ভারতীয় পুরাণে হিজড়াদের অস্তিত্ব - Pralipta

হিজড়া সম্প্রদায়ের বহুচারা দেবী। মা দূর্গা মায়ের অন্যতম রূপ।

সায়ন দাস মুখোপাধ‍্যায়: আমরা যদি হিজড়া সম্পর্কে কথা বলি তবে মহাভারতের কিংবদন্তিতে শিখন্দির পৌরাণিক উদাহরণ রয়েছে। শিখন্দি ছিলেন পাঞ্চালরাজের দ্রুপদের বড় মেয়ে সন্তান এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদীর বড় ভাই বা বোন। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, শিখন্দি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদার কন্যা শিখন্দিনী হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং দ্রুপদের পুত্র হিসাবে বেড়ে ওঠেন। এছাড়া তাকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল যে, শিখন্দি কাশীরাজের কন্যা অম্বার পরজন্ম। ভীষ্মর কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার জন্ম।

কুরুক্ষেত্রের কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধের দশম দিনে ভীষ্ম পাণ্ডবদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ভীষ্মকে থামাতে, ভগবান কৃষ্ণ শিখন্দিকে ভীষ্মর প্রতি মোহরা বানিয়ে, যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্মের মুখোমুখি শিখন্দিকে দাঁড় করিয়ে দেন। তার ফলে ভীষ্ম অস্ত্র নামিয়ে দেন এবং কৃষ্ণ  সুযোগটি দেখে অর্জুনের দ্বারায় ভীষ্মকে হত্যা করলেন।

মহাভারতের একটি পর্বে অর্জুনের লিঙ্গ বৈচিত্রের ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়। অর্জুন যখন উর্বশিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তখন তিনি অর্জুনকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। সেই অভিশাপের ফলে অর্জুন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য হয়েছিলেন। অর্জুন তার নির্বাসনের শেষ বছরে নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারন করেছিলেন। অর্জুন বৃহন্নলার নাম গ্রহণ করেন এবং মহিলাদের পোশাক পরিধান করেন এবং রাজা বিরাতা দ্বারা শাসিত শহরে যান, যেখানে তিনি সংগীত কলা, গান এবং রাজকন্যা উত্তরা এবং তার মহিলা উপস্থিতদের নাচতে শিখিয়েছিলেন।

পদ্মা পুরাণ অনুসারে অন্য একটি গল্পে দেখা যায় যে তিনি কৃষ্ণের রহস্যময় নাচের অংশ নিতে শারীরিকভাবে একজন মহিলার মধ্যে রূপান্তরিত হয়েছিলেন, যা কেবলমাত্র মহিলারা উপস্থিত থাকতে পারেন। ভারতীয় ধর্মগ্রন্থগুলিতে এলজিবিটিকিউ চরিত্রগুলির এই রেফারেন্সগুলি লিঙ্গ রূপান্তরের দিকে পরিচালিত অভিশাপের উদাহরণের বাইরে চলে যায় এবং দেখা যায় যে ঈশ্বর ইচ্ছাকৃতভাবে লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারতেন।

 ভারতীয় পুরাণে বিষ্ণুর মহিলা অবতার মোহিনীর কথা অনেক গল্পের শোনা যায়। ভাগবত পুরাণের মোহনীর এনচ্যান্ট্রেসের গল্পের উল্লেখ রয়েছে। অনেক মহাকাব্য অনুসারে মোহিনী ও শিবের সঙ্গমে তাদের পুত্র আয়াপ্পার জন্ম হয়।

 কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবদের বিজয়ের জন্য আরাভানকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। তবে অবিবাহিত অবস্থায় মারা না যাওয়ার তার শেষ ইচ্ছা ছিল। কিংবদন্তি অনুসারে, কোনও মহিলা তাকে বিয়ে করতে এগিয়ে আসেনি। শেষে আরাভানকে বিয়ে করার জন্য বিষ্ণু মোহিনীর রূপ নিয়ে উদ্ভাসিত হয়। এছাড়া আরাভানকে আজও দেশের কিছু হিজড়া সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষক দেবতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ভারতীয় কিংবদন্তীতে শিবের বিখ্যাত অর্ধনারীশ্বর; নারীত্বের সাথে মিশ্রিত শিবের পুরুষত্বের প্রতিনিধিত্ব করে। শিবের এই নৃতাত্ত্বিক সংস্করণটির মত  'লক্ষ্মী-নারায়ণ' হিসাবে সমানভাবে বিখ্যাত যা লক্ষ্মী এবং তার স্বামী বিষ্ণুর মধ্যে মিলনের পরে গঠিত হয়েছিল।

