Feature : আরও একবার ফিরে দেখা রাজেন্দ্র বাহাদুর কৃষ্ণচন্দ্রের শাসনভূমি ও মৃৎশিল্পের অন্যতম পীঠস্থানকে? - Pralipta


কোয়েল সাহা: 
ইতিহাস, সে তো এক বহতা নদী,
স্বগতিতে বয়ে চলে নিত্য নিরবধি।

বাংলার ইতিহাসে নদীয়া একটি অন্যতম প্রাচীন জনপদ। প্রাচীন বাংলায় এটি গৌড়ের অধীনস্থ এক জনপদ ছিল। পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত নদীয়া জেলার একটি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ হল কৃষ্ণনগর । নদীয়া জেলার সদর শহর ও পৌরসভা এলাকা এই কৃষ্ণনগর। 
ছোট থেকে আমরা মা, দাদু, দিদাদের মুখে এই কথা শুনেই বড়ো হয়েছি যে কৃষ্ণনগর মানে ঐতিহ্য আর বনেদিয়ানার মেলবন্ধন। বর্ধিষ্ণু এই শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ালে সরভাজার ও সরপুরিয়ার মতো উদরপূর্তিময় মিষ্টির কড়া পাকের সুঘ্রাণ ভেসে আসে, মৃৎশিল্পীদের আশ্চর্য দক্ষতার পরিচয় ফুটে ওঠে মাটির পুতুলের মধ্যে দিয়ে আর সুদূর বিস্তৃত ফাঁকা মাঠের শেষপ্রান্তের ওই নাটমন্দির-নহবতখানা-বিষ্ণুমহল জানান দিয়ে যায় অতীতের কিছু গৌরবময়, রহস্যের দুনিয়ার অন্তরালে রয়ে যাওয়া ইতিহাসের কথা। চলুন সাক্ষী হই সেই অবর্নিত জনশ্রুতির প্রকৃত সত্য উন্মোচনে।

কৃষ্ণনগর মানেই তো ইতিহাস বিখ্যাত রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কথা উঠে আসে। জনপদটির নামকরণ হয়েছিল তাঁর নামানুসারে। কিন্তু তা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে অনেকের মধ্যে, অনেকের মতে মহারাজা রুদ্র রায় এই নগরের নামকরন কৃষ্ণনগর করেছিলেন। ইতিহাস জানান দেয়, সপ্তদশ শতাব্দী নাগাদ ভবানন্দ মজুমদার নামে একজন বারো ভুইঁয়াদের আধিপত্য দমন করতে উদ্যোগী হন এবং রাজা মানসিংহকে বাংলার দখল নিতে সাহায্য করেন। মানসিংহ ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের সেনাপতি। বাংলা বিজয়ে মানসিংহকে সাহায্য করার জন্য পুরস্কার স্বরূপ ভবানন্দ মজুমদার সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে সম্মান লাভ করেন এবং তার সাথে এক ফরমান দ্বারা নদীয়া, সুলতানপুর, মারুপদহ, মহৎপুর, লেপা, কাশিমপুর প্রভৃতি চোদ্দটি পরগনার অধিকার লাভ করেন (১৬০৬ খ্রিঃ)। মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রদত্ত চোদ্দটি পরগনার সনদসূত্রে নদীয়ার রাজা হন ভবানন্দ মজুমদার এবং সেই সঙ্গেই নদীয়া রাজবংশের সূচনা করেন। তাঁর বংশধররা 'রাজা' উপাধি ধারণ করে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত নদীয়া শাসন করেন। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার নবাব ইসমাইল খাঁ ভবানন্দের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে ‘কানুনগুঁই’ পদে নিযুক্ত করেন। নদীয়ার বিখ্যাত রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ সেই ভবানন্দ মজুমদার। বংশপরম্পরা চলতে থাকে ক্রমশ। নদীয়ার রাজধানী ছিল মাটিয়ারি পরে ভবানন্দ মজুমদারের নাতি রাঘব রায় সেই রাজধানীকে আবার পরিবর্তিত করে নিয়ে আসেন রেবতী নামক এক স্থানে। পরবর্তীতে নদীয়ারাজ রুদ্র রায় তাঁর তৎকালীন নদীয়া রাজ্যের মধ্যবর্তী স্থানে নবদ্বীপ ও শান্তিপুরের নিকট জনপদ ‘রেউই’ গ্রামে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং কৃষ্ণ ভক্ত রুদ্র রায় তার আরাধ্য দেবতার নামে রেউই-এর নামকরণ করেন 'কৃষ্ণনগর'।

