High Heels: মহিলা নয় বরং পুরুষদের জন্যই ডিজাইন করা হয়েছিল হিল জুতো, জানুন অতীতের হাই হিলের অজানা তথ্য - Pralipta


"মা এবারে পুজোয় জুতো কিনে দেবে তো? রনিতা তার মায়ের কাছে আবদার করে ওঠে"।

'জুতো' এই শব্দটার সাথেও আমরা নিজেদেরকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেছি। বর্তমান কালে মানুষের নিত্য ও প্রয়োজনীয় সঙ্গী হল পাদুকা অর্থাৎ জুতো। জুতো না পড়ে বাইরে বেরোনোর কথা আজকের যুগে দাঁড়িয়ে কেউ কখনও ভাবতেও পারে না। জুতোর প্রকারভেদে রকমফের দেখা যায় যুগের সাথে তাল মিলিয়ে। নারীদের ফ্যাশনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হল হাই হিল বা পেনসিল হিল জুতো। যা সব ধরনের পোশাকের সাথেই মানানসই। এই পেনসিল হিলকে ফ্যাশন জগতের আলো বলা যেতে পারে। তবে হিলতোলা জুতো কিন্তু মহিলাদের জন্য নয়, এখানেই অবাক হওয়ার বিষয় যে এই হাই হিল বা পেনসিল হিল মূলত পুরুষদের জন্য তৈরী হয়েছিল। আশ্চর্য হলেও এটাই সত্যি, কারন জানলে চমকে ওঠবেন আপনিও।

প্রাচীন গ্রীসে প্রথম উঁচু হিলতোলা জুতো ব্যবহার করা হত। চার ইঞ্চির পুরু হিলতোলা জুতো পড়ত সেই সময়কার নাট্যাভিনেতারা। এই জুতোগুলোকে বলা হত 'কোথোরনি'। নাট্যাভিনেতারা জুতাগুলির তলার অংশ কাঠ কিংবা কর্ক দিয়ে তৈরি হত। এই জুতোগুলো কেবল নাটকের সময় পরিধান করত। প্রাচীন গ্ৰীস ছাড়াও মিশরে ৩৫০০ অব্দে ইজিপশিয়ান ম্যুরালে উঁচু হিলতোলা জুতোর সূত্রপাত ঘটে। সেই সময়কার মানুষরা জাতিবৈষম্যকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করত এবং সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর জন্য উচ্চবর্ণের ব্যক্তিরা নিম্নবর্ণের থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি উঁচু হিলতোলা জুতো পড়ত। ইজিপ্টের কসাইরা পশু জবাইয়ের সময় রক্ত থেকে নিজেদের পা রক্ষা করার জন্য উঁচু হিলতোলা বা হাই হিল জুতো ব্যবহার করত।

তবে ধারণা করা হয়, হাই হিল প্রচলনের শুরুটা হয়েছিল দশম শতকের শেষের দিকে। মূলত হাই হিল যুক্ত জুতো ব্যবহার করত পুরুষ সৈনিকেরা। প্রাচীন পারস্যের ঘোড়সওয়ার তিরন্দাজ সৈনিকেরা উঁচু হিল যুক্ত জুতো পড়তো, ঘোড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধ করার সুবিধার জন্য। সেই সময়ে সামরিক অভিযানের অবিচ্ছেদ্য অন্যতম প্রধান অংশ ছিল ঘোড়া। তাই ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত বা যুদ্ধ দুইয়ের উদ্দেশ্যেই হাই হিল পরা পুরুষদের জন্য আবশ্যিক হয়ে ওঠে। এতে চলন্ত অবস্থায় ঘোড়ার পিঠ থেকে তির ছোড়ার সুবিধা পাওয়া যায়। হাইহিল পুরুষের যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়ার ওপর ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করত। 

