কালনার সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের ইতিহাস - Pralipta


অমিত কুমার সাহা; নিজস্ব সংবাদদাতা : কালনার সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির,যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে কালনা তথা আপামর জনসাধারণের পরম ভক্তি ও আত্মনিবেদনের অশেষ পরম্পরা। আজ আমরা একটু উঁকি দেব সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের ইতিহাসের অন্দরে।

"শুভামস্তু শকাব্দ : ১৬৬৩/২/২৬/৬
শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী দেবী
শ্রীযুক্ত মহারাজা চিত্রসেন রায়স‍্য।
মিস্ত্রি শ্রী রামচন্দ্র।"

এই উক্তিটি খোদিত ও অলঙ্কৃত রয়েছে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপরিভাগের টেরাকোটা
স্থাপত্যে। এই উক্তিটি থেকে সহজেই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা বা নির্মাণকাল সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।

১৬৬৩ শকাব্দে (১৭৪১ খ্রীষ্টাব্দে) মহারাজা চিত্রসেন এই মন্দির নির্মাণ করান। মন্দির নির্মাণ করেন রাজমিস্ত্রি শ্রী রামচন্দ্র। বাঁকুড়া সোনামুখী নিবাসী রামহরি মিস্ত্রিই অপভ্রংশে শ্রী রামচন্দ্র মিস্ত্রি। তৎকালীন প্রখ্যাত রাজমিস্ত্রি পটল মিস্ত্রি
মন্দিরের সিঁড়িগুলি পরে নির্মাণ করেন।

মহারাজা চিত্রসেনের দ্বারা নির্মিত সিদ্ধেশ্বরী মন্দির স্থাপনের নেপথ্যে বিভিন্ন জনশ্রুতি রয়েছে

১. মহারাজা চিত্রসেন একদিন সন্ধ্যায় ঘোড়ায় চড়ে বিহারে বেরিয়েছেন। গভীর জঙ্গলে প্রবেশের পর একটি সুখ-শ্রাব‍্য ঘন্টাধ্বনি শুনতে পান। সেই শব্দ অনুসরণ করতে করতে তিনি উপস্থিত হন একটি জীর্ণপ্রায় মানববর্জিত পোড়ো মন্দিরের সামনে।রাজা দেখতে পান, মন্দিরের ভেতরে রয়েছে এক প্রকান্ড কালীমূর্তি, সম্মুখে পুজোর নৈবেদ্য। মহারাজা চিত্রসেন এক অপূর্ব অনুভূতিতে অভিভূত হয়ে গেলেন। সামনে প্রকান্ড কালীমূর্তি অথচ জনমানবহীন। অন্ধকার তার নিজস্ব রং ছড়িয়ে দিচ্ছে গোটা এলাকা জুড়ে। রাজা মোহিত হয়ে গেলেন। এক অপূর্ব দৈব‍্য পরিমন্ডলে একাকী রাজা। আধ্যাত্মিক চেতনায় পরিপূর্ণ হয়ে রাজা ফিরে এলেন রাজবাড়িতে। পরবর্তীতে খোঁজ খবর নিয়ে তিনি জানতে পারলেন ঐ কালীমূর্তি সিদ্ধেশ্বরী অম্বিকা। যার নামে কালনার নাম অম্বিকা কালনা। কিন্তু ঐ মূর্তি কার দ্বারা স্থাপিত হয়েছে তা বহু খোঁজ করেও পাওয়া গেল না। মহারাজ এরপর ঐ মন্দির সংস্কারে ব্রতী হন। তাঁরই উদ্যোগে এবং আর্থিক সহায়তায় ভগ্নপ্রায় জীর্ণ মন্দির ১৭৪১ খ্রীষ্টাব্দে সম্পূর্ণ নতুন রূপ পায়, যা বর্তমানে সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির হিসেবে পরিচিত।

২. আর একটি জনশ্রুতি হল, কালনায় অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে অম্বুঋষি ছিলেন। তিনিই একটি কালীমূর্তি স্থাপন করেন এবং পরবর্তীতে অম্বুঋষির নামেই মূর্তিটির অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরী নাম হয়।

৩. অবশ‍্য স্থানীয় বা লৌকিক মত আলাদা - এই
মন্দিরের অদূরে রয়েছে অম্বিকা পুকুর। অম্বিকা 
পুকুরের নাম থেকে অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরীর নাম হয়েছে।

