Feature: অবশেষে আধুনিকতার ভিড়েই কী শঙ্খ শিল্পের অবলুপ্তি ঘটবে? - Pralipta


কোয়েল সাহা:  সভ্যতা সংস্কৃতির স্তম্ভ হল লোকশিল্প। লোকশিল্পের মধ্যে দিয়ে একটি সমাজের বা সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক জীবনের মূল এবং জীবন চিত্র প্রতিফলিত হয়। মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার সাধনার পথে অন্যতম মৌল একক লোকশিল্প। এই শিল্পবস্তু মানুষের সাধারণ ব্যক্তিগত প্রয়োজন শুধু মেটায় না। বাংলার ইতিহাসে লোক ও কারুশিল্পের অবস্থান মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত, বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক, কায়িক শ্রমে ও নান্দনিক কৌশলে ব্যবহারিক বস্তুকে সৌন্দর্য ও কারুমন্ডিত করার উদ্দেশ্য অলঙ্ককরণকেই আমরা ‘কারুশিল্প’ হিসেবে অভিহিত করি। লোকায়ত মানুষের অন্তরস্থিত সৌন্দর্যশক্তির প্রকাশরূপ এমন লোকশিল্প। সমাজনিষ্ঠ মানুষের রসসন্ধানী মনের পরিচয় পাওয়া যায় লোকশিল্পের মধ্যে। সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে তৈরি সমস্ত ধরনের চাক্ষুষ শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করে লোকশিল্প। তাছাড়াও কারুশিল্পের বিশাল ভান্ডারে রয়েছে জামদানি, সতরঞ্জি, ধাতব শিল্প, শঙ্খ শিল্প, মৃৎশিল্প, দারুশিল্প, ঝিনুক শিল্প, পুতুল শিল্প, পিতল-কাঁসা শিল্প, বাঁশ-বেত শিল্প, শোলা শিল্প ইত্যাদি।  

"সুজনের সাথে আনের পিরিতি / কহিতে পরাণ ফাটে। / শঙ্খ বণিকের করাত যেমন / আসিতে যাইতে কাটে।" - নানা পৌরাণিক অনুষঙ্গ এবং ঐতিহাসিক উপাদানের সম্মিলিত শঙ্খ শিল্পের প্রাচুর্যতা নিয়ে প্রাচীন যুগ ও বর্তমান যুগের মেলবন্ধনের ইতিহাস রচিত। কী সেই ইতিহাস?কেমন করে শঙ্খ হয়ে উঠল কুটির শিল্পের অন্যতম অঙ্গ? কেনই বা বর্তমান যুগে বিপন্ন এই শিল্পের চাহিদা?

উৎস - 

প্রকৃতি ও প্রত্যয়নগত বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যায় শঙ্খ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে [শম্‌+খ] থেকে। বৈষ্ণব মতাবলম্বীদের উপাস্য দেবতা বিষ্ণুর যে সকল আয়ুধ পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শঙ্খ। বিষ্ণুর চর্তুআয়ুধ এর মধ্যে রয়েছে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম। তাই অনেক সূত্রে বিষ্ণুকে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী দেবতা বলা হয়েছে। তাছাড়াও শক্ত খোলস বিশিষ্ট সামুদ্রিক প্রাণী শঙ্খ। এর শুভ্রতা আর বিশেষ গাঠনিক বৈশিষ্ট্যের কারণে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলার লোক শিল্পের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের অনন্য সাক্ষী এই শাঁখা শিল্প একদিকে যেমন ধর্মবিশ্বাসের সাথে জড়িত, অন্যদিকে অনুপম এক শিল্পমানের পরিচয়ও বহন করে। শাস্ত্রসম্মত ও লোকাচারসম্মত বিধান অনুসারে শাঁখা - সিঁদুরে এয়োস্ত্রীর লক্ষ্মীশ্রী বজায় রাখতে শঙ্খশিল্পও পরিপুষ্টি লাভ করেছিল। হাতে পরিধেয় শঙ্খবলয় যেমনি প্রত্যেক বিবাহিত হিন্দু রমনীর সতীত্ব আর গৌরবের প্রতীক, শঙ্খধ্বনি তেমনি শুভকাজের সূচনায় মঙ্গল বার্তা বয়ে আনে বলে তাঁদের বিশ্বাস। হাতের বালা হিসেবে বহুল পরিচিত এই শঙ্খ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার হওয়ার পাশাপাশি পবিত্র গঙ্গাজলের আধার, এমনকি শঙ্খচূর্ণ রমনীদের রূপচর্চায়ও ব্যবহৃত হতো। হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধ ধর্মের আটটি পবিত্র চিহ্নের একটি এই শঙ্খ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাতেও বেশ গুরুত্বের সাথে ব্যবহৃত হয়েছে এবং চর্মরোগ ও গো রোগের ঔষধ হিসাবে, চুন প্রস্তুতির কাজে ব্যবহৃত হয়। মহেঞ্জোদারোর ধ্বংস স্তুপ, মায়া-ইনকা সভ্যতার পাশাপাশি বাংলাদেশের পাহাড়পুর প্রত্নস্থানে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলকে শঙ্খ উৎকীর্ণ থাকা মানব সংস্কৃতির সাথে শঙ্খের প্রাচীনত্য সহজেই বোঝা যায়। 

