Bengal's Old Temples:ভদ্রেশ্বরের ২২২ বছর ধরে পূজিতা মা অন্নপূর্ণা ! - Pralipta


সমীরণ চন্দ্র বনিক:
ভদ্রেশ্বরের তেলিনি পাড়ার বাবু বাজারের ফেরিঘাট স্ট্রিটে রয়েছে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের অন্নপূর্ণা মন্দির। মন্দিরটি ভদ্রেশ্বরের প্রাচীনতম মন্দির গুলোর মধ্যে অন্যতম। ফরাসি আমলে আজকের ভদ্রেশ্বরের তেলিনিপাড়া অঞ্চলটির নাম ছিল কৃষ্ণ পট্টি। সেই সময় ফরাসি শাসকদের তেলেঙ্গানা বা তেলেঙ্গী সৈন্যদের বসবাস ছিল এই অঞ্চলে। ফলে এই জায়গাটির নাম মুখে মুখে হয়ে যায় তেলেঙ্গি পাড়া এবং সব শেষে তেলিনি পাড়া। বিপ্রদাসের মঙ্গলকাব্যে ভদ্রেশ্বরের উল্লেখ আছে। ভদ্রেশ্বর এক প্রাচীন জনপদ। 



কথিত আছে নদীয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার (১৬০৬-১৬২৮ ) বাংলায় প্রথম অন্নপূর্ণা পূজো শুরু করেন। দেবী অন্নদার কৃপা পেয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তিনি রাজা উপাধি লাভ করেন। বলা হয়ে থাকে পরবর্তীকালে অন্নদামঙ্গল কাব্যের ( ১৭৫২ ) প্রভাবে বাংলায় অন্নপূর্ণা পূজোর প্রসার ঘটেছিল।



হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীতে দেবী অন্নপূর্ণার যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে বলা আছে যে একবার পার্বতী শিবের সঙ্গে রাগ করে কালশা পর্বত ত্যাগ করে চলে যান। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তার প্রয়োজনের খাবারটুকু। এদিকে তার অনুপস্থিতিতে সারা পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষের ছায়া নেমে আসে। তিনি তখন খাবারের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। এবং নিজে ভিক্ষা পাত্র নিয়ে চলে যান বেনারসে। কারণ বেনারসে কোনদিন খাবারের অভাব হয়নি। সেখানে দেবী পার্বতী তাকে অন্ন দান করেন, এবং তিনি দেবী অন্নপূর্ণা নামে পরিচিতি লাভ করেন।আজ যে অন্নপূর্ণা মন্দিরটির কথা বলব সেই মন্দিরটি শুধু হুগলি জেলায় নয় বাংলার প্রাচীন অন্নপূর্ণা মন্দির গুলির মধ্যে অন্যতম।  



বড় রাস্তা থেকে মন্দিরের দিকে যেতে গেলে, বাঁ হাতে পড়বে একটা বড় পুকুর, যার তিনদিকে স্থানীয় মানুষের ঘরবাড়ি। আর ডান হাতে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা অন্নপূর্ণা মন্দির। যে মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছিল ১২০৮ বঙ্গাব্দে, ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে। তার মানে আজ থেকে প্রায় ২২২ বছর আগে। সে দিক দিয়ে বিচার করলে এই মন্দিরটি রানী রাসমনির কন্যা জগদম্বা প্রতিষ্ঠিত ব্যারাকপুরের অন্নপূর্ণা মন্দিরের (১৮৭৫ ) থেকেও পুরনো। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা তৎকালীন স্থানীয় জমিদার বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
মন্দিরটির প্রবেশ পথ পূর্বদিকে। 


মন্দিরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে চৌকোনো প্রাঙ্গণ। তারপর ডানহাতে মন্দির। মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। মন্দিরটি সামান্য উঁচু ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরটি নবরত্নশৈলীতে নির্মিত হলেও এর ছাদ সমতল। প্রথম চার কোনায় চারটে রত্ন। দ্বিতীয় তলে চার কোনায় চারটে রত্ন মাঝ খানে একটি বড় রত্ন। মন্দিরের ছাদের সামনের অংশটি কতগুলো জোড়া থামের উপর স্থাপিত। যা ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীকে মনে করিয়ে দেয়। তারপর অলিন্দ। তারপর ত্রি-খিলান যুক্ত প্রবেশপথ। মন্দিরের গর্ভগৃহে বেদীর উপর কাঠের সিংহাসনে মা অন্নপূর্ণা ও বাবা মহাদেবের বিগ্রহ স্থাপিত।