হিজড়া সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে বিবেচিত অনেক দেবদেবীর মধ্যে, বাপালদানের কন্যা দেবী বাহুচারার গল্প বেশ সুপরিচিত। তার প্রথম মন্দিরটি ভারতের গুজরাটের মেহেসেনা জেলার বেচারাজি শহরে অবস্থিত। হিজড়াদের উপাস্য দেবতা মা ‘বাহুচারা’। মা বাহুচারা মোরগের ওপরে অধিষ্ঠিতা। ছুটন্ত মোরগের ওপর মা চার হাতে তরোয়াল, বেদ,  ত্রিশূল আর বরমুদ্রা ধারণ করে আছেন। বলা হয় মা বাহুচারা এক ‘চারন’ বংশে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাপিয়া নামক এক ডাকাত সেই সময় খুব অত্যাচার চালাতো। একদিন সেই ডাকাত , ভগবতীকে ধরতে এলে অভিশপ্ত হয়ে পুরুষত্ব হারায়। 

একটা সূত্র মতে মা বাহুচারা শ্রীবিদ্যার দেবীদের মধ্যে একজন। তাঁর রথের আসল প্রতীক  সাপ। এই অর্থে তিঁনি কুণ্ডলিনী মহাশক্তি।  ভারতের গুজরাটে বাহুচারা মায়ের মন্দির আছে। বলা হয় এই মায়ের পূজা করলে পুরুষের নপুংসকভাব নারীর বন্ধ্যাত্বকরন দূর হয়। এই রূপে তিনি মা ষষ্ঠীর মতো সন্তানদায়িনী ভগবতী। মায়ের কৃপায় সন্তান লাভ হয়। তবে এঁনার মন্দিরে কিন্নর ( হিজরা ) গন বেশী আসেন। বাৎসরিক পূজাতে ভারতের বিভিন্ন স্থান হতে কিন্নরেরা এই দেবীর মন্দিরে আসেন। ইনি কিন্নর দের দেবী। মারাঠারা এই দেবীর পূজা করেন। মানজিরাও গায়কওয়াড নামক এক মারাঠা শাসকের ভাই টিউমার রোগ থেকে মুক্ত হবার পর দেবীর মন্দিরে একটি স্তভ নির্মাণ করেন। আহমেদাবাদের কাছে মহেশানায়, রাজা শঙ্কর নামক এক সম্রাট দেবীর মূল মন্দির নির্মাণ করেন। কিন্নর দের আরাধিতা দেবী বলে এটা ভাবার কারন নেই যে এই মন্দিরে কিন্নর বা রূপান্তরকামী এরা ছাড়া অপর কেও মন্দিরে যায় না। এমনিও অনেক ভক্ত মায়ের কাছে যান। মায়ের দ্বার সবার জন্য খোলা এমনকি সমাজে অবহেলিতদের জন্যও।

ওড়িশা:  হিন্দু পুরাণতত্বে খুঁজে পাওয়া যায় রাজপুত্র সদ্যুম্নের কাহিনী, যে শিব ও শক্তির মায়াবনে প্রবেশ করার ফলে নারীতে রূপান্তরিত হয়। তার অশ্ব অশ্বীতে রূপান্তরিত হয় আর কুকুর স্ত্রীকুকুরে। সদ্যুম্নের নারী রূপ ইলা নামে পরিচিত। সে বিয়ে করে বুধ গ্রহের দেবতাকে, এক অভিশাপের কারণে যার কোনো নিশ্চিত লৈঙ্গিক পরিচয় ছিল না। বৃহস্পতি গ্রহের দেবতা যখন জানতে পারে যে তার স্ত্রী তারা চন্দ্র দেবতার সন্তান গর্ভে বহন করছে তখন সে বুধকে এমন অভিশাপ দেয়। হিন্দু পৌরাণিক গল্পে সদ্যুম্ন চন্দ্রবংশের পূর্বপুরুষ হিসেবে বিখ্যাত। এই বংশের অন্তর্ভুক্ত ছিল পাণ্ডব ও কৌরব।