পৌরাণিক কাহিনী - 

শঙ্খ বণিকদের ইষ্ট দেবতা অগস্ত্য মুনি। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির সময় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার কাদিলপুরের শঙ্খ বণিকেরা সাধ্যমত সাড়ম্বরে অগস্ত্য ঋষির আরাধনা করেন। প্রকৃতপক্ষে পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয় ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ তিথিতে অগস্ত্যকে অর্ঘ্য দানের মধ্যে দিয়ে। ওই দিন শঙ্খ বণিকেরা শাঁখের কোনও কাজ করেন না।

এত ঋষি থাকতে কেনই বা অগস্ত্য মুনি এদের আরাধ্য দেবতা? মহামুনি অগস্ত্য ঋকবেদের মন্ত্র দ্রষ্টা ঋষি। মিত্র ও বরুণ এর দুই পিতা।পরোক্ষভাবে মাতা উর্বশী। শ্রীহরি নিজের ঊরু থেকে উর্বশীর জন্ম দিলেন। অসামান্য রূপসী উর্বশীকে মিত্র কামনা করলেন। বরুণও চাইলেন উর্বশীর সঙ্গ। উর্বশী মিত্রকে দেহ দিতে চাইলেন আর মন দিতে চাইলেন বরুণকে। কেউ দেহ ছাড়া মন বা মন ছাড়া দেহ নিতে চাইলেন না। মিত্র ও বরুণ অভিশাপ দিলেন, উর্বশী স্বর্ণে সাধারণী হবেন আর স্বর্গ চ্যুত হয়ে পুরুষের ভোগের সামগ্রী হবেন। বশিষ্ঠ অগ্রজ অগস্ত্য কনিষ্ঠ। ঋষি অগস্ত্যের স্ত্রী লোপামুদ্রা আর পুত্র দৃঢ়স্যু। আবার শ্রীমদ্ভাগবত মতে অগস্ত্যের পিতা পুলস্ত্য মাতা হরির্ভূর। তাঁর গায়ের রং সাদা, চার হাত মতান্তরে দুটো হাত, হাতে কমণ্ডলু আর অক্ষসূত্র। কালেয় দানব কুলের অধিপতি বৃত্রাসুর। দেবরাজ ইন্দ্র দধীচির হাড়ে তৈরি বজ্র দিয়ে বৃত্রাসুরকে নিধন করলেন কিন্তু অন্যান্য দানব তারক, কমলাক্ষ, পরাবসু, বিরোচন প্রভৃতিরা সমুদ্রের তলদেশের  বসবাস করতে শুরু করলেন। রাত্রিবেলায় বেরিয়ে এসে দেবতাদের আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে লাগল। নারায়ণের পরামর্শে ঋষি অগস্ত্য দেবতাদের বাঁচাতে এক গণ্ডুষে সমুদ্রের সমস্ত জল খেয়ে নিলেন। তারপর দেবতাদের আক্রমণে ধ্বংস হল। কাজেয় দানবরা নিহত হল। অগস্ত্য সমুদ্রের জল ফিরিয়ে দিলেন। সমুদ্র পূর্বের রূপ ফিরে পেল। আর এক কাহিনী প্রহ্লাদের দুই নাতি ইল্বল ও বাতাপি। লোভী বামুনদের জব্দ করার জন্য মায়াবী ইল্বল ভাই বাতাপিকে মেষ বানিয়ে তাকে কেটে মাংস রান্না করে বামুনদের খেতে দিতেন। খাওয়ার পরেই বাতাপি বলে ডাক দিলে পেট চিরে বাতাপি বেরিয়ে আসত। একই প্রয়োগ ঘটল অগস্ত্য মুনির ক্ষেত্রে কিন্তু অগস্ত্য মুনি বাতাপিকে ভক্ষণ করে হজম করে ফেললেন। পরে অবশ্য তার প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন। অগস্ত্য অস্ত্রশস্ত্র বিশারদ ছিলেন। রামচন্দ্রের বৈষ্ণব ধনু, অক্ষয় তূণ এবং ব্রহ্মদত্ত তরবারি অগস্ত্যের তৈরি। দ্রোণাচার্য যে ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্র ব্যবহার করতেন তাও অগস্ত্য মুনির তৈরি।