সতেরো শতকে পারস্যের অশ্বারোহী বাহিনীর উঁচু হিলের জুতো

তবে পদাতিক বা অন্যান্য বাহিনীর সৈন্যরা এ ধরনের জুতো ব্যবহার করত না। মধ্যযুগে পারস্যের বিভিন্ন চিত্রকলাতেও সৈনিকদের ঘোড়ায় চড়তে থাকা অবস্থায় পায়ে উঁচু হিলের জুতা পরিধানরত অবস্থায় পাওয়া যায়।প্রাচীন রোম ও গ্রিক সাম্রাজ্যের মঞ্চ নাটকের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং মধ্যযুগে ভেনিসের যৌনকর্মীদের মধ্যেও ছিল হিলজুতো পরার প্রচলন।

সতেরো শতকের গোড়ার দিকে পারস্যের রাজা শাহ আব্বাস দ্য গ্রেট অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করার সুবিধার জন্য ইউরোপে তাঁর দূতাবাস খোলেন। এতে ইউরোপ ও পার্সিয়ানদের রাজনৈতিক যোগাযোগ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলে পারস্যের ঘোড়সওয়ার তিরন্দাজদের হাই হিল ইউরোপে চলে যায়। এরপর ১৫৯৯ সালের দিকে ইউরোপের অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকজন ইরানি ফ্যাশনের জুতা ব্যবহার করতে শুরু করে। নিজেদের আরও পৌরুষদীপ্তভাবে প্রকাশ করতেই তারা বেছে নেয় উঁচু হিল। তখন এই ধরনের উঁচু হিলতোলা জুতোই ছিল পৌরুষ প্রকাশের মাধ্যম। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও হাই হিল যুক্ত জুতো ব্যবহার করতে শুরু করেন। শুধু তাইই নয়, প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি এ ধরনের জুতো শিশুরাও ব্যবহার করতে শুরু করে। ইউরোপের উঁচু হিল জুতোর হিড়িকে সরকার নির্ধারন করে দিয়েছিল সামাজিক পদমর্যাদার ক্রম অনুসারে জুতো ঠিক কতখানি উঁচু হবে অর্থাৎ মানুষের জুতার হিল হবে আধা ইঞ্চি উঁচু, মধ্যবিত্তদের এক ইঞ্চি, নাইটের দেড় ইঞ্চি, সম্মানিত ব্যক্তিদের জন্য দুই ইঞ্চি এবং যুবরাজের জন্য আড়াই ইঞ্চি উঁচু। এবং জুতোর উচ্চতা তিন ইঞ্চির বেশি হওয়া চলবে না এসব নানাবিধ নিয়ম।

যদি কখনও এমন শোনেন একজন পুরুষ সম্রাট হাই হিলযুক্ত জুতো ব্যবহার করতে বেশি পছন্দ করতেন তাহলে কিঞ্চিৎ হলেও সত্য বলে বিশ্বাস করতে মন সায় দেবে না, কিন্তু এই ঘটনা সত্য। সেই ব্যাক্তি হলেন সম্রাট ষোড়শ লুই। তিনি বলেছিলেন তার মতো জুতো আর কেউ যাতে ব্যবহার না করে। তাই তিনি হিল জুতোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। 

এরপর চতুর্দশ লুই যিনি সিংহাসনে আরোহণ করে একটানা ৭২ বছর ১১০ দিন ফ্রান্সের শাসক ছিলেন এবং এখন পর্যন্ত তার ব্যতীত কোনো সম্রাটের পক্ষে একটানা এতদিন শাসন করা সম্ভব হয়নি, পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ দিনের শাসনকালে এটিই দীর্ঘতম রেকর্ড। দীর্ঘ সময় শাসনের রেকর্ড থাকলেও সম্রাট চতুর্দশ লুই বর্তমানের বাঙালি জাতির গড় উচ্চতার চেয়ে বেশ খাটো ছিলেন। তাঁর উচ্চতা ছিল মাত্র পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। ফ্রান্সের মতো এমন একটি দেশের সম্রাটের উচ্চতা এতটাই খাটো যে তা দেশের কাছে নিতান্তই লজ্জাজনক।তার উচ্চতা ছিল মাত্র ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি।তাই তিনি চার ইঞ্চি উচ্চতার হিলতোলা জুতো পরতেন। তাঁরজুতার ওপরের অংশের রং ধাতব, জুতোর হিল এবং সোলের রং ছিল লাল। তিনি সেই সময়ে অর্থাৎ ১৬৭০ এর শতকে নির্দেশ জারি করেন যে তাঁর দরবারের তিনি এবং উজির বাদে ফ্রান্সের আর কারোর লাল রঙের হিলওয়ালা জুতো ব্যবহার করার অধিকার নেই। 

