Bangladesh Momin Masjid: বাংলাদেশের ক্যালিগ্ৰাফির ও দারুশিল্পের অন্যতম নিদর্শন মমিন মসজিদ - Pralipta

কোয়েল সাহা : "এসো হে আর্য,এসো অনার্য,হিন্দু মুসলমান। এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান"।।
পৃথিবীতে মানুষের জীবন যাপনের দিক নির্দেশনা এবং সাম্য - মৈত্রীর বাণী নিয়ে যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মের আগমন ঘটেছে । অন্যান্য ধর্মের প্রতিষ্ঠানের মতো মুসলমান ধর্মালম্বী মানুষদের কাছে মসজিদ হলো আল্লাহর ঘর । মসজিদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে তাদের উপাসনালয়ের মতো নয় ; বরং মসজিদের সাথে মুসলিমদের দৈনন্দিন জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত । মসজিদ হলো ইসলামের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র । ব্যক্তি , সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো মসজিদ । মসজিদ ' শব্দটির অন্তর্নিহিত ভাবধারা বিশেষ অনুধাবনের বিষয় এবং তাহা বুঝিয়া লইতে না পারিলে মসজিদ গমনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে মানুষের পূর্ণ পরিচয় লাভ হইতে পারে না । সেজদা ' হইতে মসজিদ শব্দের উৎপত্তি । মসজিদ অর্থ ' সেজদা'র স্থান। 

আজকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হল একটি এমন মসজিদ, যেটি সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে নির্মিত। একটু আশ্চর্য হচ্ছেন, মনে হচ্ছে এও কী সম্ভব ? হ্যাঁ সম্ভব এবং এই মসজিদ আজও স্বমহিমায় নিজের সুসজ্জিত কারুকার্য নিয়ে বিরাজমান। বাংলাদেশের পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানার অধীনে উদয়তারা বুড়িরচর গ্রামে অবস্থিত কাঠের নির্মিত মসজিদটি বাংলাদেশের দারুশিল্পের এক অনবদ্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য নিদর্শন । মসজিদটি এ দেশের ঐতিহ্যবাহী আট চালা স্থাপনা রীতির এক অনন্য উদাহরণ । বৈচিত্রময় ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার এ মসজিদটির অলংকরণে বিশিষ্টতা দান করেছে। এই সুসজ্জিত মসজিদটি দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র কাঠের মসজিদ।



পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার উদয়তারা বুড়িরচর গ্রামের মৌলভী মমিন উদ্দিন আকন বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মসজিদটি নির্মাণ করেন। সম্পূর্ণ নিজস্ব শৈল্পিক ভাবনা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি মসজিদটি তৈরি করেন।



যা শিল্পকর্মের অপূর্ব নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।তবে সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি বলে স্থানীয়ভাবে মসজিদটি ‘কাঠ মসজিদ’ নামে পরিচিত। আবার তার নামানুসারে এই মসজিদকে মোমিন মসজিদ বলা হয়। ইউনেসকোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ৩০টি শিল্পসমৃদ্ধ মসজিদের অন্যতম এটি। 


সংস্কৃতির জন্য আকনবাড়ি জেলায় সুপরিচিত । মমিনউদ্দিন আকনের পিতা মৌলভি ইব্রাহিম আকনই এই আরুনবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা । ইব্রাহিম আরবি শিক্ষায় সুপণ্ডিত ছিলেন , ভাল ফারসি জানতেন এবং খুব সৌখিন হিসাবে অঞ্চলে পরিচিত ছিলেন । আরবি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্যই তিনি আকন উপাধি পান । ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে মমিনউদ্দিন আকন জন্মগ্ৰহন করেন।


ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়ার ছেলে পীর বাদশা মিয়ার অনুসারী ছিলেন মৌলভী মমিন উদ্দিন। মমিনউদ্দিন আকন পাকা কাঠ দিয়ে মসজিদ তৈরি করার জন্য মনে মনে অনেক আগে থেকেই স্বপ্ন দেখতেন । উনি বহু জায়গা ঘুরে ঘুরে কাঠের উপর বিভিন্ন ডিজাইন দেখে নিজের মসজিদ সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা করেন ।এ উপলক্ষে তিনি বিভিন্ন মসজিদ পরিদর্শনের মাধ্যমে সেগুলোর ডিজাইন ও ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে ধারণা অর্জন করলেন। বাংলাদেশে বেশিরভাগ মসজিদই তৈরি ইট অথবা পাথরের দ্বারা। এগুলোর বেশিরভাগই মুঘল আমলে তৈরি। এরই ধারাবাহিকতায় মমিন উদ্দিন আকন নিজে ইটভাটায় ইট তৈরি করে মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন। কিছুদিন পরে তিনি মসজিদটিকে সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে তৈরির পরিকল্পনা নেন। ওই গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িই তখন কাঠের তৈরি। নিজের হাতে ইট তৈরি করেন মসজিদের মেঝে পাকা করার জন্যে । 


১৯১৩ - এ মসজিদ তৈরির কাজ শুরু করেন । কাঠ শিল্পের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলা থেকে হরকুমার নাথকে প্রধান মাসিক চল্লিশ টাকা বেতনে মসজিদ তৈরীর প্রধান মিস্ত্রি নিয়োগ করেন । সহযোগী মিস্ত্রি যাঁরা ছিলেন তাদের মধ্যে নারায়ণ , হরিদাস , গণেশ , বিমলচন্দ্র ও মমিনউদ্দিন উল্লেখযোগ্য । মমিনউদ্দিন আকন সবসময়ই শিল্পীদের কাছে থেকে কাজ পরিচালনা করতেন । এক একটি কারুকার্য সুক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করে দেখতেন , কখনও কখনও তিন / চারবারও একটি কাজের পুনরাবৃত্তি করতে হয়েছে । অনেক সময় শিল্পীরা বিরক্ত হয়ে যেতেন । মোট বাইশ জন মিস্ত্রি দীর্ঘ সাত বছর নিরলস কাজ করে শেষে ১৯২০ - তে মসজিদ সমাপ্ত করেন । মূলত দুষ্প্রাপ্য লোহাকাঠ ও সেগুনকাঠ মসজিদ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে । খুটি ও আড়াগুলি লোহাকাঠের তৈরি । এই কাঠামো তৈরিতে লোহার পেরেক ব্যবহার না করে কাঠের শলা ব্যবহৃত হয়েছে । কাঠের মূল অংশ চট্টগ্রাম থেকে আমদানি করা হয়েছিল । কিছু অংশ ঢাকার নিকটে চাঁদপুর থেকেও আনা হয়েছিল । এছাড়া মায়ানমার, ত্রিপুরা,আসাম থেকে কাঠগুলো সংগ্ৰহ করা হয়েছিল।


মসজিদটির ১৬ হাত দৈর্ঘ্য , ১২ হাত গ্রন্থ এবং উচ্চতা ২৫ হাত । সাধারণ দোচালা টিনশেড দিয়ে ছাদ তৈরি করা হয়েছিল , ছাদের মাঝখানে ( পিক্‌ পয়েন্টে ) দ্বিতীয় আরেকটি দোচালা টিন শেড তৈরি করা হয়েছিল , সম্ভবত আলো বাতাস আর সৌন্দর্যের জন্যেই টপ পয়েন্টে এবং চারিদিকে ঝুলানো অবস্থায় মেটালিক ডিজাইন ( শক্ত টিনজাতীয় জিনিস কেটে তৈরি ) দেওয়া হয়েছিল — এসব অবশ্য বেশিরভাগই এখন ভেঙে গেছে । উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ( দুই পার্শ্ব ) দুটি করে চারটি জানালা , পূর্ব ও পশ্চিমে ( সামনে ও পিছনে ) চারটি করে মোট আটটি জানালা রয়েছে । পূর্ব দিকে একটি মাত্র প্রবেশ দ্বার , কারুকার্যখচিত আয়তক্ষেত্রিক দরজা ( দুই অংশে ) , দরজার বাইরের দিকে দুটি কারুকার্যখচিত খুঁটি , উপরে উড্ওয়ার্ক দিয়ে আর্চমোটিফ তৈরি করা হয়েছে। মসজিদটির পুরো পরিকিল্পনা, নকশা ও ক্যালিগ্রাফির কাজ করা হয় মমিন উদ্দিন আকনের তত্ত্বাবধানে। 