কেমন করে হিন্দু রমনীর সতীত্বের কারন এই শঙ্খ?

প্রত্যেক বিবাহিত হিন্দু রমণীকে অবশ্যই শাঁখা পরতে হয়। এর পেছনে একটি পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায় শঙ্খচূড় ছিল মারাত্মক বিষাক্ত নাগ বা সাপ। শঙ্খচূড় ব্রহ্মার কাছ থেকে বর হিসেবে অমরত্ব লাভ করে। স্বর্গের দেবতারা এতে ভীত হয়ে তার অমরত্ব নষ্ট করার জন্য দেবতা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণু দেবতাদের মান রক্ষার জন্য উপায়ন্তর খুঁজতে থাকেন। বিষ্ণু শঙ্খচূড়ের অমরত্ব নষ্ট করার একটি সুযোগ খুঁজে পায়। বিষ্ণু বুঝতে পারে শঙ্খচূড়ের স্ত্রী তুলসীর সতীত্ব নষ্ট করা গেলে শঙ্খচূড়ের অমরত্ব আর থাকবে না। শঙ্খচূড় যুদ্ধের ময়দানে ব্যস্ত থাকলে বিষ্ণু তুলসীর সতীত্ব হরণের সুযোগ খুঁজে পায়। চরম হটকারীতার পরিচয় দিয়ে বিষ্ণু শঙ্খচূড়ের রূপ ধারণ করে তুলসীর ঘরে এসে তার সঙ্গে দৈহিকভাবে মিলিত হন। শঙ্খচূড়ের রূপ ধারণ করলেও তুলসী বিষ্ণুর মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করে তাকে ধরে ফেলেন। দৈহিক মিলন শেষে তুলসী পথ আগলে দাঁড়িয়ে বিষ্ণুকে স্বমূর্তি ধারণে বাধ্য করে। বিষ্ণু নিজ রূপ ধারণ করলে ক্ষিপ্ত তুলসী তাকে অভিশাপ দিলে আতঙ্কিত বিষ্ণু তুলসী ও শঙ্খচূড়কে এটি বর দেয়। সে বর থেকে তুলসী পৃথিবীর মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবে তুলসী গাছ হয়ে, যার পাতা ছাড়া পূজা হবে না। আর অন্যদিকে শঙ্খচূড় সমুদ্রের তলায় শঙ্খ হয়ে বেঁচে থাকবে বছরের পর বছর। এরপর থেকেই শঙ্খ কেটে তৈরি শাঁখা হিন্দু রমণীর সতীত্বের প্রতীক।