রামায়ণের লোকগাঁথায় আছে কীভাবে বানররাজ রিসখা জলাশয়ে পড়ে গিয়ে নারীতে রূপান্তরিত হয়। সে বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্র ও সূর্য দেবতাকে বিয়ে করে বালি ও সুগ্রীবের জন্ম দেয়। আরেকটি গল্পে সুগ্রীব ও বালির মা হলো সূর্য দেবতার রথচালক অরুণি যে নারীর রূপ ধারণ করেছিল ইন্দ্রলোকে অপ্সরাদের নৃত্য দেখার জন্য। শিব পুরাণ শক্তির সাথে শিবের মিলিত হয়ে অর্ধনারীশ্বরে পরিণত হওয়ার গল্প বলে। বৃন্দাবনস্থল পুরাণে বলা আছে শিবের নারী সেজে গোপেশ্বর মহাদেব হয়ে মথুরাতে কৃষ্ণের রাসলীলায় অংশগ্রহণের গল্প। বিষ্ণু পুরাণ বলে বিষ্ণুর মোহিনী রূপ নিয়ে অসুরদের মন্ত্রমুগ্ধ করার গল্প। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে দেবতারা দেবীতে রূপান্তরিত হয় আর দেবীরা দেবতায়।   

জৈন সন্ন্যাসীরা মানুষের অস্তিত্বকে দুই ভাগে ভাগ করেছিল, “দ্রব্য শরীর” বা ভৌত রূপ এবং “ভাব শরীর” বা মানসিক রূপ। ভাব শরীর” বা মানসিক রূপ আমাদের অন্য জিনিসের প্রতি আকর্ষিত করে। তারা বলেছে যে একজন ব্যক্তি পুরুষের দেহে থাকা সত্ত্বেও কেবল মাত্র নারীর প্রতি আকর্ষিত না হয়ে একজন পুরুষের প্রতিও আকর্ষিত হতে পারে। সুতরাং, ভাব শরীর দ্রব্য শরীরের থেকে ভিন্ন। ভৌত রূপ এবং মানসিক রূপ সবসময় একটি অপরটির সাথে মিলে না। তারা নারীসুলভ সমকামীদের (স্ত্রী-রূপীনি নপুংসক) কথাও বলেছেন যারা পুরুষসুলভ সমকামীদের (পুরুষ-রূপীনি নপুংসক) থেকে আলাদা। এটি একটি যথেষ্ঠ পরিশীলিত চিন্তাধারা যেটা খুঁজে পাওয়া যায় প্রায় ১৫০০ বছর আগের জৈন পুঁথিগুলোতে। অবশ্য এই চিন্তাগুলো ভিন্নধারার যৌনতার গুনকীর্তনের জন্য ছিল না বরং ছিল ভিন্নধারার যৌনকামীদের সন্ন্যাসীর চক্র থেকে বাহিরে রাখার উদ্দেশ্যে। বৌদ্ধ পুঁথিগুলোতেও একই রকম চিন্তাধারা খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে সমকামী (পাণ্ডক) থেকে রুপান্তরকামী ব্যক্তি পর্যন্ত সকল ভিন্নধারার যৌনকামীদের সন্ন্যাসীর চক্র থেকে বাহিরে রাখা হতো।

যেহেতু হিন্দুধর্ম কম সন্ন্যাসমনা ছিল রুপান্তরকামী ব্যক্তিরা সমাজে গৃহীত হত, সাধারনভাবে না হলেও বিনোদনকারীদের দল তৈরী করতো বা মন্দিরে কাজ করতো। সেসময়ের সমকামীদের ব্যাপারে আমরা খুব কম জানি। তাদের অস্তিত্ব অবশ্যই ছিল, কিন্তু তারা বিয়ে করবে এবং বাচ্চার জন্ম দিবে কোনো না কোনোভাবে সম্ভবত এমনটা প্রত্যাশিত ছিল। তাদের যৌনকর্ম বিষমকামীদের ব্যাভিচারগুলোর থেকে কোনো দিক দিয়েই বেশি খারাপ মনে করা হতো না। দুটির জন্যই শাস্তি ছিল স্নানের মাধ্যমে বিশুদ্ধিকরণ।

তথ্য সুত্রঃ

(১) Original Sanskrit Texts on the Origin and History of the ... - পৃষ্ঠা161
(২) শ্রীমদ্ভাগবদগীতি, সমরপস-ভশ্য; স্বামী সমরপদ সরস্বত 
(৩) থিওসোফিস্ট, খণ্ড 42; কন্ট্রিবিউটর থিওসোফিকাল 
      সোসাইটি (চেন্নাই, ভারত); প্রকাশক থিওসোফিকাল 
      পাবলিশিং হাউস, 1921
(৪) মহাভারত - রাজশেখর বসু
(৫) পৌরাণিক অভিধান - সুধীরচন্দ্র সরকার
(৬) "urday.in - urday Resources and Information."
(৭) "Lesbian, Gay, Bisexual and Transgender
       Communities in India"
(৮) "Historical Background and Legal Status of
        Third Gender in Indian Society"