সৌভিক রাজ: দুগ্গা পুজোর আগে সবচেয়ে বড় উৎসব বলতে, ভাদ্র সংক্রান্তি। একেদিকে ভাদু পরব, অন্যদিকে রান্না পুজো আর সঙ্গে বিশ্বকর্মা পুজো, ঢাকে কাঠি পড়ল বলে। আর দেরি নেই! আশ্বিন কড়া নাড়ছে। বিশ্বকর্মা পুজোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে ঘুড়ি। ওই দিন আকাশের দখল নেয় ঘুড়ির দল। পেটকাটি, চাঁদিয়াল, শতরঞ্জি, মুখপোড়া, ঘয়লা, লাটুয়াল, ময়ুরপঙ্খী, বামুনটেক্কা, চৌরঙ্গী, জিবিয়াল, চাপরাজ, সতেরো ইঞ্চি, কানকাটা, হ্যারিকেন, বাক্সঘুড়ি, পট্টীকম তাওয়া, আদ্যা বা দ্যোতে, দেড় তেল, শোয়া তেল, এক তেল, পান্থা আড়া, কালিদা, ফতিঙ্গাঘুড়ি, লন্ঠনঘুড়ি, চিলাঘুড়ি বা ডাঁসঘুড়ি, চিঠিঘুড়ি-কত যে ঘুড়ি, নাম বলে শেষ করা যাবে না!
কিন্তু ঘুড়িকে কী করে চিনল বাঙালি?
পূব থেকে পশ্চিম, পৃথিবীর সর্বত্রই ঘুড়ির রমরমা। ঘুড়ির ইতিহাসের বয়স দু-আড়াই হাজার বছরেরও বেশি। প্রচলিত ইতিহাস বলে, চীন থেকেই ঘুড়ির বিশ্বজয় আরম্ভ হয়েছিল। চীনের লৌকিক উপকথায় রয়েছে, প্রাচীন চীনে বৃক্ষ পুজোর উদ্দেশ্যে মানুষ-জন জড়ো হত। হাওয়ার কারণে, গাছের পাড়ার ওড়া দেখেই মানব মস্তিষ্কে ঘুড়ি তৈরির ফন্দি আসে। অর্থাৎ ঘুড়ির জন্মের নেপথ্যে পুজো রয়েছে। আর সেই ঘুড়ি বঙ্গে এসে পুজো-পালা-পার্বণের সঙ্গে মিশে গেল। রথযাত্রা, বিশ্বকর্মা পুজো, সরস্বতী পুজো এবং পৌষ পার্বণে (মকরসংক্রান্তি) বাংলার আকাশে ঘুড়ির দেখা মেলে। মকরসংক্রান্তিতে বড়াম পুজো হয়, তাতেও ঘুড়ির দেখা মেলে।
বাঙালিকে ঘুড়ি চিনিয়েছিলেন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। লখনৌয়ের রাজত্ব খুইয়ে চিরতরে কলকাতার এলেন নবাব। মেটিয়াবুরুজে তৈরি করলেন এক টুকরো লখনৌ। নবাবি আওয়াধি খানার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় ঘুড়ির অনুপ্রবেশ ঘটানোর কারিগর ওয়াজিদ আলি। কলকাতার আকাশে ব্যাপকভাবে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন হয়েছিল ওয়াজেদ আলির হাত ধরেই। সে'সময় কানকাওয়া, চংগ, তুলকল, গুডডি ইত্যাদি ঘুড়ির চল ছিল। পেশাদার ঘুড়ি উড়িয়েও ছিল সেই আমলে। ঘুড়ি ওড়ানোর ওপর বাজি ধরা হত, ঘুড়িয়ালরা এসব পুরস্কার পেত। অন্যদিকে, দক্ষিণবঙ্গে ঘুড়ির দাপট বৃদ্ধি ঘটেছিল রাজানুকূল্যে। বর্ধমান রাজবাড়িতে ঘুড়ি ওড়ানোর চল ছিল। রাজা মহতাবচাঁদ নাকি নিজেই ঘুড়ি ওড়াতেন। বর্ধমানের রাজাদের হাত ধরেই বর্ধমানে ঘুড়ি উৎসবের বলে মনে করা হয়।