পাঁশকুড়ো থানার অন্তর্গত পাঁশকুড়া ২নং উন্নয়ন সংস্থার অধীন পাশাপাশি দুটি গ্রাম কুমারহাট ও যোগীবেড়ের মোট বত্রিশ জন শঙ্খশিল্পী পরিবারের মধ্যে ষোলোটি পরিবার আজও জাতব্যবসায়ে নিযুক্ত রয়েছেন। দত্ত, দাস, নদী, সেন ও শূর পদবিবারী শঙ্খবণিক সম্প্রদায়ের শিল্পীরা প্রায় পাঁচ - ছয় পুরুষ ধরে বসবাস করছেন এখানে। মেদিনীপুর খেলার আর যেসব স্থানে শঙ্খ শিল্পীদের বাস রয়েছে সেই জায়গাগুলি হল : পাঁচরোগ, কলমিতেড়, বাসুদেবপুর, রাধাকান্তপুর, নাড়াজোল, শ্রীবরা, অগ্নি, পটাশপুর, বাগবারি, চেতুম্বাবরণ করাপাট, মেদিনীপুর শহর ও খড়গপুর। শিল্পীর সংখ্যা হিসাবে বিচার করলে দেখা যায়, তালিকার শীর্ষে রয়েছে পাঁচবোল আর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এই কুমারহাট - যোগীবেড়। মেদিনীপুর শহর ও খড়গপুরে একলা পূর্ববঙ্গবাসী শিল্পীদের বাস। এই জেলার মোট তেরোটি শঙ্খশিল্প সমিতি রয়েছে।

শাঁখের করাত দিয়ে একটি গোটা শাঁখ থেকে দশ - বারোটি শাঁখের গোলক পাওয়া যায়। এরপর গোলক নিয়ে জলসহ শিল - পাথরের ওপর ঘষে সমতা আনা হয় এবং কারিগরের সাহায্যে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের রুচিসম্মত নকশা তোলা হয়। এরপর হয় পালিশ ও রং দেওয়ার আগে নাইট্রিক অ্যাসিড় মিশিয়ে তার মধ্যে শাঁখাগুলি ডুবিয়ে ময়লা পরিষ্কার করা হয় এবং গালার রং - এর সাহায্যে নক্‌শার মাঝে মাঝে লাল, নীল অথবা সবুজ রং - এর ছোঁয়াচ লাগানো হয়। সব বয়সের পুরুষ ও মহিলা এমনকী অল্পবয়স্করাও এই শিল্পকর্মে অংশগ্ৰহণ করে থাকেন। তবে, করাতের কাছে ও নকশা তোলার কাছে অভিজ্ঞ ও নিপুণ পুরুষশিল্পীরাই অংশগ্রহণ করেন। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে প্রত্যেক ঘরে চার পাঁচটি করে করাত চললেও বর্তমানে এই শাখারিপাড়ায় মাত্র তিনটি করাত সচল রয়েছে। প্রায় ২১ বছর আগে কোলাঘাটে মেশিন চালিত শঙ্খকাটাই ফ্যাক্টরি চালু হওয়ায় অনেক শিল্পী পরিবারই এখান থেকে শাঁখ কাটিয়ে নেন। হাত - করাতের তুলনায় বর্তমানে বিদ্যুৎচালিত করাতে প্রায় দশগুণ বেশি কাজ পাওয়া যায়। মেশিনে কাটা হলে সারাদিনে চব্বিশ থেকে ছত্রিশ জোড়া শাঁখ কাটা ও ফিনিশিং - এর কাজ করা যায়। শঙ্খশিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও উপকরণ হল করাত, নুয়ার, দাঁড়া বা শোনাই, শিল, নাইট্রিক্যাসিড, গালা ইত্যাদি। বর্তমানে শাঁখার একজোড়ার মান হল চার টাকা, সাড়ে চারটাকা।মাঝারি ধরনের একজোড়া শাঁখার দাম আড়াই টাকা / তিন টাকা। তেরো / চোদ্দ টাকা জোড়ায় অতি উৎকৃষ্ট শাঁখাও পাওয়া যায়। পঁচিশ বছর আগে আট আনা থেকে বারো আনাতে একজোড়া শাঁখা পাওয়া যেত। বর্তমানে একটি বাদ্যশঙ্খের দাম হল পঁচিশ - ত্রিশ থেকে ষাট টাকা, উৎকৃষ্ট আংটির দাম তিন / চার টাকা এবং সাধারণ আর দাম। আগেকার দিনে শাঁখারিরা বাড়ি গিয়ে সিঁধে নিয়ে কাঁসির হলুদগোলা জলে শাঁখা ডুবিয়ে মা - বোনেদের শাখা পরিয়ে দিয়ে আসতেন। এখনও কোথাও কোথাও এ রীতি চলে আসছে। স্থানীয় হাট বাজার ও মেলাগুলিতেই এখন দোকান সাজিয়ে শাঁখা বিক্রি হয়। কোনও কোনও বাজারে 'বাঁধি' দোকানও আছে। মেদিনীপুরের পাইকাররাও প্রয়োজনমতো এখান থেকে শাঁখা নিয়ে যান।

