Kolkata Series:শহরের বুকে দুই খুন, আজও এ শহরের সেতুরা বহন করছে সে স্মৃতি - Pralipta


সৌভিক রাজ: বামেদের ব্যাকফুটে ঠেলে দিতে ডান শিবিরের অস্ত্র হল বিজন সেতু। কিন্তু বিজন সেতু যার নামে, তাঁকে চেনেন? চিনতে গেলে ফিরতে হবে সাতের দশকের কলকাতায়। ১৯৭৪ সাল বেশ রাত ট্রেন রওনা দিয়েছে কলকাতার উদ্দেশ্যে, মানে শিয়ালদা আসবে আরকি। লোকজন কম। যাদবপুর থেকে ট্রেনে উঠে পড়ল ক'জন। শুরু হল ব্যাগ, ঘড়ি, গয়না ছিনতাই। যাত্রীরাও ভয়ে ভয়ে জিনিসপত্র তুলে দিলেন ছিনতাই বাজদের হাতে। রুখে দাঁড়ালেন এক ভদ্রলোক। কিন্তু ওদের সাথে কী পারেন! ভদ্রলোককে মেরে-ধরে, ছুরির ঘায়ে ঘায়েল করে বালিগঞ্জ আর পার্কসার্কাসে মাঝে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিল ছিনতাইবাজের দল। নেমে পড়ল ট্রেন থেকে, যাত্রীরাও সব যে যার বাড়ি চলে গেলেন। কে আর উটকো ঝামেলা পোহায়! কেবল একজন ব্যতিক্রম, ট্রেনের এক যাত্রী জনৈক প্রভুস্বরূপ দাস ঘটনার দিনই রেল পুলিশকে গোটা ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাতে খুব একটা আমল দেয়নি।

ওদিকে ট্রেনের সেই প্রতিবাদীর খোঁজ শুরু হল। কদিন হয়ে গেছে, তার পাত্তা নেই! অফিসেও অনুপস্থিত। ভদ্রলোকের নাম বিজন কুমার বসু। পেশায় সিআইটি-র ইঞ্জিনিয়র। জানা গেল, বোনের সঙ্গে দেখা করে সন্তোষপুর থেকে শিয়ালদাগামী রাতের ট্রেন ধরেছিলেন তিনি। তারপর থেকেই নিখোঁজ। ঘটনাকে প্রকাশ্যে এল। কিন্তু আততায়ীদের ধরা গেল না। সিআইটি ইঞ্জিনিয়রদের চাপে জোরদার তদন্ত হয়েছিল। রেলপুলিশের সুপার উমাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সিআইডির প্রধান জেসি তালুকদাররা কিছুই করতে পারলেন না। এরপর ১৯৭৮ নাগাদ বালিগঞ্জ-কসবা অঞ্চলে তৈরি হল সেতু, সিআইটির ইঞ্জিনিয়রদের দাবি মেনে সেতুর নাম রাখা হল বিজন সেতু। এই বিজনবাবু ছিলেন শ্যামপুকুরের বাসিন্দা। 

শ্যামপুকুরের এক ঘটনা, এবার আরও একটু পিছিয়ে যাবো। ১৯৭১ সাল ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ তারিখ, শীতের সকাল হেমন্তবাবু ও তাঁর এক সঙ্গী শ্যামপুকুর স্ট্রিট ধরে এগোচ্ছেন, ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের বৈঠকে যাবেন। ট্যাক্সি ডাকলেন, ট্যাক্সিতে উঠতে যাবেন এমন সময় এক দল ছেলে ঘিরে ফেলল তাদের। বোমার আওয়াজে কেঁপে উঠল এলাকা। ততক্ষণে হেমন্তবাবুর সঙ্গীটি Gone! ছেলেগুলো চুরি দিয়ে হেমন্তবাবুর শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছিল। রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। হাসপাতালে নিয়ে গেলে হেমন্তবাবুকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রকাশ্যে খুন হন হেমন্ত বসু। যদিও পুলিশের কাছে খবর আগে থেকেই ছিল, ৭১-এর ভোটে শ্যামপুকুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে হেমন্ত বসু প্রার্থী হয়েছিলেন। নিজে, পুলিশের তরফে দেওয়া নিরাপত্তাও নেননি।

শ্যামপুকুরের কাছে শ্রীকৃষ্ণ লেনে থাকতেন নেতাজি ঘনিষ্ঠ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত বসু। সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন, তাই কেউ ভাবতেই পারেনি এমনটা হবে, এমনকি তিনি নিজেও ভাবেননি যে খুব হবেন। পরবর্তীতে তাঁর স্মৃতিতে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ১৯৭৩ সালের ৫ অক্টোবর টালা সেতুর নতুন নাম দেন হেমন্ত সেতু। গরু পারাপারের ​​কাউ ক্রসিং ব্রিজ হয়ে উঠল হেমন্ত সেতু। কী অদ্ভুত মিল দেখুন, দুজনই শ্যামপুকুরের লোক, দুজনেই খুন হয়েছেন আততায়ীদের হাতে। তাদের দুজনের খুনের কিসসা নিয়েই কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে আছে দুই সেতু।

ছবি: ইন্টারনেট