Feature : রাজা রামমোহন রায় - গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতা - Pralipta

 
কৌশিক নন্দী : ইউরোপীয় নবজাগরণের সুদূর ফলশ্রুতি হলো "গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতা" যা ইউরোপীয় রাষ্ট্র কাঠামোতে এক বিশেষ স্থান লাভ করেছিল।এই বৈপ্লবিক চিন্তাধারার মাধ্যমে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের স্বৈরচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের নতুন পথ ধরে সর্বস্তরের মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে এদেশে যখন "ফিউডাল" প্রথা বা সামন্ত তন্ত্রের প্রচলন হলো যখন মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হলো, তখন এই   সামন্ত প্রথা বা নবগঠিত জমিদারি ব্যবস্থায় প্রজা সাধারণের আর্থিক দৈন্য দশা ও দুঃখ তথা জমিদারের অত্যাচারের কথা সর্বপ্রকার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন - তিনি হলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি গনতান্ত্রিক চেতনা ও মানবাধিকারের মাধ্যমে নিজ স্বাধীন মত ব্যক্ত করেছিলেন। ১৮১৫ সালে তাহারই প্রতিষ্ঠিত আত্মীয় সভা হয়ে উঠেছিল একটি উচ্চস্তরের "cultural association'' - যার মাধ্যমে  তৎকালীন সামাজিক রাজনৈতিক সমস্যা  তা থেকে রামমোহন গভীর মানবিকতা বোধ ও গণতান্ত্রিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। তার মতে রাজনীতি সমাজের সৃষ্ঠ বিষয় নয়, তাকে বাদ দিয়ে  সমাজের কল্যাণ সাধন অসম্ভব। তাই তার গভীর জাতীয়তাবোধ তথা গভীর বিশ্ব বোধ প্রকাশ পায়। জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে  ব্রাহ্ম বাদের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বের ধর্ম ও মূল আদর্শ গুলোকে তিনি একাত্ম করেছিলেন।                              
রামমোহন তার গনতান্ত্রিক আদর্শকে নানাভাবে রূপায়িত করতে চেয়েছিলেন--- সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো আইন সংস্কার করে বিচার ব্যবস্থায় জুরি প্রথার প্রবর্তন, বিচার ব্যবস্থা ও শাসন  বিভাগের পৃথকীকরণ ,নতুন করে দেওয়ানী ও ফৌজদারি আইন নির্দিষ্ট করা, নতুন করে কোন আইন তৈরী করার সময় ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করা, বিচারালয়ের পার্সি ভাষার পরিবর্তন করে ইংরেজি ভাষার পরিবর্তন ও পঞ্চায়েত শাসন ব্যবস্থার প্রচলন ইত্যাদি তার দাবির তালিকা ভুক্ত ছিল। এই নিয়ে ডাক্তার  আর সি মজুমদার বলেছেন " Rammohan laid  the foundation of all the principal movement for the elevation of the India which characterise the nineteenth century"

ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও স্বাধীন মতামত প্রকাশ যা গনতন্ত্র একটি বিশেষ দিক । এই দিক কে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার নিরলস প্রচেষ্টা তার প্রকাশিত সংবাদ পত্রের মাধ্যমে তিনি আপামর জনসাধারণের কাছে তুলে ধরে ছিলেন। তার প্রকাশিত সংবাদ পত্র গুলি হলো সংবাদ কৌমুদী (১৮২১) (বাঙলা ভাষাতে ও ইংরজিতে) এবং দ্বিতীয় সাপ্তাহিক মিরাট - উল -আকবর  এর মাধ্যমে তিনি সাম্য,স্বাধীনতার বাণী ও তৎকালীন ইউরোপীয় প্রগতিশীল চিন্তাধারার মাধ্যমে অষ্টাদশ শতাব্দীর মৃৎকল্প ভারতবাসীর মধ্যে প্রাণের জোয়ার সৃষ্ঠি করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের ত্রুটি বিচ্যুতির সঙ্গে ন্যায় পক্ষ সমর্থনের কথা তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় সংবাদ পত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম সংবাদ পত্রের মাধ্যমে বাক স্বাধীনতা কথা তুলে ধরেছিলেন।১৮২৩ সালে মার্চ মাসে সরকার যখন মুদ্রা যন্ত্রের (press regulation) আইন ভারতীয়দের স্বাধীন  মত প্রকাশের বিরুদ্ধে অন্তরায় সৃষ্ঠি করেছিল। লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করলো ।তখন রামমোহন এই নিয়ত্রন আইন প্রতিবাদের জন্য তার পত্রিকা মিরাট -উল- আকবর পত্রিকা কে ব্রিটিশ সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল। বাক স্বাধীনতা যে গণতন্ত্রের বিশেষ  অঙ্গ তাকে পরাধীন ভারত বর্ষে তিনি সর্বপ্রথম  সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ভারতের জাতীয় অবদানের ক্ষেত্রে রামমোহনের অবদান যে কোনো অংশে কম ছিল না। ভারতবর্ষে জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম এবং সংবিধান সম্মত পথে যে স্বাধীনতা আন্দোলনের নীতি কংগ্রেস প্রাথমিক পর্যায়ে যে গ্রহণ করেছিল তা রামমোহনের প্রদর্শিত পথ। এসমন্ধে Dr Pattabhi sita Ramaiah History of indian National Congress vol -1 বলেছেন যে 'it was not merely the political forces and sense of subjugation that gave birth to confess.The Congress doubtless had its political objectives, but it also was the organ and exponent of a  movement of national rejuvenation had by been at work"।                        

যখন স্পেনের অধিনস্ত দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলি একে একে স্বাধীন ঘোষণা করছে তিনি তাদের সমর্থনে একটি পাবলিক ডিনার দিয়েছিলেন।যখন  তাদের   স্বৈরাচারী শাসকের হাতে স্বাধীনতা হারালো তিনি খুব মর্মাহত হয়েছিলেন তিনি বলেছিলেন "under the circumstances I consider the cause of the Napolitants as our own and their enemies are ours. Enemies of liberty and friends of Despotism have never been and never will be ultimately successful (Letter to a friend, Mr Buckingham dated  August 1821) ইউরোপীয় প্রগতিশীল চিন্তাধারা ও ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে রামমোহন স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আপোষহীন সংগ্রামকে কুর্নিশ জানিয়েছেন। তাই সর্বশেষে বলা যায় এই বহুভাষাবিদ, শাস্ত্র জ্ঞানী, প্রবল যুক্তিবাদী ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রচারক, অনন্য আন্তর্জাতিকবাদী রাজা রামমোহন রায় গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার মাধ্যমে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বাণীকে পাথেও করে অষ্টাদশ শতাব্দীর ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যবস্থায় এনেছিলেন নবজাগরণ ও মানবতাবাদ।