মায়ের বিগ্রহটি অষ্টধাতুর। এবং বাবা মহাদেবের বিগ্রহটি সম্পূর্ণ রুপোর তৈরি। মা এখানে মহাদেব কে অন্নদানরতা। মার ডান হাতে অন্ন দান করার হাতা ও বাঁ হাতে অন্ন পাত্র। মহাদেবের বাঁ হাতে সিঙা ও ডমরু। ডানহাতে ভিক্ষা পাত্র । সিংহাসনে রয়েছে আরও তিনটি বিগ্রহ। লক্ষী, নারায়ণ ও সরস্বতীর। দেবীর পূজা হয় তন্ত্র মতে । মায়ের এখানে নিত্য ভোগ হয়। ভোগে অন্ন ছাড়াও পাঁচ রকম ভাজা, ডাল, সবজি, মাছ ও চাটনি। রাতে মাকে শেতল ভোট দেওয়া হয়। সেখানে নানারকম ভাজাভুজি ও সুজির পায়েস দেয়া হয়। মন্দির খোলা থাকে সকাল সাতটা থেকে দুপুর একটা আর বিকেলবেলা পাঁচটা থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত।



আগে এই মন্দিরে মহিষ বলি পর্যন্ত হতো। তবে বহুদিন হল, বলিপ্রথা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই মায়ের মন্দিরের সামনের চাতালে একটা ছোট্ট চৌকো মতন ঘেরা জায়গায় দুটি ছোট বড়, অর্ধেকটা ক্ষয়প্রাপ্ত কাঠের হাঁড়িকাঠ দেখতে পাওয়া যায়। 


এই মন্দিরে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন সকালে মায়ের বিশেষ পূজা পাঠ অনুষ্ঠান হয়। তারপর মাকে পিতলের রথে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তেলিনিপাড়া মিলের কাছে গড়ের ঘাটে (গঙ্গার ঘাটে )। সেখানে ১০৮ কলসি গঙ্গার জল দিয়ে মাকে স্নান করানো হয়। তারপর পুজো পাঠ হোম যজ্ঞ ইত্যাদি হয়। এরপর হয় নরনারায়ন সেবা। তারপর বিকেলে মন্দির থেকে লক্ষী নারায়ণের বিগ্রহকে, যা সম্পূর্ণ সোনা দিয়ে তৈরি, রুপোর সিংহাসনে করে, সেই সিংহাসন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের সদস্যরা কাঁধে করে নিয়ে যান গঙ্গার ঘাটে মা অন্নপূর্ণা বিগ্রহ যেখানে সকাল থেকে পূজিত হচ্ছেন সেখানে। সঙ্গে থাকে ব্যান্ড পার্টি ও মানুষের শোভাযাত্রা। তারপর আবার শোভাযাত্রার সহকারে গঙ্গার ঘাট থেকে সমস্ত বিগ্রহকে নিয়ে আসা হয় মন্দিরে। বলা হয়, লক্ষী নারায়ন গিয়ে মা অন্নপূর্ণা কে নিয়ে এলেন। এই বিশেষ পুজো বা উৎসবের দিনের অনুষ্ঠানে স্থানীয় মানুষরা ছাড়াও বহু দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষেরা অংশগ্রহণ করে থাকেন। পুরো ভদ্রেশ্বর মেতে উঠে এই অনুষ্ঠানে। এছাড়া অন্নপূর্ণা পূজোর দিন তো বিশেষ পূজা অনুষ্ঠান হয়েই থাকে।


এই মন্দিরের মায়ের নিত্য পূজা ছাড়াও যে বাৎসরিক বিশেষ পুজো ও অনুষ্ঠান হয়ে থাকে তার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করেন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের লোকজনেরা। বাইরের লোকেদের থেকে কোনরকম কোন চাঁদা বা ডোনেশন গ্রহণ করা হয় না। প্রতিবছর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের একেকজনের করে পালা পড়ে। তারাই সারা বছরের পূজোর দায়িত্ব সামলান। পরের বছর আবার আরেকজন সদস্যের পালা পড়ে। এইভাবে দেখা গেছে যে একজনের পালা পড়ার ২৪ বছর পর তার আবার পালা পড়ে। 



এছাড়া এই মন্দিরে দুর্গাপূজো কালীপুজো ও সরস্বতী পুজো হয়ে থাকে। তার জন্য মন্দিরের ডান দিকে পাকা মন্ডপ করা আছে। তবে এক্ষেত্রে আলাদা করে মূর্তি বানিয়ে তবে পুজো করা হয়। সেসব মূর্তি এই মন্দিরেই তৈরি হয়। আর মন্দিরের বাঁদিকে রয়েছে তিনটি শিব মন্দির। শিব মন্দিরে রয়েছে তিনটি শিবলিঙ্গ। তাদের আবার তিনটির নাম আছে। নামগুলি হল, একেবারে বাঁ দিক থেকে পরপর বাণেশ্বর, মহেশ্বর ও কপিলেশ্বর। 