উঁচু হিলের জুতোর মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় ছিল চপিন, যা প্রায় চব্বিশ ইঞ্চি উঁচু ও কিছুটা বাঁকানো ও সংকীর্ণ ধরনের ছিল। গেটা (Geta) নামক আরেক প্রকার জুতোরও সন্ধান পাওয়া যায় যা ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত উঁচু হত এবং এর বিশেষত্ব জুতোর তলায় কাঠের তক্তা ব্যবহার করা হত। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে জাপানীরাও হিল তোলা জুতো পড়ত। তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোষাককে রক্ষা করার জন্য এই রকমের জুতো পড়ত। সময়ের সাথে সাথে ফ্যাশনে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। নিচু সোল ও উঁচু হিলের রাজকীয় আগমন ঘটে ধীরে ধীরে। রাজপরিবারের মেয়ে ক্যাথেরিন দ্য মেদিচি তার বিয়েতে নিচু সোল ও বেশ উঁচু হিলের একজোড়া জুতা পড়েছিল।

পনেরো শতকের গোড়ার দিকে ভেনিসে উঁচু হিলের জুতোকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে মূল ভূমিকা রেখেছিলো সেখানকার প্রস্টিটিউটেরা। তারা হিলতোলা জুতো পড়ে নিজেদের আরও রহস্যময়ী ও আকর্ষনীয় করে তুলতো পরপুরুষের কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পরবর্তী কালে ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক সৈনিকের কাছে নারীরা শারীরিক চাহিদার অংশ হয়ে উঠেছিল আর তাদের শরীরের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে থাকত হিলতোলা জুতো। ১৯৫৪ সালে রজার ভিভিয়ারের হাত ধরে স্টিলেটো হিলের সূত্রপাত ঘটে এবং এই হিল জুতোগুলো যৌনতার এক অন্যতম প্রধান অংশ হয়ে উঠেছিল।

নারীদের জুতোর হিল ছিল পুরুষদের জুতার হিলের চেয়ে কিছুটা সরু আর পুরুষদের ছিল মোটা হিল।ভেনিস এবং ইতালিতেও পুরুষ অভিজাতরা হাই হিল পছন্দ করতেন। সতেরো শতকে হিল তোলা জুতোর ধারাবাহিকতায় কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে হাই হিল নারীদের পা থেকেও যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো উধাও হয়ে যায়। সেই সময়ে উনিশ শতকের একটা সময় হাই হিলের পরিবর্তে রাজত্ব করেছিল বুট জুতো। বুটের হিল ছোট থেকে বড় হতে থাকে, সেই সঙ্গে যুগের পালাবদলের রীতিতে ডিজাইনেরও রকমফের ঘটতে থাকে। ১৮৬০–এর দশকে আড়াই ইঞ্চি হিলের প্রচলন হয় এবং ধীরে ধীরে নারীদের ফ্যাশন আইকনে পরিণত হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ইউরোপের নারী ফ্যাশনে হাই হিল আবার ফিরে আসে ব্যাপকভাবে। 
সর্বশেষ ১৭৪০ সালের কাছাকাছি সময়েই পুরুষদের হিল জুতো পরতে দেখা গেছে। এভাবেই ধীরে ধীরে সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে উঁচু হিলের জুতোর জনপ্রিয়তা।

রিহানা, কিম কার্দাশিয়ান, বেলা হাদিদ এবং ইরিনা শাইকের মতো নামজাদা সেলিব্রিটিদের হাত ধরে ২০২২ সালে ফ্যাশনে ফিরেছে স্ট্র্যাপি হিল। হিল জুতো সর্বপ্রথম পুরুষের হাত ধরেই জনসমাজে নিজ অধিকার বজায় রাখলেও নারীমহলে এর মর্যাদা অধিক সমাদর।


লিখছেন: কোয়েল সাহা

... 
তথ্যসূত্র ও ছবি: ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত