ইয়েটসীয় ভাব ও ভাষায় জীবনানন্দ - Pralipta

দেবাংশু ঘোষ : জীবনানন্দের কাব্যের ধারাবাহিক আলোচনা এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়, জীবনানন্দ নজরুল সমসাময়িক হয়েও কিছুকাল পরে বাংলা কাব্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রথম পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা মোহিতলালের দেহচেতনা তাঁকে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করেছিল। রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে এসে নজরুল যখন নতুন পথে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত জীবনানন্দ তখনও কাব্যভাষা খুঁজে চলেছেন নানাভাবে। এমনকি অচিন্তকুমার সেনগুপ্তকেও তিনি নিজের কবিতায় এরকম অনুবাদ করে নিচ্ছেন। যেমন অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন—
 
"আমার পরাণে তাই
কোটি মানবের অশ্রুজলের জোয়ার শুনিতে পাই।"

একইভাবে জীবনানন্দ লিখেছেন—

"লভিয়াছ বুঝি ঠাঁই
আমার চোখের অশ্রুপুঞ্জে নিখিলের বোন ভাই।"

কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি পাশ্চাত্যেও পাড়ি দিয়েছেন এবং গভীরভাবে প্রভাবিতও হয়েছেন। বোদলেয়ার এলিয়ট এবং বিশেষ করে তাঁকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিলেন যিনি তনি ইয়েটস। ইয়েটসকে তিনি একরকম তাঁর কবিতায় যেন ভাবানুবাদ করতে থাকলেন। ইয়েটস তখন যে আঙ্গিকে লিখতেন জীবনানন্দও প্রায় অনেকটাই তা অনুসরণ করলেন। আসলে ইয়েটসের কবিতা যথার্থ অনুবাদ করলে যে স্টাইলাইজেসন চোখের সামনে ভেসে উঠে। এলিয়টের "The Waste Land"– এর দ্বারা সে সময় বিশেষ করে তিরিশের কবিরা যথার্থ প্রভাবিত হয়েছিলেন। যদিও ওয়েস্টল্যান্ড শৈল্পিকগতভাবে তেমন স্পকৃষ্ট পর্যায়ের নয় তবু্ও। এলিয়ট "The Waste Land"– এর চিত্রকল্পে যা দৃশ্যায়িত করেছিলেন জীবনানন্দ তা দৃশ্যায়িত করেছেন হেমন্তের চিত্রকল্পে।

কবি স্বভাবতই আন্তর্জাতিক চরিত্রকে এবং উপলব্ধি করবেন কিন্তু তাকে অনুকরণ করা কিংবা ভবানুবাদেও গ্রহণ করার অর্থ মৌলিকতাকে উদ্ভাসিত হতে না দেওয়া। তিরিশের প্রায় সব কবিরাই পাশ্চাত্য সভ্যতার আদর্শ ও রীতিনীতিতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন শুধু তা নয় পরম বিশ্বাসীও হয়ে পড়েছিলেন। মৌলিকতার প্রকাশের ক্ষেত্রে এ জিনিস অনেক সময় বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
 
জীবনানন্দের সমসাময়িক নজরুল তিনি ভারতীয় ঐঐতিহ্যের পরম্পরায় থেকেও রবীন্দ্র বলয় থেকে মুক্ত হয়ে একেবারে কণ্ঠে গানে কী কবিতায় এক নতুন যুগের ডাক দিলেন— যা জীবনের পরম্পরায় চিরশাশ্বত। মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা সর্বক্ষণ, দেশে দেশে যুগে যুগে বিপ্লব বিদ্রোহ যতদিন নজরুলের কবিতা, গান মানুষের হৃদয়ে ততদিন। রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হয়েছিলেন এমন প্রতিভাবানকে দেখে এবং বলেছিলেন— সব থেকে বড় কথা নজরুল নতুন এই স্বদেশিকতার মধ্যে কোনো খাদ ছিল না – একথা যতটা না বলার তার থেকেও বড় কথা স্বদেশিকতার এমন জোর ও তেজ সকল কবির মধ্যেই তা সে সময় ছিল। স্বদেশিকতার এই প্রবল জোর ও তেজ এবং মানসিকতার সম্পূর্ণ বিকাশ না থাকলে জাতীয় কবির সিদ্ধি আসা সম্ভব নয়। শুধু কাব্য সুষমা দিয়ে একটা জাতির হৃদয় কাঁপিয়ে দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়।
 