অক্ষয় তৃতীয়ার দিন যে পিতলের রথে চাপিয়ে মাকে গঙ্গা ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় সেই রথটি রাখা থাকে মন্দিরের প্রবেশপথে বাঁদিকের একটি ঘরে। খুব সুন্দর কারুকার্য করা এই রথ। মন্দিরে গিয়ে দেখা পেয়ে গিয়েছিলাম এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের একজন উত্তর পুরুষ শ্রী বিমল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যিনি বললেন যে, তিনি বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের ৩৭ তম বংশধর। ( তারমানে বোঝা যাচ্ছে বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই পরিবারের আদি পুরুষ নন, তার আগেও কেউ আছেন যদিও তার নাম যোগাড় কর আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি ) কথায় কথায় বললেন, মন্দিরে তার পুজোর পালা আসবে ২০২৬ সালে। 



শোনা যায় এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বেনারসের মা অন্নপূর্ণার খুব ভক্ত ছিলেন। তিনি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করার আগে মাঝে মাঝেই তিনি বেনারসে চলে যেতেন। শেষে একদিন তিনি নিজের জমিদারীতে মন্দির প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেন। বিমল বাবু বলছিলেন, তার পূর্বপুরুষ বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বাঁকুড়ার মানুষ। তিনি ভাগ্যান্বেষণে চলে এসেছিলেন মানকুণ্ডুতে। পরবর্তীকালে ভদ্রেশ্বরে স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তোলেন। প্রথমে বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি এবং পরে নিজস্ব ব্যবসায় তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। তারপর তিনি নিজের জমিদারির পত্তন করেন। 

কথা হল মন্দিরের গত ১০ বছরের পূজারী শ্রী অক্ষয় ব্যানার্জির সঙ্গে। তিনি জানালেন মায়ের পূজো অর্চনার রীতিনীতি কথা। বললেন মন্দিরের ইতিহাসের কথা, যতটুকু তিনি জানেন। তবে তিনি বংশপরম্পরায় এই মন্দিরের পূজারী নন। 



মন্দিরের কাছে রয়েছে একটি বড় পুকুর যার কথা আগেই বলেছি। মন্দিরের সামান্য দূরে রয়েছে একটি বড় খেলার মাঠ। তার একদিকে একটি বাঁধানো মঞ্চ রয়েছে। উপরে লেখা উপরে লেখা রয়েছে বৈদ্যনাথ পার্ক। মাঠে ঢোকার মুখে দুদিকে, সদ্য হলুদ রং করা দুটি স্তম্ভ, বন্দ্যোপাধ্যায় জমিদার পরিবারের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে একটা বড়সড়ো জায়গায় রয়েছে একটি গ্রন্থাগার। অন্নপূর্ণা পুস্তকাগার। যা দেবী অন্নপূর্ণার নামাঙ্কিত। গ্রন্থাগারটি স্থাপিত হয়েছিল ১৯১২ সালে।



গ্রন্থাগারটি দেখে খুব ভালো লাগলো। শতাধিক বছর অতিক্রম করেও গ্রন্থাগারটি এখনো জীর্ণ হয়ে পড়েনি, ধুলো ও মাকড়সার জটাজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েনি। একটা সময় পাড়ায় পাড়ায় গ্রন্থাগার ছিল। মানুষের বই পড়ার অভ্যেস ছিল। এইসব দেখে বোঝা যায় যে এই অঞ্চলটি একসময় শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল। এখন সামগ্রিকভাবে মানুষের পাঠাভ্যাস কমে গেছে। মানুষ আর পড়তেই চায় না। এখন তো গ্রন্থাগার সংস্কৃতি প্রায় উঠেই গেছে। এই যে আমি এত বড় লেখা লিখছি, আমি জানি অনেকেই এই বড়লেখা পড়বেন না। একটা সময়ে এই অঞ্চলের প্রায় সমস্ত জমিই ছিল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের জমিদারীর অন্তর্গত। এখনো এইসব জমিতে বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের উত্তরসূরীরা বসবাস করেন। তবে অনেক জমিরই মালিকানা বদল হয়ে গেছে।

ঋণ স্বীকার :

১) শ্রী বিমল বন্দ্যোপাধ্যায় 
২) শ্রী অক্ষয় ব্যানার্জি
৩) ভদ্রেশ্বর অঞ্চলের ইতিবৃত্ত - অধ্যাপক শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
৪) হুগলি জেলার পুরা কীর্তি - নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
৫) স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার।