Murshidabad Rath Yatra: আড়াইশো বছরের প্রাচীন মুর্শিদাবাদের নশিপুর আখড়ার রথযাত্রা ও দ্বিশতাব্দী প্রাচীন রুপোর রথ - Pralipta

সৌভিক রাজ: ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত জনপদ মুর্শিদাবাদের পরতে, পরতে ইতিহাস। ঐতিহাসিক এই জনপদ আদতে বহু ধর্মের মিলনক্ষেত্র, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের এত সম্পৃক্ত সহাবস্থান বাংলার কোথাও খুব একটা চোখে পড়ে না। মসজিদ, সমাধিক্ষেত্র যেমন মুর্শিদাবাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তেমনই জেলাটি শৈবক্ষেত্র এবং শাক্তপীঠও বটে। আবার কৃষ্ণমন্ত্রীদের উপস্থিতিও উজ্জ্বল। এ জেলার অন্যতম সেরা রথের দেখা মেলে নশিপুর আখড়ার রথযাত্রায়, তবে একটি নয়, এক সঙ্গে পাঁচ পাঁচটি রথের দেখা মিলবে নশিপুরে।


তার আগে নশিপুরের খানিক পরিচয় দিই, জাফরগঞ্জে রয়েছে নশিপুর আখড়া ও নশিপুর রাজবাড়ি। মীরজাফরের নাম ছিল জাফর আলি খান, সেখান থেকেই জাফরগঞ্জের জন্ম। নশিপুর রাজবাড়িটি ছিল দেবী সিংহের। তিনি ইতিহাসের কুখ্যাত এক শাসক, রাজস্ব আদায়ের জন্য তার অত্যাচার সারা বাংলাজুড়ে কুখ্যাত ছিল। তবে নশিপুর রাজবাড়ি বা দেবী সিংহ আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। রাজবাড়ির দক্ষিণে অল্প কিছু দুরেই রয়েছে নশিপুর আখড়া। রামাজুন সম্প্রদায়ের সাধুদের আখড়া এটি, এখানকার রথের কথাই বলব। এখানে বিভিন্ন মূর্তির মাধ্যমে কৃষ্ণকে ঘিরে বিভিন্ন উৎসব দেখানো হয়েছে। এখানকার মহান্তকে আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়। ঝুলন ও রথ যাত্রায় এখানে উৎসব হয়, মেলা বসে। পিতল ও কাঠের রথ ছাড়াও এখানের মূল আকর্ষণ ১৪ ফুটের রূপোর রথ। যা বাইশ মণি সোনা-চাঁদির রথ নামে স্থানীয়দের মধ্যে জনপ্রিয়। আখড়ায় দুটি কাঠের রথ, দুটি পিতলের রথ এবং একটি রুপোর রথ রয়েছে। 


বাংলার ১১৬৮ সনে (অনুমানিক ১৭৬০ নাগাদ) রামানুজ অনুগামী লছমন দাস আচারি (মতান্তরে লক্ষণ দাস) ও মনসরাম দাস, তাঁদের ধর্মমত প্রচারের জন্যে রাজস্থান থেকে এসে মুর্শিদাবাদের নশিপুরে এক আখড়া গড়েন। রামানুজের অনুগামীরা, শ্রী সম্প্রদায় নামে পরিচিত। তারা প্রথমে ঢাকায় এসেছিলেন, ভুললে চলবে না এক সময় ঢাকাই ছিল সুবে বাংলার হৃদপিণ্ড। মুর্শিদকুলি ঢাকা থেকে মাকসুদাবাদে আসেন, গড়ে তোলেন মুর্শিদাবাদ। নশিপুর আখড়ার প্রথম রথটি হয়ত রামানুজের অনুগামীদের সঙ্গে বাংলাদেশের ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে এসেছিল। 



সেই সময় থেকেই প্রতি বছর রথযাত্রা পালিত হয়ে আসছে। শোনা যায়, রামদাস আচার্য আখড়ার মহন্ত হওয়ার পর রথযাত্রা বাৎসরিক উৎসবে পরিণত হয়। সেই অনুযায়ী, হিসেব করলে দাঁড়ায় রথযাত্রার বয়স ২৬২ বছর। তবে অন্যমতে, রথযাত্রা উৎসব শুরু হয় মহন্ত চতুর্ভুজদাস আচারির সময়ে। তিনি দু’টি কাঠের রথ তৈরি করে প্রথম রথযাত্রা উৎসব শুরু করেন। নারায়ণ দাস ও তুলসী দাস মহন্তের সময় পিতলের রথ দুটি বানানো হয়েছিল। দুটির উচ্চতা যথাক্রমে কুড়ি ফুট ও পঁচিশ ফুট।


রূপোর রথটিতে জগন্নাথ অধিষ্ঠিত থাকেন। অন্য তিনটি রথে (অর্থাৎ দুটি পিতলের ও একটি কাঠের) থাকেন শ্রীকৃষ্ণ-রাধারানি, লক্ষ্মী-নারায়ণ এবং রাম-সীতা। নশিপুরের রথযাত্রার বিশেষত্ব হল, এখানে সুভদ্রা ও বলরামের পুজো হয় না। নবাবি আমলে আখড়ার রথ মুর্শিদাবাদের ধনকুবের জগৎ শেঠের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হত এবং উল্টোরথের দিন সেগুলি ফিরে আসত। বৈচিত্রের বঙ্গের কথা ভাবুন জগৎ শেঠ কিন্তু জৈন। তার বাড়িতে যেত বৈষ্ণবদের রথ। তবে এখন নিয়ম বদলেছে। মুর্শিদাবাদের অনেক কিছুর মতোই জগৎ শেঠের আদিবাড়িটিও ভাগীরথীর গর্ভে বিলীন হয়েছে। কাঠের রথটি এবং পিতলের জোড়া রথ দুটিকে; জগৎ শেঠের নতুন বাড়ির সামনে রথ প্রাঙ্গণে রাখা হয়, সেখানেই রথের মেলা বসে। রূপোর রথটিকে রথযাত্রার দিন বিকেলে ভাগীরথীর তীরে আনা হয়, সেখানেই জগন্নাথের পুজো করা হয়। গোপাল দাস মহন্তের আমলে রুপোর রথটি তৈরি হয়। ১৭৮৮ সালে এই মহন্ত গোপালদাস আচারীর সময়ে আখড়ার রথ আরও বড় আকারে ধারণ করে। একদল গবেষকের মতে, আনুমানিক ১৮২৫ নাগাদ মহন্ত ভগবানদাস আচারির আমলে রুপোর রথ প্রথম পথে নামে। সেই অর্থে এই রথটিও ডবল সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। রাজস্থান থকে কারিগর নিয়ে এসে রথ নির্মাণ করা হয়েছিল। হাতির উপর উপবিষ্ট মাহুত সারথি হয়ে রথটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, এমন আদলে রথটি গড়া হয়। 



নবাবি আমলে পাঁচটি রথ নগর পর পর পরিক্রমায় বের হত। গত দেড়শো বছর ধরে একটি কাঠের রথ রথযাত্রায় আর সামিল হয় না। জনশ্রুতি রয়েছে, কোনও এক বছর কাঠের রথে পরিক্রমণের সময়ে জগন্নাথের বিগ্রহের তাপমাত্রা হঠাৎ করেই বেড়ে যায় এবং এরপর থেকে মহন্তর নির্দেশে ওই কাঠের রথটিতে আর জগন্নাথকে চাপানো হয় না। রথটি আখড়াতেই রেখে দেওয়া হয়। এখন চারটি রথ শোভাযাত্রায় অংশ নেয়, একটি রূপো, দু’টি পেতল ও একটি কাঠের রথ। তবে মূল আকর্ষণ রুপোর রথটিকে ঘিরেই রয়েছে।


ছবি: ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত