পিয়ালী গোস্বামী, হুগলী, ২৯শে জুলাই ২০২০ :
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন এক মনীষী আবির্ভূত হয়েছিলেন, যিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে পরিচিত। আজ এই মহান মানুষটির ২০০তম প্রয়ান বার্ষিকী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে প্রতিটি নারীমুখ আজ উজ্জ্বলিত।
তিনি একদিকে পন্ডিত, অপরদিকে সমাজ সংস্কারক ও মানবতাবাদী। আবার তিনি ভারতীয় নবজাগরনের এক জলন্ত প্রতিমূর্তি। তাঁর মধ্যে ছিল নবজাগরণের প্রবল যুক্তিবাদিতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ভাবাদর্শের এক অপূর্ব সমন্বয়ী মনোভাব। সেক্ষেত্রে তিনি সংস্কৃত পন্ডিত হয়েও ইংরাজি শিক্ষা সভ্যতাকে সাদরে বরন করে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে "এই ভীরুদেশে তিনিই ছিলেন একমাত্র পুরুষ সিংহ।" মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মধ্যে দেখেছিলেন এমন এক মানুষকে "যাঁর মনীষা প্রাচীন ঋষিদের মতো, কর্মদক্ষতা ইংরেজদের মতো এবং হৃদয়বত্তা বাঙালী জননীর মতো।" ড. অমলেশ ত্রিপাঠী তাঁকে "একজন ঐতিহ্যবাহী আধুনিকতাবাদের প্রবক্তা (A Traditional Moderniser)" বলে অভিহিত করেছেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রথম জীবন থেকেই বুঝেছিলেন অশিক্ষা, কুশিক্ষা, প্রথা সংস্কার ক্ষুদ্র স্বার্থ বুদ্ধি নিয়ে ভরে আছে বাঙালীর সমাজজীবন। বিদ্যাসাগর যখন তাঁর কর্মজীবন শুরু করলেন তখন তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল এই নড়বড়ে দেশ ও সমাজের প্রতি, নারী জাতির অবহেলার প্রতি। তাঁর সেবামূলক কাজের প্রথমটা হল শিক্ষার প্রণালীকে সমাজমুখী করে তোলা। বিদ্যা মহৎ, বিদ্যা অনন্ত- এটাই ছিল তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য।
১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়ে তিনি শিক্ষা সংস্কারের কাজে ব্রতী হন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, শিক্ষাই অন্ধকার দূর করে মানুষকে প্রকৃত মনুষ্যত্বে পৌঁছে দেয়। তিনি লর্ডহার্ডিঞ্জ এর সহযোগীতায় বহু স্কুল স্থাপন করেন। বিভিন্ন জেলার ২০টি মডেল স্কুল বা আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন এর পৃষ্ঠপোষকতায় 'হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা হয়। গ্রামাঞ্চলে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন এর প্রতিষ্ঠাতা তিনিই। এইভাবে তিনি নারী শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি 'বাল্যবিবাহ', 'বহুবিবাহ' বন্ধ ও 'বিধবাবিবাহ' প্রবর্তনের পক্ষে সোচ্চার হন।
প্রথমে আসি বাল্যবিবাহের কথায়। বাল্যবিবাহ তখন এদেশে প্রচুর হত, যা তুলনায় কম হলেও আজও অনেক হয়। এ বিষয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেছেন "বাল্যকালে বিবাহ হওয়াতে বিবাহের সুমধুর ফল যে পরস্পর প্রণয় তাহা দম্পতিরা কখনও আস্বাদ করিতে পায় না, সুতরাং পরস্পর স-প্রণয়ে সংসার যাত্রা নির্বাহকরণ বিষয়েও পদে পদে বিড়ম্বনা ঘটে। আর পরস্পরের অত্যন্ত অপ্রীতিকর সম্পর্কে যে সন্তানের উৎপত্তি হয়, তাহাও তদনুরূপ অপ্রশস্ত হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা। আর নববিবাহিত বালক-বালিকারা পরস্পরের চিত্তরঞ্জনার্থে রসালাপ, বিদগ্ধতা, বাকচাতুরী, কামকলাকৌশল প্রভৃতির অভ্যাসকরণে ও প্রকাশকরণে সর্বদা সযত্ন থাকে এবং তদ্বিষয়ে প্রয়োজনীয় উপায় পরিপাটী পরিচিন্তনেও তৎপর থাকে, সুতরাং তাহাদিগের বিদ্যালোচনার বিষম ব্যাঘাত জন্মিবাতে সংসারের সারভূত বিদ্যাধনে বঞ্চিত হইয়া কেবল মনুষ্যের আকার মাত্রধারী, বস্তুতঃ প্রকৃতরূপে মনুষ্য গণনায় পরিগণিত হয় না।"
