দুর্গাচরণ রক্ষিত এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব - Pralipta

দুর্গাচরণ রক্ষিত ও তার ফরাসি কতৃক পাওয়া পদক

অনির্বাণ সাহা: বাঙালি ব্যবসা বোঝে না— এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে যে সমস্ত নাম রুখে দাঁড়ায়, দুর্গাচরণ রক্ষিত তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাই এক কথায় বলতে গেলে, উনবিংশ শতকে চন্দননগরের এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী ছিলেন দুর্গাচরণ রক্ষিত । স্রেফ ব্যবসা ও বুদ্ধির জোরে শুধু চন্দননগর বা বাংলা নয়, বিশ্বের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর নাম। চন্দননগরের লাল বাগানে আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর বিশাল ‘রক্ষিত ভবন’। ভেতরে ঢুকলে সেই ইতিহাসের একটা স্পর্শ তো পাওয়া যায়ই। সেই সঙ্গে উঠে আসে আরও নানা গল্প। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক গণ্ডিতে আটকে থাকেননি তিনি; দুর্গাচরণ রক্ষিতের গল্প আরও বড়ো ছবি নিয়ে হাজির হয় আমাদের সামনে। 

২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৮৪১ তারিখে লালবাগানে রক্ষিত বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন দুর্গাচরণ রক্ষিত । দুর্গাচরণের পারিবারিক ব্যবসা ছিল তাঁতের। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে অল্প বয়সেই তাঁর বাবা গোবিন্দচন্দ্র রক্ষিত মারা যান। ১০ বছরের দুর্গাচরণের ওপর সংসারের দায়দায়িত্ব এসে পড়ে। বাবার মৃত্যুর পর 'ক্যামা ল্যামারু অ্যান্ড কোম্পানির' মালিক মসিয়ে কামা দুর্গাচরণকে সহকারী কোষাধ্যক্ষ হিসাবে কাজে নিযুক্ত করেন । তাঁরই চেষ্টায় ফরাসি শেখা শুরু দুর্গাচরণের। 

শ্যামাচরণ রক্ষিতের ছবি

চাকরি ঠিক দুর্গাচরণের রক্তে ছিল না। পারিবারিক ব্যবসার দিকেই তাঁর ঝোঁক। ফরাসডাঙার বিখ্যাত তাঁতকে আশ্রয় করে নিজের ছোট্ট ব্যবসা শুরু করলেন তিনি। তখনও কি জানতেন, ভাগ্য তাঁকে কোথায় নিয়ে যাবে! নিজের বুদ্ধি, পরিশ্রম ও দক্ষতার জেরে অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠল। একসময় তাঁর নাম উঠে এল খবরের কাগজের পাতায়। তৎকালীন চন্দননগর থেকেই বিদেশে পাঠাতেন চা, ডাল, কাপড়, আফিম-সহ নানা দ্রব্য; বদলে বিদেশ থেকে তাঁর কাছে আসত দামি ফরাসি মদ, কুইনাইন, জিঙ্ক হোয়াইট ইত্যাদি। চন্দননগর থেকে একসময় গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম। শুধু ফ্রান্সই নয়; মালয়েশিয়া, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, জামাইকা, হংকং, মরিশাস, মিশরের মতো জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। একটু একটু করে উনবিংশ শতকে বাংলা ও ভারতের ব্যবসার জগতে রীতিমতো দৈত্য হয়ে উঠলেন এক বাঙালি। একসময় এমন হল যে ব্যবসার কাজে নিজের জাহাজ রাখতে হল দুর্গাচরণকে।

দুর্গাচরণ রক্ষিতের বাড়ি

১৮৭৯ - ৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি 'লোকাল কাউন্সিলের সভাপতি পদে থেকে ফরাসি শাসকগোষ্ঠীকে পরামর্শ দান করেন । ১৮৮৩ সালে স্থানীয় আদালতের অবৈতনিক সন্মানিক জজ ও ম্যাজিসেট্রেটের ভূমিকাতেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। সমাজ কল্যানেও দুর্গাচারণের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য ।  ১৮৮৫ সালে দুর্গাচরন রক্ষিত দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় “একল দুর্গা” নামক একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। যা বর্তমানে দুর্গাচরন রক্ষিত বিদ্যালয় নামে পরিচিত ।  ১৮৯০ সালে দুর্গাচরন রক্ষিত মহাশয় কর্তৃক একটি আয়ুর্বেদিক দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপিত হয়। তার বিদ্যানুরাগের জন্য প্যারিসের ফরাসি সাহিত্য পরিষদ তাঁকে সম্মানিত সভ্যপদ "Officer de Academie" অর্পণ করে পদক পাঠায় । "কম্বোজ ফরাসি সমাজ" কর্তৃক Chevalier de ordere Royale du Cambodge উপাধিতে ভূষিত হন । শেষ পর্যন্ত ১৮৯৬ সালের ৬ই জুন ফরাসি সরকারের তরফ থেকে প্রথম বাঙ্গালী ভারতীয় হিসাবে নেপোলিয়নের সময় থেকে চালু হওয়া ফরাসিদের শ্রেষ্ঠ সন্মান “Le Chevalier De la Legion d Honneur” উপাধিতে ভূষিত হন। ফরাসিদের তরফ থেকে তিনটি সর্বোচ্চ পুরস্কার প্রাপ্ত এহেন সমাজসেবী, বিদ্যানুরাগী এবং বিশ্বখ্যাত ব্যবসায়ী দুর্গাচরন রক্ষিত ২৭শে আগস্ট, ১৮৯৮ সালে পরলোক গমন করেন।

তার মৃত্যুর প্রায় ২৩ বছর পর ১৯২১ সালে দুর্গাচরন রক্ষিত মহাশয়ের স্মৃতিতে তাঁর পুত্র শ্রী শ্যামাচরণ রক্ষিত চন্দননগর গঙ্গার জোড়া ঘাটে একটি চাঁদনী ও কক্ষ প্রস্তুত করেন।