Hooghly Series:হুগলির ব্যান্ডেলে জহর ব্রতের আগুনে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন পর্তুগিজরমণীরা ! - Pralipta


সৌভিক রাজ:মানুষ যেদিন থেকে আগুন আবিষ্কার করল, সেদিন থেকে এগোল সভ্যতা। আস্তে আস্তে আগুন হয়ে উঠল মানব সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য উপাদান, আত্মরক্ষা করতেই মানুষ আগুনকে প্রথম ব্যবহার করেছিল। কখনও হিংস্র পশু থেকে বাঁচতে আবার কখনও হিংস্র মানুষ থেকে বাঁচতে, ঠিক যেমন জহর ব্রত। নিজ সম্মান রক্ষার জন্য নারীর আত্মবলিদানই হল জহর ব্রত। সংস্কৃত জতুগৃহ থেকে জহর শব্দের উৎপত্তি। আবার ফার্সি শব্দ ‘জউহর’ থেকেও জহরের বুৎপত্তি হতে পারে, যার অর্থ পুণ্য বা সতীত্ব। প্রাচীন ভারতে জহর ব্রত প্রচলিত ছিল। দেশীয় রাজাদের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকত। জয়ী রাজা, পরাজিত রাজার রাজ্য এমনকি তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের স্ত্রীলোকদের নিজেদের অধীনে ঠাঁই দিত। 

সম্মান বাঁচাতে যুদ্ধে পরাজিত রাজার পরিবারের স্ত্রীলোকেরা সন্তান-সহ নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতেন। যাঁরা প্রাণ বিসর্জন দিতেন, তাঁদের অর্থাৎ নারীদের বলা হত জহর-সতী। রাজপুতদের মধ্যে এই প্রথা ছিল। আলাউদ্দিন খলজির হাত থেকে রেহাই পেতে রানি পদ্মিনী আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। প্রাচীন বঙ্গদেশেও জহর ব্রত পালিত হয়েছে। বল্লাল সেনের আমলে হানাদারদের হাত থেকে সম্মান বাঁচাতে রাজপরিবারের নারীরা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। 

বর্ধমান রাজবাড়িতেও জহর ব্রত পালিত হয়েছিল। তখন দিল্লি সামলাচ্ছিলেন ঔরঙ্গজেব, রাজা কৃষ্ণরাম রায় বর্ধমানের সিংহাসনের দায়িত্বে। বিষ্ণুপুরের রাজা গোপাল সিংহ চিতুয়া, বরদার জমিদার শোভা সিংহ এবং চন্দ্রকোনার জমিদার রঘুনাথ সিংহ, ওড়িশার আফগান সর্দার রহিম খাঁ যৌথভাবে কৃষ্ণরামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে।
কৃষ্ণরাম পরাজিত ও নিহত হন। শোভা সিংহ কৃষ্ণরাম রায়ের নারীদের বন্দি করেন। নারীরা সতীত্ব রক্ষার জন্য স্বেচ্ছায় বিষপান করে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। অর্থাৎ কেবল আগুনে ঝাঁপ নয়, সতীত্ব রক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জনই জহর ব্রত। 

ভারতের মাটিতে পর্তুগিজরমণীরাও জহর ব্রত পালন করেছিলেন। তা ইতিহাসের স্বল্প আলোচিত অধ্যায়। ১৬২৭ সন জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর শাহজাহান বসলেন সিংহাসনে, সংকল্প নিলেন পর্তুগিজদের ক্ষতম করবেন তিনি। পর্তুগিজরা ততদিনে হুগলিতে জাঁকিয়ে বসে গিয়েছে। শাহজাহান ও পর্তুগিজদের শত্রুতার কারণ ছিলেন জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীরকে সিংহাসনচ্যুত করতে শাহজাহান পর্তুগিজদের সাহায্য চেয়েছিলেন কিন্তু পাননি। এমনকি শাহজাহান সিংহাসনের বসার পরেও পর্তুগিজরা কোনও সওগাত পাঠায়নি। বাংলার তদানিন্তন নবাব কাশিম খাঁ ছিলেন শাহজাহানের খাতিরের লোক। ১৬৩১-শে শাহজাহান ব্যান্ডেল আক্রমণ করেন। ওই বছর ২৪ ডিসেম্বর, পর্তুগিজরা তখন উপাসনায় ব্যস্ত, বিশ্বাসঘাতক মেল্লোরের সাহায্যে দূর্গর পিছন দরজা দিয়ে মোঘল সৈন্যদল আক্রমণ করে। নারী ও শিশুরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ভিনদেশি রমণীরা বুঝতে পারেন, এবার তাঁদের জায়গা হতে চলেছে মোঘল হারেমে। মুসলমান সৈন্যরা তাঁদের ছিঁড়ে খাবেন, এমন অবস্থায় জনৈকা বৃদ্ধা সোফিয়া ক্রুজ বলেন; ভয় পেয়ে লাভ নেই। দূর্গের দু'শো সেনা, লক্ষাধিক মোঘল সেনাদলকে ঠেকাতে পারে না কোনও মতেই। তখনই হিন্দুরমণীদের মতো পথ অবলম্বনের কথা বলেন সোফিয়া। এক মাত্র উপায় আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন। সে'সময় জীবনের চেয়েও সম্মানকে বেশি মূল্য দিয়েছিলেন পর্তুগিজরমণীরা। 

পরদিন হুগলির ব্যান্ডেলে ভাগীরথীর তীরে সুবিশাল অগ্নিকুন্ড জ্বলে উঠল। একশো জন পর্তুগিজ নারী তাতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। জহর ব্রতের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন ভিনদেশি কয়েকজন নারী। নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে, তাঁদের এই আত্মবলিদান প্রচলিত ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এ দেশের মাটি, আজও তাঁদের পবিত্রতার সাক্ষী। 


তথ্যঋণ: হুগলি জেলা বিষয়ক প্রাচীন পত্র, পত্রিকা