বিদ্যাসাগর চিন্তায় যে কতখানি আধুনিক ও বাস্তববাদী ছিলেন তা তাঁর জীবন দর্শন থেকেই বোঝা যায়। তিনি ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে 'সর্বশুভকারী সভা'-র মুখপত্র "সর্বশুভকারী" পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় 'বাল্যবিবাহের দোষ' শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।তিনি বহুবিবাহের বিরুদ্ধেও খড়গহস্ত ছিলেন। ১৮৫৫ খ্রিঃ বহুবিবাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে ৫০ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত এক আবেদন পত্র সরকারের কাছে পাঠিয়েছিলেন। ১৮৭১ খ্রিঃ এ সম্পর্কে দুটি পুস্তক প্রকাশ করেন ও প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন যে 'বহুবিবাহ অশাস্ত্রীয়'। এইভাবে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সংস্কার ও শিক্ষাবিস্তারের ফলে বহুবিবাহের প্রকোপ বহুলাংশে হ্রাস পায়।
এরপর আসি বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের সংগ্রামের কথায়। তিনি এই সংগ্রামে ধর্মশাস্ত্রকে ব্যবহার করে যুক্তি দিয়ে আইন পাশ করেছিলেন। কেননা তিনি বুঝেছিলেন যে শুধুমাত্র আইন ব্যবহার করে নয়, ধর্মশাস্ত্রকে ব্যাখ্যা করে বিধবা বিবাহ যে শাস্ত্রসম্মত তা প্রমাণ করেছিলেন। এই বিষয়ে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে প্রশ্ন করা হল "তিনি কেন বিধবা বিবাহের পক্ষে শাস্ত্র ব্যাখ্যার আশ্রয় নিলেন? "
উত্তরে তিনি বলেন, "যদি যুক্তিমাত্র অবলম্বন করিয়া ইহাকে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন কর, তাহা হইলে এতদেশীয় লোকে কখনই ইহা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিবেন না। যদি শাস্ত্রে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাহারা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে এবং তদনুসারে চলিতে পারেন। এরূপ বিষয়ে এদেশের শাস্ত্রই সর্বপ্রধান প্রমাণ, এবং শাস্ত্র সম্মত কর্মই সর্বতোভাবে কর্তব্যকর্ম বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। অতএব বিধবাবিবাহ শাস্ত্র সম্মত অথবা শাস্ত্র বিরুদ্ধ কর্ম, ইহার মীমাংসা করাই সর্বাগ্রে আবশ্যক।" এ থেকেই বোঝা যায় তিনি কতটা কঠোর বাস্তববাদী ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, "দুর্ভাগ্যক্রমে যাহারা অল্প বয়সে বিধবা হয়, তাহারা যাবজ্জীবন যে অসহ্য যন্ত্রনা ভোগ করে, এবং বিধবা বিবাহের প্রথা প্রচলিত না থাকাতে, ব্যাভিচারদোষের ও ভ্রুণহত্যার স্রোত যে উত্তরোত্তর প্রবল হইয়া উঠিতেছে, ইহা বোধ করি, চক্ষুকর্ণ বিশিষ্ট ব্যাক্তিমাত্রেই স্বীকার করিবেন।"
কী গভীর মর্মবেদনা! এই নিষ্ঠুর বাস্তব সংকটের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তিনি। তাঁর বিখ্যাত একটি ঐতিহাসিক উক্তি - "স্ত্রী জাতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সামাজিক নিয়মদোষে পুরুষজাতির নিতান্ত অধীন।" তিনি ১৮৫৫ খ্রিঃ বিধবা বিবাহ প্রচলন উচিত কিনা এ বিষয়ে দুটি পুস্তক লেখেন। ১৮৫৬ খ্রিঃ ১৬ই জুলাই লর্ড ডালহৌসির সহযোগীতায় 'বিধবা বিবাহ আইন' পাশ করেন। নিজ পুত্র নারায়নচন্দ্রের সাথে এক বিধবা পাত্রীর বিবাহ দেন। তিনি একটা কথা স্বীকার করেন যে, "বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম।"
অবশেষে বলা যায় যে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের যুগে সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারক বিদ্যাসাগর মহাশয় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছেন। তাই বলা যায়, এ যুগ "বিদ্যাসাগরের যুগ"। নবজাগরিত ছিল প্রজ্জ্বলিত আলোর অংশ আর এই আলোর স্ফূলিঙ্গ বিদ্যাসাগর স্বয়ং এবং নারী জাতি আশান্বিত বাঙালীর আলোক শিখা যা ভবিষ্যত প্রজন্মের ভিত্তি স্তম্ভ।