অম্বুঋষি সম্পর্কে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ রয়েছে বিবেকানন্দ দাসের "কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিহাস"গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন - 

"অম্বুরীশ ঋষি বর্তমান মন্দিরের অনতিদূরে পশ্চিমদিকে অম্বিকা পুকুর নামে কথিত পুকুরের এককোণে বটগাছের তলায় পাথরের কুলোর উপর জমাটবদ্ধ একটি ঘট পান। জায়গাটি ছিল গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ। তিনি ঐ ঘটকে বর্তমান
মন্দিরের স্থানে অবস্থিত বটগাছের তলে প্রতিষ্ঠা করে সাধনায় সিদ্ধ হন। তখন মূর্তি ছিল না। ৪ / ৫
পুরুষ শিষ‍্য পরম্পরায় সেবাকার্য চলে। শেষ সাধক ঈশ্বরীশ। তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশে মূর্তি তৈরি করান। নিমগাছের একটি কাষ্ঠখন্ডেই তৈরী। ছোট
বহরকুলির গাঙ্গুলীদের পুকুড়পাড়ে যে তিনটি নিমগাছ ছিল, তার মাঝেরটি নিয়ে এসে কলকাতার নিমতলার দারুশিল্পীর দ্বারা মূর্তি নির্মাণ করানো হয় এবং পঞ্চমুন্ডির আসনের উপর বসানো হয়। এর পিছনে ছিল গঙ্গা ও শ্মশান। এখানে নরবলির প্রথা ছিল। শোনা যেত - ডাকাতরা মুন্ড কেটে নিয়ে ঠাকুরথানে ঝুলিয়ে রেখে যেত। তার স্মারকরূপে যেখানে নরবলি দেওয়া হতো, এখনও তার বিকল্প ডাব বলি দেওয়া হয়। মূর্তিটি জীর্ণ হলে অম্বিকা পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়। বর্তমান মূর্তিটি এবং মন্দিরটি দ্বিতীয় সংস্করণ। প্রথম মন্দিরটিকে বটবৃক্ষ গ্রাস করে। রাজা চিত্রসেন প্রতিমা দর্শন করতে এসে মন্দিরগাত্র থেকে পাথরের চাঁই খসে পড়ে। রাজা মন্দিরটিকে সংস্কার করেন। ঈশ্বরীশের কোন শিষ‍্য ছিল না। স্বপ্নাদেশে তিনি সাতগেছিয়ার চাটুজ্জে বাড়ির একটি ছেলেকে আনেন। সেই ছেলেই ঠাকুর সেবার অধিকার পান। তাই পদবী হয় অধিকারী এবং তখন থেকেই সেবাকার্য হয় বংশানুক্রমিক।"

সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরটি বাংলার একদম নিজস্ব দেউলরীতিতে নির্মিত হয়েছে। বাংলার একেবারে নিজস্ব দেউল শিল্পে থাম বা খিলানের ওপর দুটি,
পাশাপাশি চাল সহযোগে জোড়া বাংলা মন্দির নির্মিত হয়। বাইরে থেকে জোড়া চাল বোঝার উপায় নেই। মধ‍্যভাগেও প্রাচীরের বদলে থাম বা
খিলানের ওপর ছাদ নির্মিত হয়েছে। মন্দিরের ভিতরের অংশটি গর্ভগৃহ এবং সম্মুখ ভাগ অর্ধমন্ডপরূপে ব‍্যবহৃত হয়।

মন্দিরের পাদভূমিতে পাঁচটি সিঁড়ি আছে। তারপর রয়েছে চারণ এবং এরপর নয়টি সিঁড়ি সরাসরি মূল মন্দিরে মিলিত হয়েছে। বাস্তুকারের মতে বন্যার প্রকোপ থেকে মন্দির রক্ষার জন্য স্তরীভূত সিঁড়ি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তন্ত্রোক্ত মতটা অন্যরকম -
তন্ত্র মতে, প্রথম পাঁচটি সিঁড়ি হলো ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাখ‍্যা ও চিত্রানী নাড়ী। অর্থাৎ এগুলি
অতিক্রম করে মায়ের দর্শন মিলবে। পরবর্তী নয়টি সিঁড়ি, পরাশক্তির আধার।

এই মন্দিরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এখানে কোনো শিখর বা চূড়া নেই।