নদীয়ার রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজা হন। ৮৪ পরগনার অধীশ্বর সামাজিক সাংস্কৃতিক জগতের প্রভাবশালী ছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। রক্ষণশীল এ হিন্দু রাজা বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় সমান ব্যুৎপন্ন ছিলেন। সঙ্গীত ও অস্ত্রবিদ্যায়ও তিনি পারদর্শী ছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন কূটকৌশলী ব্যক্তি। বাংলা অঞ্চলের প্রবল প্রতাপশালী চরিত্র নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকাল ৫৫ বছরের। তাঁর রাজত্বকালে রাজ্যের প্রচুর বিস্তার ঘটে। তাঁর সময় পরগনার সংখ্যা ছিল ৮৪টি এবং রাজ্যের পরিধি ছিল ৩৮৫০ ক্রোশ। নদীয়া জেলার প্রথম কালেক্টর নিযুক্ত হন মি.এফ রেডফার্ণ তাঁরই রাজত্বকালে। তাঁর রাজত্বকাল নানা ঘটনায় পূর্ণ ছিল। পলাশীর যুদ্ধ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, বর্গী হামলা ইত্যাদি তাঁরই আমলে হয়। তাঁর শাসনকালে বাংলায় ইংরেজ শাসন কায়েম হয় এবং মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটে। এ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা করেন এবং ক্লাইভের পক্ষ নিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ত্বরান্বিত করেন। ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় নবাব মীর কাশিম তাঁকে বন্দি করে মৃত্যুদন্ড দিলে ইংরেজদের সহায়তায় তিনি মুক্তিলাভ করেন। ইংরেজদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের পুরস্কারস্বরূপ তিনি ইংরেজ কর্তৃক ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত হন। তদুপরি ক্লাইভের নিকট থেকে উপঢৌকন হিসেবে পেয়েছিলেন পাঁচটি কামান। লর্ড ক্লাইভ কৃষ্ণচন্দ্র-কে ‘রাজেন্দ্র বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। সে সময়ে বাংলায় যে বর্গীর আক্রমণ হতো তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি তাঁর রাজধানী ‘শিবনিবাস’ নামক স্থানে স্থানান্তরিত করেন।সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কৃষ্ণচন্দ্র-কে প্রথমে 'মহারাজা' ও পরে 'মহারাজেন্দ্র বাহাদুর' উপাধিতে ভূষিত করেন এবং সেই সঙ্গে পতাকা, নাকড়া, ঝালদার ,পালকি ইত্যাদি রাজ পুরস্কার প্রদান করেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পূর্ণ রাজ উপাধিটি ছিল এই রকম – ‘অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী শ্রীমন মহারাজরাজেন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্র রায়’। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রই লক্ষণ সেনের সময়ের মতো সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। তিনি সংস্কৃতচর্চার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন। পণ্ডিতদের জমি দান করেছিলেন। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যায় লাগাম দিতে তিনি শাক্ত পুজোর উপরে জোর দিয়েছিলেন। তাই সেই সময়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বল্লাল সেনের সমাজ-সংস্কৃতির প্রতীক ভাবা হত।উনিশ শতকের মাঝের দিকে যখন ভাষার পরিবর্তন হচ্ছে, বিধবা বিবাহের মতো সামাজিক সংস্কার তৈরি হচ্ছে, সে সময়ে কৃষ্ণচন্দ্রকে মনে করা হত মধ্যযুগীয় হিন্দু জমিদারদের প্রতীক। যিনি কৌলিন্য প্রথা, জাতিভেদকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, আদিরসাত্বক কাব্যকে উৎসাহ দিয়েছেন। কৃষ্ণচন্দ্র একজন বিশিষ্ট সাহিত্যপ্রেমিক ছিলেন। মধ্যযুগের অন্যতম বিখ্যাত কবি ভারতচন্দ্র ছিলেন তাঁর সভাকবি। এ ছাড়া সাধককবি রামপ্রসাদ সেন, পন্ডিত বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত প্রমুখ তাঁর রাজসভা অলঙ্কৃত করেন। হাস্যরসিক গোপাল ভাঁড় ছিলেন তাঁর দরবারের প্রখ্যাত বিদূষক।দরবারের প্রখ্যাত বিদূষক গোপাল ছিলেন কৃষ্ণ চন্দ্রের পরামর্শদাতা।
কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে আঠারো শতকের মধ্যভাগে ভারতচন্দ্র তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য অন্নদামঙ্গল রচনা করেন। নবদ্বীপসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সংস্কৃতচর্চার ক্ষেত্রে কৃষ্ণচন্দ্রের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি সংস্কৃতচর্চা বিষয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন।কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় তখন বাংলায় সঙ্গীতেরও যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছিল। 
কৃষ্ণচন্দ্রের আমলেই নদীয়া সর্বাধিক উন্নতি লাভ করে। তিনি সারা নদীয়া জুড়ে অনেক দেব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর আমলেই কৃষ্ণনগর রাজপ্রাসাদের দরবার কক্ষ বা বিষ্ণুমহল এবং পঙ্খের কারুকাজ সমন্বিত নাট মন্দির নির্মাণ করা হয়। 
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্মরণীয় হয়ে আছেন যোদ্ধার সাজে মৃন্ময়ী মূর্তি বা ‘রাজ-রাজেশ্বরী' নামে খ্যাত তাঁর জাঁকজমকপূর্ণ পুজো-উৎসবের জন্যেও।কৃষ্ণচন্দ্র রায় মহা সমারোহে এই পারিবারিক দুর্গাপুজো করতেন। তিনিই প্রথম সর্বসাধারণের মধ্যে দুর্গোৎসবের প্রচলন করেন যা পরবর্তী কালে সর্বজনীন পুজোর পরিচিতি পায়। প্রচলিত ডাকের সাজের চেয়ে আলাদা। একে বলা হয় ‘বেদেনি ডাক’।
কথিত আছে মুর্শিদাবাদের নবাব আলীবর্দী খাঁর বার্ষিক খাজনা যথাসময়ে জমা না দিতে পারার কারণে ১৭৫৪ সালে নবাবের আদেশে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে কারাবাস করতে হয়। কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে নৌকায় কৃষ্ণচন্দ্র যেদিন কৃষ্ণনগরে এসে পৌঁছান সেই দিনটা ছিল দুর্গাপূজার দশমী। লোককথা অনুযায়ী দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণ করতে না পারার হতাশায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মুর্শিদাবাদ থেকে কৃষ্ণনগর আসার পথে নৌকোতেই ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি এক কুমারী বালিকাকে স্বপ্নে দেখেন। দেখেন তাকে স্বয়ং মহামায়া আদেশ দিচ্ছে কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে তার পুজো করার জন্য। এই স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে মহা ধুমধামের সঙ্গে প্রথমবারের জন্য দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো করা হয়। 
অন্য মতটি হল রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ইংরেজদের পক্ষের লোক এই অভিযোগ তুলে নবাব মীর কাসিম ১৭৬৪ সালে কৃষ্ণচন্দ্র ও তার ছেলে শিবচন্দ্রকে মুঙ্গেরে কারাবন্দি করেন। এই কারাবন্দি অবস্থায় কৃষ্ণচন্দ্র একদিন স্বপ্নে এক কুমারী দেবীকে দেখেন। সেই দেবী নাকি তাকে কারাগার থেকে মুক্তির পথ করে দেন। কারাগার থেকে বের হয়েই কৃষ্ণচন্দ্র পুত্র শিবচন্দ্রকে নিয়ে তান্ত্রিক কালিশঙ্কর মৈত্রের কাছে যান। সেখানে তিনি তার স্বপ্নের কথা জানালে কালিশঙ্কর মৈত্র তাকে কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো করার আদেশ দেন। সেই আদেশ পাওয়ার পর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পুত্র শিবচন্দ্র ও সভাসদ গোপাল ভাঁড়ের ওপর পুজো আয়োজনের যাবতীয় দায়িত্ব সঁপে দেন।জগদ্ধাত্রী পুজোর নবমীতে ক্রমান্বয়ে সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীর পুজো হয় রাজবাড়িতে। কৃষ্ণচন্দ্রের নিজস্ব উপসনার জন্য একটি জগদ্ধাত্রী মূর্তি ছিল। সেটি রাখা হত গোবিন্দবাড়িতে। তাঁর উৎসাহ ও উদ্যোগে নাটোরের কয়েকজন বিখ্যাত মৃৎশিল্পী কৃষ্ণনগরে গিয়ে মৃৎশিল্পের প্রভূত উন্নতি ও প্রসার ঘটান। যা আজকে ঘূর্ণি নামে পরিচিত।

সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের মিলনতীর্থ এই শহর নিজ মহিমায় বিরাজমান। এই শহরের অস্তিত্ব আজও বয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের গৌরবান্বিত অতীত ।


... 
তথ্যসূত্র : বিভিন্ন বই থেকে প্রাপ্ত সূত্র