জীবনানন্দ নানা স্তরে কাব্যভাষা খুঁজতে খুঁজতে স্থির হলেন ইয়েটসের দরবারে। আগেই বলেছি ইয়েটসের কবিতার কাব্যভাষা জীবনানন্দ শোষণ করেছিলেন এবং তার থেকে বেরিয়ে আসতেও পারেনি। ইয়েটসের "He Reproves the curlew"— কবিতাটি পড়া যাক 

"O curlew, cry no more in the air,
Or only to the waters in the west;
Because your crying brings to my mind
Passion-dimmed eyes and long heavy hair
That was shaken out over my breast;
There is enough evil in the crying of wind."

'The Dawn'– কবিতাটির কিছু অংশ স্মরণ করা যাক–

I would be for no knowledge in worth a straw and wanton as the dawn.
এসব পড়ে পোস্টমর্ডানিজমের ফিকিরবাজিরা দারুণ উৎসাহ পেয়ে যান আর বলেন– এ হচ্ছে পোস্টমর্ডানের মূল কথা অর্থাৎ 'অভিন্নতার দিকে যাত্রা' সমাজবাদীরা একে নাম দেন আধুনিক জীবন থেকে ক্লান্ত মনোরথে পালিয়ে যাওয়া।
            সে যাইহোক, যেটা বলার; ইয়েটস কী দারুণভাবে কী ভীষণ পীড়াদায়কভাবে জীবনানন্দকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছিলেন তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।

ইয়েটস বা এলিয়টই শুধু নয় তার মগজ ধোলাই করেছেন এডগার অ্যালানপোও, জীবনানন্দের বিখ্যাত কবিতা 'বনলতা সেন'– এ যে সৌন্দর্যবোধ, ইতিহাস চেতনা তাকে খুঁজে পাওয়া যায় এডগার অ্যালানপো-র 'হেলেনের প্রতি' কবিতায়। প্রাচীন ও বর্তমানের সেতু রচনা এলিয়ট বা পো - এর মতো জীবনানন্দেরও মূল উপজীব্য।  পো- লিখেছেন – "They hyacinth hair, they clasic face" – তেমনি জীবনানন্দ লিখেছেন 'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য ' (classic face).

পাশ্চাত্যের এই সব কবিদের প্রভাব ছাড়াও এ সময় ফ্রান্সে সুরারিয়ালিজয় নিয়ে বেশ হৈ চৈ হয়। তিনি তাঁর দ্বারাও যথেষ্ট প্রভাবিত হন এবং তিনিই প্রথম বাঙালি কবি যিনি এই বোধ বাংলা কবিতায় সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই মূল সূত্র ফ্রয়েডীয় মনোস্তত্ত্বের অবচেতন স্তর। সুরারিয়ালিজ পর্বে ঐ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং এই বোধ বা দর্শন যে বুর্জোয়া মানসিকতার ফসল তা আজ নতুন করে বলার কিছু নেই। এই সুরারিয়ালিজমের জোরালো প্রভাবের জন্য জীবনানন্দের অনেক কবিতা দুরাধিগম্য কখনো বা দুর্বোধ্য। তবে সুরারিয়ালিজম - এর অন্যতম দাস fantasy আর এই fantasy থেকে জীবনানন্দ অনেক কবিতাই লিখেছেন, যা বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ।

স্বপ্নের ভেতর বুঝি ফাল্গুনের জ্যোৎস্নার ভিতরে দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে হরিণেরা। বিশ্বাসযোগ্য হোক বা না হোক পংক্তিগুলির আকর্ষণ ক্ষমতা প্রশ্নাতীত। সুরারিয়ালিজমের প্রভাবে তিনি অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। সুরারিয়ালিস্টদের লক্ষ্য যেহেতু অবচেতনের অন্ধকার জগৎকে তুলে এনে স্বয়ংক্রিয় স্বতঃস্ফূর্ততার স্বচ্ছন্দে প্রকাশ করা তাই তাঁদের লেখা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুরুহ হয়ে উঠত এবং দুর্বোধ্যও। তাই এদের লেখায় সর্বদা যুক্তির পারম্পর্য লক্ষ্য করা যেত না। এই Super reality বা পরবাস্তবতার সার্থক প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় তাঁর কবিতায়। 'বনলতা সেন', 'হরিণেরা', 'শব', 'শ্রাবণ রাত', 'অবশেষে' এমন অসংখ্য কবিতায় এই বোধ বা দর্শন লক্ষ্য করা যায়।
 
