ম। এর অর্থ উৎসব। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের বাস্তিল দুর্গের পতন হয়, যা ফরাসি বিপ্লবের এক স্মরণীয় দিন। ১৪ জুলাইকে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসানের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, বাস্তিল দুর্গের পতনের ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৮৮০ সালে ১৪ জুলাইকে ফ্রান্সের প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে পালন করা শুরু হয়। ফ্রান্স এবং সে'দেশের উপনিবেশগুলোতে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ১৪ জুলাই দিনটিকে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করা হত। ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরেও নানা অনুষ্ঠান হত।
ভোরবেলায় একুশবার তোপধ্বনি দিয়ে ফ্যাস্তার উদ্বোধন হত। মেরির মাঠে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ হত। তা দেখতে ভিড় জমাত জনতা। রাস্তাঘাট, বাজার সব সাফাই করা হত। এদিন পুরো স্ট্র্যান্ড রোড ফরাসি পতাকা ও নীল, সাদা, লাল ফুল দিয়ে সাজানো হত। পতাকা, ফুল, আলো দিয়ে সরকারি অফিস, ভবন সাজানো হত। ফরাসি নাগরিকরাও নিজেদের বাড়ি সাজাত। চন্দননগরজুড়ে চলত উৎসবের আমেজ।
আগের দিন অর্থাৎ ১৩ জুলাই অনুষ্ঠান শুরু হত। মেয়রের কার্যালয় থেকে অনাথ ও দুঃস্থদের দান করা হত। তারপর সন্ধ্যে ছ'টায় তোপ ধ্বনি করা হত। পরদিন ভোর ছ'টায় একুশবার তোপ ধ্বনির মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠানের সূচনা হত। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংয়ে সরকারি অনুষ্ঠান হত। সেখানে মেয়র, অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও শহরের গণ্যমান্যরা উপস্থিত থাকতেন। সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না।
নানান রকমের মজার খেলা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বাইচ প্রতিযোগিতা ও সন্ধ্যায় আতশবাজি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হত। মেলা বসত। তদানিন্তন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংয়ের সামনে যাবতীয় আমোদ অনুষ্ঠানের আয়োজন হত। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল চর্বি মাখানো মাস্তলে চড়া। পনের-কুড়ি ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মান্তল মাটিতে খাড়া করে দাঁড় করানো হত, অবশ্যই মাটিতে প্রথিত থাকত। মাস্তলে মাখানো হত চর্বি। মাস্তলের মাথায় একটি ঘুরন্ত চাকা থাকত, সেই চাকা থেকে ঝুলত নানা পুরস্কার, জামা, কাপড়, ছাতা, জুতো, থলে-সহ লোভনীয় কিছু জিনিস। মাস্তুল বেয়ে উঠতে পারলেই মিলত সেই পুরস্কার। প্রতিযোগীরা মাস্তুল বেয়ে উঠতে চেষ্টা করত কিন্তু চর্বি মাখানো থাকায়, বার বার পিছলে পড়ে যেত, তাই দেখে জনতা মজা পেত, রীতিমতো হেসে লুটোপুটি খেত।
শেষে চর্বির পিচ্ছিলভাব কেটে গেলে কেউ কেউ জিনিসগুলো নিতে পারত। আবার আরেকটি মাস্তুলে লাঠি ছুড়ে জিনিস নিতে হত। এমনভাবে সেটি তৈরি করা হত যে ভুল জায়গায় লাঠি ছুড়লে বা লক্ষ্যভেদে বিফল হলে বালতি সমেত জল প্রতিযোগীর মাথায় পড়ত। তাতেও আনন্দ নিত সমবেত জনতা। বড় বড় পেল্লাই হাঁড়িতে মুখ ঢুকিয়ে মুদ্রা বের করে আনতে হত, কিন্তু হাঁড়িতে থাকত ময়দা, সেটা আবার প্রতিযোগীদের মুখে, চোখে লেগে যেত। এ'সব খেলা ছিল ফ্রান্সের গ্রাম্য খেলা।
একটা খেলা ছিল বস্তা দৌড় প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগীকে বস্তায় ঢুকে লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়তে হত। অনেকেই তা করতে গিয়ে পড়ে যেত আর দর্শক খুব মজা উপভোগ করত। আবার একটা খেলা হত যেখানে মাঝ গঙ্গায় হাঁস ছেড়ে দেওয়া হত, প্রতিযোগীদের সাঁতরে তা ধরে নিয়ে
আসতে হত। এমন খেলা ডাঙাতেও হত, সেখানে হাঁসের বদলে থাকত শুকর ছানা। নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতাও হত। আরও নানাবিধ বিনোদনের আয়োজন থাকত। রাত আটটার সময় বাজি পোড়ানো হত। যা দেখার জন্য গঙ্গার তীরে লোক সমাগম হত। জোড়া ঘাটের চাদনি মহিলা ও বাচ্চাদের জন্য সংরক্ষিত থাকত, তাঁরা সেখানে বসে বাজি পোড়ানো দেখত। শেষ ফ্যাস্তা উৎসব হয়েছিল বাস্তিল দুর্গের পতনের দু'শো বছর পূর্তিতে, ১৯৮৯ সালে। তারপর থেকে এই উৎসব কার্যত বন্ধ, তবে আজও ফরাসডাঙার ইতিউতি দেখা মেলে ফরাসিদের স্মৃতিচিহ্নের।
তথ্যঋণ: সমসাময়িক বিভিন্ন পত্রিকা