উপকরণ - 

শঙ্খশিল্পের প্রধান উপকরণ সমুদ্রের বিশেষ কয়েক প্রজাতির শঙ্খ, যা শ্রীলঙ্কার জাফনা ও ভারতের মাদ্রাজের তিতপুরে পাওয়া যায়। শঙ্খের অলঙ্কার তৈরির জন্য যেসব প্রজাতির শঙ্খ ব্যবহূত হয় সেগুলি: তিতপুটি, রামেশ্বরি, ঝাঁজি, দোয়ানি, মতি-ছালামত, পাটি, গারবেশি, কাচ্চাম্বর, ধলা, জাডকি, কেলাকর, জামাইপাটি, এলপাকারপাটি, নায়াখাদ, খগা, সুর্কিচোনা, তিতকৌড়ি, জাহাজি, গড়বাকি, সুরতি, দুয়ানাপটি ও আলাবিলা। এগুলির মধ্যে তিতকৌড়ি শঙ্খ সর্বোৎকৃষ্ট, তারপরেই জাডকি ও পাটি শঙ্খের স্থান; আলাবিলা সর্বনিকৃষ্ট। ১৯১০ সালে ১৫০টি তিতকৌড়ি শঙ্খের মূল্য ছিল ৪০-৪৫ টাকা, ১৯৯৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৪০০০-৩০০০০ টাকা।

বিভিন্ন মাপের শঙ্খবলয় তৈরিতে ২.৫ - ৪ ইঞ্চি ব্যাসের শঙ্খ ব্যবহৃত হয়। ভালো আকৃতির একটি শঙ্খ থেকে মাঝারি ধরণের সর্বোচ্চ ৪টি, আর সরু ধরণের ১০টির মতো শাঁখা পাওয়া যায়। শাঁখা কেটে বের করার পর সেগুলির ভেতর ও বাইরের দিক মসৃণ করে তাতে বিভিন্ন নকশা তোলা হয়। সেসব নকশার মধ্যে থাকে ফুল, লতা, ধানের শীষ, মাছ, পাখি ইত্যাদি মোটিফ। সর্বমোট বারোটি ধাপে শাঁখা নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়।

বিশেষ এক প্রকার শঙ্খ হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও জলের দ্রবণের সাহায্যে উজ্জ্বল করে তার গায়ে বিভিন্ন নকশা আঁকা হয়, যাকে বলে জলশঙ্খ। হিন্দুদের পূজানুষ্ঠানে জলশঙ্খে পবিত্র গঙ্গাজল রাখা হয়। আর এক ধরণের শঙ্খ ব্যবহৃত হয়  বাদ্যযন্ত্র হিসেবে। এই শঙ্খে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ফুঁ দিয়ে মাঙ্গলিক ধ্বনি করা হয়; পূজা-বিবাহাদি অনুষ্ঠানে এরূপ শঙ্খধ্বনি অত্যাবশ্যক।

শঙ্খ দিয়ে নানা জিনিস তৈরি হয়। হাতের শাঁখা হলো শঙ্খশিল্পের প্রধান দিক; এ ছাড়াও কানের টপ, খোঁপার কাঁটা, চুলের ক্লিপ, শঙ্খের মালা, ঘড়ির চেন, আংটি, বোতাম, ব্রুশ, ব্যাংগেল, ব্রেসলেট প্রভৃতি অলঙ্কারও তৈরি হয়।

অপ্রতুলতা - 

সামাজিক অবস্থা ও মানুষের রুচিবোধের পরিবর্তনের ফলে বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির অবদানে এখন নানা ধরণের চুড়ি ও বালা তৈরি হচ্ছে, যা অতি অল্প মূল্যে ক্রেতারা কিনতে পারে। এই চুড়ি বা বালা শাঁখার তুলনায় টেকসই ও মনোহর। বাঙালি ঘরের মেয়েরা ক্রমশই শাঁখার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে।

অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া এবং বাইরে থেকে আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় সনাতন ধর্মের বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত শঙ্খশিল্প তার পুরনো ঐতিহ্য আর ধরে রাখতে পারছে না। পাঁশকুড়ো থানার পথশিল্পীরাও আজ একই সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন তা প্রধানত সুলভমূল্যে শাঁখ না পাওয়ার দরুন। আগে কলকাতার আড়তের মোট আমদানি করা শাঁখের দশ আনা অংশ আসত সিংহল থেকে এবং বাকি ছয় আনা অংশ দক্ষিণ ভারত থেকে। কিন্তু বর্তমানে সিংহলের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেন - দেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার এবং ডুবুরিদের মাইনে বেড়ে যাওয়ার শাঁখের নাম বেড়েছে । এর ওপর মুরগিহাটার শাঁখের ব্যবসাটি একচেটিয়া আড়তদারদের কব্জায় থাকতে সমস্যা আরও বেড়েছে । মাঝখানে বছর হতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সুলভমূল্যে শাঁখ বণ্টনের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বিগত দু-বছর আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। বাঁকুড়া, বর্ধমান মেদিনীপুর জেলার ছোট ছোট সমিতিগুলি মিলিতভাবে 'বঙ্গমাতা শঙ্খশিল্পী কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি'র মাধ্যমে দু-বারে মোট সাতলাখ টাকার শাঁখ সরাসরি মাদ্রাজ থেকে আমদানি করে সমিতিগুলির মাধ্যমে শঙ্খশিল্পীদের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ বিষয়ে মাদ্রাজ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে কর্পোরেশন - এর মাধ্যমে শাঁখ আমদানি ব্যাপারে সহযোগিতা করেছিলেন। পাঁশকুড়া থানায় শিল্পীরা প্রায় আঠারো বছর আগে যোগীবেড় - কুমারহাট শঙ্খশিল্প সমবায় সমিতি গঠন করে নিজেদের সংহত করার চেষ্টা করেছেন। প্রায় বছর বারো আগে এঁরা তমলুকের সমবায় সমিতি থেকে বারো হাজার টাকা শিল্পকর্মে ঋন হিসাবে গ্রহন করেছেন। অবশ্য এখনও মোট ঋণের সাত হাজার টাকা পরিশোধ হয়নি। 

এইসব নানা কারনে শঙ্খ শিল্পের কারিগররা পেশা পরিবর্তন করে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। কাচাঁমালের মূল্যবৃদ্ধি ও ভ্যাট দিয়ে তাদের যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। অনান্য শিল্পীদের আশঙ্কা এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে অচিরেই সম্ভবনাময় এই শিল্প বিলীন হবে ।

তাহলে কী শাঁখের নকশায় স্বপ্ন বোনার দিন শেষ হয়ে যাবে চিরতরে? আজীবন কালের মতো সময় কী থমকে যাবে শাঁখারিপাড়ায়? বাংলার প্রাচীনতম কুটিরশিল্প কবে এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবে? নানান প্রশ্নের ভিড়ের সম্মুখীন বাংলার শঙ্খশিল্পীদের জীবন।


... 
তথ্যসূত্র :

• ইন্টারনেট ও বিভিন্ন বই থেকে প্রাপ্ত তথ্য