জীবনানন্দ জীবনের প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথ কিংবা অচিন্তকুমার প্রমুখর দ্বারা প্রভাবিত হলেন। পরবর্তীকালে ইয়েটস, পো, এলিয়ট বোদলেয়ার প্রমুখের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হলেন। এই প্রভাব কিন্তু শুধু বিষয় বা দর্শনের দিক থেকে ঘটে না এর পাশাপাশিও এসে পড়ে। কোনো লেখকই তাঁর লেখায় চাপিয়ে দেন না বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গেই ও তাঁর মধ্যে জারিত হয়ে যায় সমানভাবেই। বহির্জগতের কোনো স্বতন্ত্র বস্তু নয় তা তার হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে বিষয়ের সঙ্গেই প্রকাশিত হয়ে ওঠা এক রীতি। এরা একে অপরের সঙ্গে পরিপূরক। তাই জীবনানন্দ ইয়েটস, বোদলেয়া বা পো-র শুধু জীবনদর্শন বা বোধ-ই গ্রহণ করেননি তাঁদের বা স্টাইলেজশন ও গ্রহণ করেছেন। যেমন – 'O Cuckoo, cry no more in the air.' জীবনানন্দ লিখেছেন– তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে এক তো অনুবাদই বলা যায়। ইয়েটসের এই ভববীজ জীবনানন্দ সঙ্কোচে গ্রহণ করেছিলেন বাংলা কাব্যভাষাতে। এমনকি তিনি শেক্সপীয়রকে নানাভাবে ব্যবহার করেছেন তার কাব্যশরীরে। ইয়েটসের মনোজগতে ছিল চিরসবুজ আয়ার্ল্যান্ডের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি আর জীবনানন্দ সেখানে বসিয়ে নিলেন রূপসী বাংলার চির সবুজ বৈচিত্র্যময় জগৎটিকে। সুতরাং এও বলা যায় জীবনানন্দের যে রূপকল্পই কবিতার আত্মা সেই রূপকল্পের ভাব বীজ কিন্তু ইয়েটস আর পো-র মধ্যে থেকে তিনি নিজের মধ্যে জারিত করেছেন নিরবধিকাল।

আবার শঙ্খ ঘোষ আধুনিকতা যে শুনিয়েছেন তাতে জীবনানন্দ যে হয়ে উঠেছেন তা বলাই বাহুল্য। তিনি লিখলেন – 'আমি যে আধুনিকতার কথা ভাবি সেখানে মন্থর প্রসারাবৃত্তির কোনো মানে নেই, অবাধ কোনো প্রশ্রয় নেই। এই দুটি জিনিসই জীবনানন্দের কবিতায় লক্ষ্য করা যায় বিশেষ করে 'মন্থর' প্রসারবৃত্তির অবকাশ অনেক বেশি। তবু বাংলা ভাষায় বাস্তবিক নতুন এক স্বাদ এনে দিয়েছিল "চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা" কিংবা "বেতের ফলের মতো ম্লান চোখ তার মনে আসে" - এর মতো বেশ কিছু পংক্তি। সত্তরের বিশিষ্ট কবি সুবোধ সরকার যথার্থই বলেছেন– আপনার ছাদে ফুটো ছিল, এবং জলও পড়ত। লোকে তো বলবেই এবং বলেওছে। তার থেকে বেরিয়ে আর একটা ভাষায় যেতে চেয়েছিলেন। এটা খুব বড় কাজ। আমি এই জায়গাটাকে সেলাম জানাই। জীবনানন্দের এই প্রয়াসের জন্য বাংলা ভাষার তাঁর কাছে চিরকাল নতজানু হয়েই থাকবে–একথা চরম সত্য। কিন্তু শুধু এই জোরে জাতীয় কবির সিদ্ধি পাওয়া যায় কী? তাতেই বা কী যায় আসে, তিনি তো আমাদের প্রাণের কবি। আম, জাম, হিজলের বনে সারাক্ষণ বুলবুলির মতো আমাদের গান শুনিয়ে চলেছেন। এও তো আমাদের পরম পাওয়া।