চন্দননগর - শহর গড়ে ওঠার কাহিনী - Pralipta

অনির্বাণ সাহা: ফরাসি উপনিবেশ আমাদের চন্দননগর শহরটির প্রাচীনত্ব খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে বিপ্রদাস পিপলাই রচিত "মনসামঙ্গল" বা দাশরথী রায়ের পাঁচালী বা অন্যান্য প্রাচীন কাব্যগ্রন্থে। এছাড়াও পরবর্তীতে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ফিলিপ ডেভিস সপ্তগ্রাম বন্দরের পতনের পরের হুগলি নদীর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এই শহরের নাম উল্লেখ করেন। এই শহরের নামকরণ নিয়েও রয়েছে অনেক যুক্তি-তর্ক ও মতবিরোধ। 


banglalive.com ওয়েবপেজ ১৩ই এপ্রিল, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত "হুগলি নদীর বাঁকে মিনি ইউরোপ" শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, একদা ভারতের ও বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা শহর তথা বন্দর প্রতিষ্ঠার বেশ কয়েক দশক আগে গড়ে উঠেছিল বর্তমান ত্রিবেণীর কাছে সরস্বতী নদীর বুকে সপ্তগ্রাম নামক একটি বন্দর যা তৎকালীন যুগে বাংলার বাণিজ্যের মূল যোগসূত্র ছিল বহির্বিশ্বের সাথে। এই সরস্বতী নদী তৎকালীন সময়ে হুগলি নদীর চেয়ে ছিল বেশী স্রোতস্বিনী ও প্রাণচাঞ্চল। এই নদীর পূর্বে অবস্থিত হুগলি নদী ছিল ক্ষীণকায়া, পলি জমা এক প্রণালির মতো। এই নদীর তীরে তখন কিছু বিক্ষিপ্ত জনবসতি থাকলেও তাঁরা মূলত কৃষি নির্ভর ছিল। কিন্তু banglalive.com ওয়েবপেজ ১৩ই এপ্রিল, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত "হুগলি নদীর বাঁকে মিনি ইউরোপ" শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের লেখা "সপ্তগ্রাম অর সাতগাঁও" (এটি ১৯০৯ সালে "জার্নাল অফ দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়) প্রবন্ধে উল্লেখিত হয়েছে ১৫০৫ সালে এক প্রবল ভূমিকম্পের ফলে ভূমির ঢালের পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে সরস্বতী নদীর নাব্যতা হটাৎ কমে গিয়ে পলি জমতে শুরু করে ফলে সপ্তগ্রাম বন্দর তার গুরুত্ব হারাতে থাকে উল্টোদিকে হুগলি নদীর নাব্যতা বেড়ে গিয়ে এই নদী হয়ে ওঠে স্রোতস্বিনী ও প্রাণচাঞ্চল, এর বিভিন্ন তীরে গড়ে উঠতে থাকে ছোটো-বড় কিছু বন্দর। এই ঘটনাটিকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় "রিভার সোয়াপিং" বলে উল্লেখ করেন, যা বিশ্বে একটি বিরলতম ঘটনা। এরপরই পূর্বের হুগলি নদীর তীরবর্তী স্থান ও সেখানকার ছোটো ছোটো জনবসতিগুলি ধীরে ধীরে প্রথমে পল্লী বা পাড়া তারপর গ্রাম ও তারপর শহরের রূপ নেয়। তাদের মধ্যে মূলত বোড়, খলিসানি ও গোন্দলপাড়া এই তিনটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম নিয়ে ও বোড়াইচণ্ডী মন্দিরকে (চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত) কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আমাদের প্রিয় শহর চন্দননগর হলো অন্যতম। 
রিভার সোয়াপিংয়ের ফলে হুগলি নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পায় ফলস্বরূপ এই অঞ্চলে বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তির আনাগোনা বেড়ে যায়। সর্বপ্রথম হুগলি অঞ্চলের তাদের ঘাঁটি প্রস্তুত করে পর্তুগীজরা, তৎকালীন সময়ে তারা ছিল প্রভূত শক্তিশালী। ১৬৩২ সালে মোঘলদের সাথে যুদ্ধে পর্তুগীজরা সম্পূর্ণ পরাস্ত হয় ও মোঘলরা এই অঞ্চলটির দখল নেয়। শহরের বিশেষ কিছু স্থানে গড়ে ওঠে তাদের পল্লী। এর মধ্যে উল্লেখ্য হল - বর্তমানের তিলিঘাট সন্নিকটবর্তী অঞ্চল (অঞ্চলটি সুতা প্রস্তুত ও বাণিজ্যে খ্যাত ছিল, এখানে তারা একটি মাজারও প্রস্তুত করে বলে জানা যায়), খলিসানির বিলকুলি (তৎকালীন আঞ্চলিক মোঘল নবাব দয়াবীজ খাঁ ও তাঁর বেগমের কবরখানা ও মসজিদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যা এখনও বর্তমান), গড়বাটি প্রভৃতি। এর সমসাময়িক সময়ে বা কিছু বছর পর গোন্দলপাড়া স্থিত একটি অংশে (বর্তমানের দিনেমারডাঙ্গা) দিনেমার বা ড্যানিসরা তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে ও বসতি গড়ে তোলে। তারা সেখানে মূলত কৃষিকাজ ও কৃষিজাতদ্রব্যের ব্যবসা করত, এছাড়াও তারা ছোট-বড় কিছু কাঁচা-পাকা বসতবাড়ি, নদীর ঘাট প্রস্তুত করে। দীর্ঘ ৪০ বছর পর ১৬৭৩ সালে মোঘল নবাব শায়েস্তা খাঁয়ের কাছ থেকে ডুপ্লেসি নামক এক ফরাসি নাবিক তৎকালীন বোড় কিষাণপুরে ৪০১টাকায় ২০অরপাঁ (৬০ বিঘা) জমি কিনে নেয় ব্যবসা জন্য। ব্যবসায় মুনাফা না করতে পেরে তিনি ফিরে যান। ১৬৮৬ সালে তৎকালীন ব্রিটিশরা হুগলির মোঘল ফৌজদারকে পরাস্ত করে নতুন চুক্তির মাধ্যমে এলাকার দখল নেয়। গবেষকরা মনে করেন উক্ত সময়ে বেশকিছু গ্রামবা পল্লীর খোঁজ পাওয়া যায় সেগুলি হল - দেবীপুর, প্রসাদপুর, মহেশপুর, সাবিনাড়া (পূর্ববর্তী নাম সাফ-ই-নারা), দুর্গাপুর প্রভৃতি। ব্রিটিশদের মোকাবিলা ও নিজেদের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে ১৬৮৮ সালে মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব দেলতর নামক এক ফরাসি নাবিককে ৪০হাজার টাকায় ৯৪২একর জমিতে ব্যবসা ও কুঠি স্থাপনের অনুমতি দেন। পরবর্তীতে ১৬৯৩ সালে ফরাসি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্রাটের থেকে অবাধে বাণিজ্য ও কুঠি স্থাপনের অধিকার পায়। তখন থেকেই গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন পল্লী ও একটি ছোটো বন্দরও (মূলত কৃষিজাত দ্রব্য, সুতা, বস্ত্র, নীল ও অন্যান্য সামগ্রী আমদানি-রপ্তানি করার জন্য, এছাড়াও শোনা যায় চন্দন কাঠের ব্যবসাও নাকি হতো এখান থেকে) গড়ে তোলা হয়। এরপর ১৬৯৬ সালে ফরাসিরা মূলত নিজেদের ও নগরের সুরক্ষার কথা ভেবে গড়ে তোলে ফোর্ট দ্য অর্লেয়া নামক একটি দূর্গ। 

এর ফলস্বরূপ এখানকার তথা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষের মনে পরোক্ষে হলেও নিরাপত্তাজনিত নিশ্চিয়তা বাড়ে। 
ঠিক এই সমসাময়িক (১৬৯৫ ও তার পরবর্তী সময়ে) সময়ে তৎকালীন মেদিনীপুরের চেতুয়াবরদার (বর্তমানে ঘাটাল) বিদ্রোহী শাষক শোভা সিংহ বর্ধমান দখল করে। এরই সুত্র ধরে তাঁর অধীনস্থ রহিম খাঁয়ের সপ্তগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল দখল ও অত্যাচারের ফলে এবং এর পরবর্তী সময়ে বর্গী আক্রমণের ফলে সপ্তগ্রাম, হুগলি ও অন্যান্য পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে বহু মানুষ (মূলত কৃষক সম্প্রদায়ভুক্ত) এই শহরের দুর্গের নিকটবর্তী স্থানে ফরাসি ছত্রছায়ায় শুধুমাত্র নিরাপত্তার আশায় আশ্রয় নেয়। এদের বেশিরভাগই এই শহরের বিভিন্ন পল্লীতে বা অংশে পাকাপাকিভাবে বসতি গড়ে তোলে। এখানে চাষাবাদের বিশেষ অবকাশ না থাকায় চাষ ছাড়া তারা যেটা জানতো সেই কাপড় বোনা বা তন্তুবায় শিল্পের মাধ্যমে নিছক তাঁতী হিসাবে নিজ নিজ জীবিকা নির্বাহে ব্রতি হয়। এর সাথে সাথেই চন্দননগরে সূচনা হয় বস্ত্রশিল্পের। তৎকালীন সময়ে প্রধানত দাস, কুন্ডু, ভড় ও রক্ষিত এই চার পদবীধারীরাই এই বস্ত্রশিল্পের সাথে যুক্ত ছিল। এরসাথেই বস্ত্রশিল্পের বিভিন্ন সহযোগী বিভিন্ন কাজ করার জন্য বিশেষ বিশেষ কিছু পল্লীর উল্লেখ পাওয়া যায় সেগুলি হল - পাটতন্তু ও সুতা পরিষ্কার করার জন্য সাফ-ই-নারা (বর্তমানের সাবিনারা) অঞ্চল, সুতা ও কাপড় রং করার জন্য "কলাকার" শ্রেণীভুক্ত মানুষের বসতিপূর্ণ কাঁটাপুকুর অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের এই শহরে আশ্রয়গ্রহণের প্রবণতা প্রায় ১৬৯৯ সাল অব্দি বা তারপরেও অব্যাহত থাকে। ফলে এই শহর সমৃদ্ধ হয়, সৃষ্টি হয় ছোটো ছোটো জনবসতিপূর্ণ আরোকিছু পল্লীর ও সাথে সাথে ভিন্ন শ্রেণী, ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মেলবন্ধন ঘটে এই শহরে। "আমার শহর চন্দননগর" বইটি থেকে জানা যায় যে, উপরোক্ত দুটি কারণে ও অন্যান্য কিছু কারণে পার্শ্ববর্তী ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে এই শহরে আশ্রয়গ্রহণ করা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিবার হল -
-- সপ্তগ্রাম থেকে গৌরীসেনের পরিবারের একটি  শাখা (বর্গী অত্যাচার থেকে বাঁচতে)
-- বাঁশবেড়িয়া থেকে শ্রীমাণী পরিবার (বর্গী অত্যাচার থেকে বাঁচতে)
-- বাঁশবেড়িয়া থেকে দে পরিবার চন্দননগরের বারাসাতে আশ্রয় নেয় (বর্গী অত্যাচার থেকে বাঁচতে)
-- সপ্তগ্রামের কাপড় ব্যবসায়ী জগন্নাথ ভড় পরিবার (বর্গী অত্যাচার থেকে বাঁচতে)
-- সর্ব্বরাজাপুরগ্রাম থেকে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর পরিবার এই শহরে চলে আসে (পারিবারিক কারণে)
-- ধনিয়াখালি গ্রাম থেকে আনন্দ রক্ষিত বংশ (কারণ অজানা)