প্রবেশদ্বারের শিল্পকর্মটির বাঁদিকের চতুষ্কোণ অংশে চার খলিফাসহ হযরত মুহম্মদ ( স :) এর নাম অলঙ্কৃত করা হয়েছে । উপরে ডান দিকে “ হযরত আবু বকর ” , বা দিকে “ হযরত ওমর ও নীচে ডানদিকে “ হযরত আলি " এবং মাঝখানে “ হযরত মুহম্মদ মুস্তফা ( স :) " অঙ্কনলিপিতে এক জ্যামিতিক ব্যালান্স সৃষ্টি করা হয়েছে । এই লেখাটির দেওয়ানি ( Deewani ) রীতির সাথে যথেষ্ট মিল রয়েছে । দেওয়ানি রীতি পার্সিয়ান তালিক ( Taliq ) রীতিরই বিবর্তন । সপ্তদশ শতাব্দীতে এই রীতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল । প্রবেশদ্বারের কারুকার্যটির মাঝখানের অংশে লেখা রয়েছে “ বিস্‌মিল্লাহ হের রহমানির রাহিম ( টানা লেখায় হার্টের আকৃতি সৃষ্টি করা হয়েছে ) , লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ”। এটি দেওয়ানি ও জালি ( জালি , দেওয়ানির একটি পরিবর্তিত রূপ , হাফিজ ওমান এটির প্রচলন শুরু করেন ) রীতির সংমিশ্রণে লেখা । লেখাটির অলংকারিত্ব ও জ্যামিতিক নিয়ন্ত্রণ এক দারুণ আকর্ষণ সৃষ্টি করে । অঙ্কনশিল্পটির নীচে লতাপাতার ডিজাইন নৈসর্গিক আবহ সৃষ্টি করে । 


দ্বিতীয় যে অঙ্কন শিল্পটি , সেটি মিম্বারের ঠিক উপরে সাজানো হয়েছে । লেখাটি সিমেট্রিক এবং খণ্ড খণ্ড লেখার নিখুঁত জ্যামিতিক সন্নিবেশে শিল্পকর্মটিকে বিমূর্ত করা হয়েছে। অঙ্কনশিল্পটিতে কুফি ( Kufi) ও দেওয়ানি রীতির সন্নিবেশ আছে বলে মনে হয় । এ শিল্পটিও নৈসর্গিক লতাপাতার মাঝখানে সেট করা হয়েছে । এই শিল্পকর্মটির ঠিক ঠিক নীচে মিম্বারের দুইপার্শ্বে কারুকার্যখচিত খুঁটির উপরে আর্চমোটিফ তৈরি করা হয়েছে । মসজিদের চারপাশে উপরের অর্থভাগে ডাব্‌ল্ বেড়া দেওয়া হয়েছে , দু - পার্শ্বেই ভিন্ন রকমের কারুকার্য রয়েছে , এই দুই পার্টকে অবশ্য খুলে আলাদা করার ব্যবস্থা রয়েছে । এইভাবেই মাঝে মাঝে খুলে ভিতরটা পরিষ্কার করা হয় । ডিজাইনের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে , এটি ব্যাকগ্রাউন্ড বিহীন , শুধু ডিজাইনকে কেটে কাঠ থেকে বের করা হয়েছে । ক্যালিগ্রাফি গুলোতে অবশ্য ব্যাকগ্রাউন্ড রাখা হয়েছে । মূল ডিজাইনের উপরে কালার পেইন্ট করা ছিল ‌।


২০০৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা দিয়ে এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। ২০০৮ সালে মসজিদটির সংস্কার কাজ করা হয়। এ সময় লোহার ব্যবহারসহ মূল ডিজাইনের বেশ কিছু পরিবর্তন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, এ ধরনের কাঠের তৈরি মসজিদ একসময় ভারতের কাশ্মীরেও একটি ছিল; কিন্তু ১৮৮৫ সালের ভূমিকম্পে সেটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে দক্ষিণ এশিয়ায় সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি মঠবাড়িয়ার মমিন মসজিদই এ ধরনের একমাত্র নিদর্শনে পরিণত হয়।


সারা বাংলাদেশের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত মসজিদের মধ্যে যেগুলো বেশি গুরুত্ব বহন করে সেই সব মসজিদের মধ্যে এই মমিন মসজিদ খুবই উল্লেখযোগ্য মুসলিম স্থাপত্যকলা।