আবার কারও কারও মতে, চারণ পরবর্তী নয়টি সিঁড়ি নবগ্রহের পরাশক্তির প্রতীক।

সিদ্ধেশ্বরী কালীমূর্তিটির উচ্চতা সাড়ে চার ফুট থেকে পাঁচ ফুট। একটি মাত্র নিমকাঠ দিয়েই এই
মূর্তিটি নির্মিত হয়। দেবীর নিত‍্যপুজো হয়। ভোগে মাছ দিতে হয় প্রতিদিনই। যেদিন মাছ ভোগ হয় না সেইদিন অন্নভোগ দেওয়া যায় না। সেদিন লুচি বা ময়দার ভোগ হয়।

কালীপুজোর দশদিন আগে মায়ের মূর্তি রঞ্জিত করা হয়। একে বলে অঙ্গরাগ। অঙ্গরাগের সময়
মায়ের মূল ঘট গর্ভগৃহের বাইরে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানেই মা পূজিতা হন।

এই সময় মন্দির বন্ধ থাকে। কালীপুজোর আগের দিন মা দিগম্বরী হন। এই সময় মা বিবস্ত্রা। সারা অঙ্গে মা সোনার অলঙ্কারে আবৃতা হন। মায়ের দিগম্বরী রূপ পুরুষের জন্য নয়। কেবলমাত্র বিশেষভাবে নির্বাচিত পুরোহিত (পালাক্রমে) এই রূপ দর্শন করতে পারেন। দিগম্বরীর পূর্বে মায়ের চক্ষুদান করা হয়। দিগম্বরীর দিন গর্ভগৃহে স্থাপিত ঘট সন্ধ্যাপুজোর সময় মায়ের সামনে পুণরায় উপস্থাপিত করা হয়। কালীপুজোর দিন ডাব, ছাঁচি কুমড়ো, আখ, একটি ভেড়া এবং দুটি ছাড়া বলি দেওয়া হয়। ছাগ দুটির গায়ে কালো রং ছাড়া
এক ছিঁটে ফোঁটাও সাদা বা খয়েরী রং থাকবে না। সামান্যতম কালো ছাড়া অন্য রঙ থাকলে তা খুঁত বলে বিবেচিত হবে। ডাব, ছাঁচি কুমড়ো, আখ, ভেড়া, দুটি ছাড়া যথাক্রমে মোহ, লোভ, ক্রোধ ও কামের প্রতীক। বলির মাধ্যমে ষড়রিপুকে সংহার করা হয়।

সেবাইতের কাছ থেকে জানা যায় - ঋষি অম্বরীশ প্রাচীন মন্দিরে পূজা করতেন। তিনি পূর্ব সাতগেছিয়ার ঘোষাল পরিবার থেকে তারাপ্রসন্নকে দত্তক পুত্র হিসেবে নিয়ে আসেন। তারাপ্রসন্নের বয়স তখন সাত। তারাপ্রসন্ন বা ঋষি অম্বরীশকে মহারাজ চিত্রসেন দেখে থাকতে পারেন। তারাপ্রসন্নের পরিবারই বংশানুক্রমে এই মন্দিরের সেবাইত আছেন। তারাপ্রসন্নকে 'অধিকারী' উপাধি দেন মহারাজ চিত্রসেন।

মা সিদ্ধেশ্বরী কালনার আধ‍্যাত্মিক সাধনার সুপ্রাচীন দেবী। প্রকৃতপক্ষেই এই দেবস্থানের পরতে পরতে মিশে আছে ভক্তি, বিশ্বাস এবং মানসকামনা চরিতার্থের নানা লীলা মাহাত্ম্য।


... 
তথ্যসূত্র :

১. পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি - শ্রী বিনয় ঘোষ
২. কালনার ইতিহাস - শ্রী তরুণ ভট্টাচার্য
৩. পূজা পার্বণের উৎসকথা - শ্রী পল্লব সেনগুপ্ত
৪. কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিহাস - শ্রী বিবেকানন্দ দাশ
৫. বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় (১৯৭৯) - ড: অতুল সুর
৬. পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পী সমাজ - শ্রী তারাপদ সাঁতরা
৭. বর্ধমান জেলার পুরাকীর্তি ও সংস্কৃতি
৮. বর্ধমান : ইতিহাস ও সংস্কৃতি (১, ২, ৩) - শ্রী যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী
৯. মন্দিরে উপস্থিত সেবাইত
১০. কালনা শহরের কিছু প্রাজ্ঞ ব‍্যক্তিত্ব