ওয়াজিদ আলিকে দেখে কলকাতার বাবু সম্প্রদায় ঘুড়িকে আপন করে নেয়। বাবুদের কাজ বলতে, বিলাস-বৈভবে নিত্যনতুন বাবুয়ানি করে জীবন অতিবাহিত করা। ঘুড়ির স্বাদ যখন কলকাতা পেল, তখন বাবু সম্প্রদায় বুঝলো বাবুয়ানি দেখানোর নয়া উপায় পাওয়া গেল। ১৮৫০-১৮৭০-র মধ্যে বাবু কালচারে জাঁকিয়ে বসে ঘুড়িবিলাস। হয়ে ওঠে প্রতিপত্তি দেখানোর হাতিয়ার। বাবুরা ঘুড়ির লড়াইয়ের প্রচলন ঘটায়। জানা যায়, বাবুদের ঘুড়িতে আটকানো থাকত দশ বা একশো টাকার নোট। কখনও কখনও টাকা দিয়ে ঘুড়ির লেজ বানানো হত। শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখাতেও এই বাবুয়ানির উল্লেখ রয়েছে। বাবুরা আবার মাঞ্জাহীন সুতো দিয়ে ঘুড়ি ওড়াতেন। পাছে তাঁদের হাত কেটে যায়।
বাবুদের থেকে ধীরে ধীরে জমিদারদের হাত ধরে গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে ঘুড়ির লড়াই। আজ তা আম বাঙালির বিনোদন হয়ে উঠেছে। গত শতকে কলকাতাজুড়ে তৈরি হয়েছিল অজস্র ঘুড়ি ক্লাব। ১৯৫৪ সালে গড়ে উঠেছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল কাইট অ্যাসোসিয়েশন। ১৯৫৮ থেকে তার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে শুরু করে। প্রথম বছর ১৫টি দল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল। জাকারিয়া, ধর্মতলা, সেন্ট্রাল, এন্টালি, বৌবাজার ইত্যাদি জায়গায় কাইট ক্লাব গড়ে উঠেছিল। পরে তৈরি হয় কলকাতায় ক্যালকাটা কাইট অ্যাসোসিয়েশন। তারা আবার জাতীয় স্তরে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা আয়োজন করত। কাইট ক্লাবগুলোর সঙ্গে সব ওস্তাদ ঘুড়িয়াল খেলোয়াড়রা যুক্ত ছিলেন। ঘুড়িয়ালদের মধ্যে শ্রীশচন্দ্র দত্ত, শৈলেন চট্টোপাধ্যায়, মহম্মদ কচি, জহিরুল হাসান সামসি, নাসির আহমেদ, তিনকড়ি ওস্তাদ প্রমুখদের খ্যাতি ছিল। অনুপ নাগ, প্রবোধদের মতো তদানিন্তন কলকাতার নামকরা ব্যবসায়ীরাও ঘুড়ি খেলায় নামতেন।
এক্কালে কলকাতা সত্যিই ঘুড়ির স্বর্গরাজ্য ছিল। আজ যা অনেকটাই ম্লান। কিন্তু বিশেষ বিশেষ দিনে আজও ঘুড়িই বাংলার আকাশে ভেসে বেড়ায়। শ্রাবণের ভরা বর্ষা পেরোতেই, ভাদ্র পড়তেই মাঞ্জা দেওয়ার ব্যস্ততা শুরু হয়। শহরে দাপট খানিক কমে এলেও গ্রাম-গঞ্জে, শহরতলি-মফস্বলে বিশ্বকর্মা পুজোয় এবং পুজোকে কেন্দ্র করে কয়েকটি দিনে ঘুড়ির লড়াই চলে। কাই-পো-চে...ভোকাট্টা-র ওই চিৎকারে আজও আনন্দ লুটে নেয় বঙ্গসন্তানরা।