এভাবেই একসময়ের সেই ক্ষীণকায়া, পলি জমা এক প্রণালির সম হুগলি নদীর তীরে গড়ে ওঠা জনবসতিযুক্ত অঞ্চল থেকে পল্লী, পল্লী থেকে গ্রাম ও তারপর গ্রাম থেকে শহর গড়ে ওঠার প্রাথমিক পর্যায় পূর্ণ হল। বিভিন্ন ধর্ম (হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিষ্টান) ও বর্ণের মানুষের মেলবন্ধন ঘটল শহরে। ধীরে ধীরে সমাজের ভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে শ্রেণীবিন্যাস স্পষ্ট হলো। জীবন, জীবিকা ও নিরাপত্তার নিশ্চিয়তা সুনিশ্চিত হবার পরই ধীরে ধীরে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠতে থাকে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষদের ধর্ম উপাশণাগার। সেরকমই বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো - প্রায় ষোড়শ শতকে বর্তমান বারাসাত দশভুজা তলায় প্রতিষ্ঠিত হয় টেরাকোটা কাজ বিশিষ্ট দেবী দশভুজার মন্দির, ১৭২০ সালে তিব্বতের মিশনের যাজকদের দ্বারা নির্মিত হয় বর্তমানের সেন্ট জোসেফ কনভেণ্টের ভিতরের ক্যাথলিক চার্চ, ১৭৪০ সালে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন নন্দদুলাল জিউ মন্দির, ১৭৪৯ সালে হাজিবাগানে গড়ে ওঠে মোল্লা হাজি মসজিদ। এরপরবর্তী সময়েও আরো অনেক মন্দির, মসজিদ ও গির্জা এই শহরের বুকে গড়ে উঠেছে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পালপাড়া (১৮০৭) ও বারাসাতের (১৮৪৭) শিবমন্দির, উর্দ্দিবাজারের বড় মসজিদ (১৮৭৩), এবং রোমান ক্যাথলিক গির্জা (১৮৮৭)।

 এইসব মন্দির বা মসজিদের পার্শ্ববর্তী অংশে বেশকিছু পল্লী বা জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে ফলে উক্ত মন্দির বা অধিষ্ঠিত দেব-দেবী বা মসজিদের নামেই পল্লীটি বা অঞ্চলটি নামাঙ্কিত বা পরিচিত হয় বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। সেরকমই কয়েকটি পল্লী হলো - দশভুজাতলা, মনসাতলা, দু-মন্দিরতলা, উর্দ্দিবাজার, পাঁজারীপাড়া, মসজিদবাগান প্রভৃতি। এর ফলস্বরূপ তৎকালীন মানুষ জীবিকা নির্বাহের পর অবশিষ্ট সময় ধর্ম উপাশণায় মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে আরো নিবিড়ভাবে পরিচিত ও সংঘবদ্ধ হতে থাকে। এভাবেই তৎকালীন চন্দননগরে জনবসতি বা পল্লী গড়ে ওঠার পাশাপাশি ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও শ্রেণীগত মানুষদের আধিক্য ও সংগঠিত জনবসতি গড়ে ওঠতে দেখা যায়। যেমনঃ বাউরিপাড়া, ব্রাহ্মণপাড়া প্রভৃতি। 
শুধুমাত্র ধর্ম বা শ্রেণীগত কারণেই নয় তৎকালীন মানুষ নিজ নিজ পেশাগত কারণেও সংঘবদ্ধ হয়ে ভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে। গবেষকদের মতে তাদের পেশার দ্বারা নামাঙ্কিত হয়ে ওই অঞ্চলটি লোক সমাজে পরিচিত হয়ে ওঠে। সেরকমই কয়েকটি অঞ্চলের নাম হলো - জেলেপাড়া, কুমোরপাড়া, মেথরপাড়া প্রভৃতি। আবার অনেক সময়ে এও দেখা গেছে যে, কোনো একটি বিশেষ গাছকে কেন্দ্র করে জনবসতি গড়ে উঠেছে তখন ওই গাছটির নামেই অঞ্চলটি  পরিচিত হয়ে উঠেছে। এই শহরের সেরকম কয়েকটি অঞ্চল হলো - লিচুতলা, বটতলা, তেঁতুলতলা, অশথতলা প্রভৃতি। আবার অনেক সময়ে শহরের বিশেষকিছু বাজারকে কেন্দ্র করেও বেশকিছু পল্লী বা পাড়া গড়ে উঠতে দেখা যায়, সেসব পল্লী বা পাড়া ওই বাজারের নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে। যেমন :- লিচুপট্টি, চাউলপট্টি, স্বপ্নাবাজার, লক্ষ্মীগঞ্জ বাজার প্রভৃতি। 
শুধুমাত্র সংঘবদ্ধ জনবসতি, জীবিকা নির্বাহ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেই একটি শহরের নগর কাঠামো সম্পূর্ণ হয় না এরসাথে শহরের নিকাশি ব্যবস্থা, সীমা নির্ধারণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যতেও উন্নতিলাভ করতে হয় তবেই সেটি সঠিকমাত্রায় শহর গড়ে ওঠে। শহরের তৎকালীন ফরাসি শাষকরা নগরকাঠামো ও নগর সৌন্দর্যায়নের দিকে যথেষ্ঠ গুরুত্ব আরোপ করে। ১৭৬৬ সালে সঠিক নিকাশি ব্যবস্থার উদ্দেশ্যে শহরের নিচে দিয়ে একটি নর্দমা খনন করা হয়। অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তাঁর "চন্দননগরের সংক্ষিপ্ত পরিচয়" নামক বইতে উল্লেখ করেছেন যে, চন্দননগর শহরকে উপযোগী ও সৌন্দর্য্যমণ্ডিত করার জন্য উপনিবেশবাদী মানসিকতা নিয়ে জি. টি. রোডকে মাঝখানে রেখে তৎকালীন ফরাসি শাষকরা সমগ্র শহরকে দুটি অংশে বিভক্ত করে। পূর্বে সাদা অংশ বা Ville Blanche, এখানে পাকা নর্দমা, পাকা রাস্তা, পাকা বড় বাড়ি ও বাতি স্তম্ভ এবং পশ্চিমে কালো অংশ বা Ville Noire, এখানে কাঁচা নর্দমা, কাঁচা রাস্তা, মাটির বা ছাউনির বাড়ি দেখতে পাওয়া যেত। শহরের সীমারেখা চিহ্নিতকরন ও বাইরের শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য ১৭৬৭-৬৯ সালের মধ্যে শহরের সীমারেখা বরাবর চারিদিকে একটি গভীর গড় খনন করা হয়। শুধুমাত্র নগর সৌন্দর্যায়ন ও সীমা নির্ধারণই নয় শহরের তৎকালীন ফরাসি শাষকরা প্রথমিকভাবে নিজেদের ও নিজেদের সন্তানাদির শিক্ষার প্রসারের জন্য ১৮৬১ ও ১৮৬২ সালে যথাক্রমে সেন্ট জোসেফ কনভেণ্ট (মেয়েদের মিশনারী বিদ্যালয়) ও একল্ দ্য স্যাঁত মারি (বর্তমানের কানাইলাল বিদ্যামন্দির - শুধুমাত্র ছেলেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) নামক দুটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী কালে এই শহরের নাগরিকরাও এই প্রাতিষ্ঠান দুটিতে শিক্ষালাভের সুযোগ পায়। শুধু এই দুটোই নয় পরবর্তী সময়ে বিশিষ্ট কিছু স্থানীয় মানুষ ও ফরাসি সরকারের একক ও যৌথ উদ্যোগে অরোকিছূ ছোট-বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষার দ্যুতি পৌছে দেবার জন্য। এরফলে এই শহরের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব দেশ তথা বিশ্ব মানচিত্রে  আলাদা স্থান করে নেয়। শহরের নিকাশি ব্যবস্থা, সীমা নির্ধারণ, শিক্ষার উন্নতির পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা সুচিকিৎসা প্রদানের দিকেও ফরাসি সরকার যথেষ্ঠ নজর দেয়। শোনা যায় তৎকালীন সময়ে শহরে সাপের উপদ্রব অন্তত বেরে যায়। সাপের কামড়ে অনেকের মৃত্যুও হতে থাকে। মূলত সাপের কামড়ের সাথে অন্যান্য রোগের সুচিকিৎসার উদ্দেশ্যে বর্তমানের কৃষ্ণভাবিনি নারী শিক্ষামন্দিরের সন্নিকটে (বর্তমান হাসপাতাল মোড়ের  উত্তরে) ডঃ মরগানের উদ্যোগে ও তত্ত্বাবধানে ১৮৭১ সালে গড়ে তোলা হয় চন্দননগর হাসপাতাল। ফরাসিরা মূলত নিজেদের সুবিধার্থে এই হাসপাতাল গড়ে তুললেও পরবর্তীতে নগরবাসীরাও এখানে সুচিকিৎসা পেতে থাকে। আবার চন্দননগর সংলগ্ন মানকুন্ডু অঞ্চলে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক কয়েক একর জমিতে প্রস্তুত (১৯৩৭-৩৯) একটি বাড়িতে (একসময়ে বাড়িটি তৎকালীন ব্রিটিশ সাহেবদের সামাজিক মিলনস্থল ছিল) দেশ স্বাধীন হবার পর মানসিক রোগীদের সুচিকিৎসার জন্য একটি মানসিক হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়। যা এক সময়ে এশিয়া মহাদেশের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানসিক হাসপাতাল নামে পরিচিত ছিল। 
এসবের পাশাপাশি শহরের চুরি-ছিনতাই আটকানো ও সর্বোপরি নিজেদের সুরক্ষার জন্য ফরাসিরা প্রাশাসনিক দিকেও আলোকপাত করে। একদা ডুপ্লের বাসস্থান তথা বর্তমানের চন্দননগর মিউজিয়াম ডুপ্লের প্রস্থানের পর থেকেই ফরাসিদের প্রাশাসনিক ভবনে পরিণত হয়। এখান থেকেই তৎকালীন ফরাসি শাসক বা অ্যাডমিনিস্টেটাররা তাদের প্রাশাসনিক কার্যকলাপ চালাত। আনুমানিক ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৩ সালের মধ্যে এই প্রাশাসনিক ভবনের আনতিদূরেই গড়ে ওঠে পুলিশ স্টেশন ও সংশোধনাগার। 
ভারতের পশ্চিমে একসময়ের সেই ক্ষীণকায়া, পলি জমা এক প্রণালির মতো হুগলি নদীর কুলের সেই কৃষি নির্ভর ছোট্ট জনবসতিপূর্ণ স্থান এভাবেই সকল দিক থেকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে পরিপূর্ণ শহরের রূপ পাবার আশায়। বর্তমানে আমাদের প্রাণের শহর - মনের  চন্দননগর পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতের মানচিত্রে এক বিশেষ ঐতিহাসিক শহর ও পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। 


তথ্যসূত্র -
→ সংক্ষিপ্ত চন্দননগর পরিচয় - হরিহর শেঠ। 
→ হুগলি জেলার ইতিহাস - সুধীর কুমার মিত্র ।
→ আমার শহর চন্দননগর - বইমেলা, ২০১২ সংস্কলন। 
→ চন্দননগরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস - অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। 
→ চন্দননগরের সেকাল ও একাল - শুভ্রাংশু কুমার রায় ।
→ banglalive.com ওয়েবপেজ ১৩ই এপ্রিল, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত "হুগলি নদীর বাঁকে মিনি ইউরোপ" শীর্ষক প্রতিবেদন।

(প্রথম প্রকাশ : 
Golpo.in (A digital platform for story writing), ২১শে সেপ্টেম্বর,২০২০
দ্বিতীয় প্রকাশ :
স্থানীয় মাসিক পত্রিকা "খোলা হওয়া", অক্টোবর, ২০২০)