প্রলিপ্ত কথোপকথন সঙ্গে সুপরিচিত কবি ও চিকিৎসক শ্রী সদ্যোজাত - Pralipta


এই লকডাউনের সময় আপনি কেমন আছেন?

লকডাউনের সময় ডাক্তার এবং পুলিশ দুজনেই সৈনিক। আমি পেশাগত ভাবে একজন ডাক্তার, আমার কাজ রোগী দেখার। প্রতিটি মুহূর্তে একটি আশঙ্কা তো আছেই। যতই পিপিটি থাকুক না কেন সবসময়ই মনে হচ্ছে আমি আক্রান্ত হব। এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। আমি শুধু এটুকু বলতে চাই যে পৃথিবী অনেকবারই বলেছে সে ভালো নেই। আমরা কিন্তু পৃথিবীর ওপর অত্যাচার চালিয়েই গেছি। সুনামি এসেছে পাত্তা দেইনি, এত্তবড় ঘূর্ণিঝড় এসেছে পাত্তা দেইনি। একের পর এক দেশ পারমাণবিক বিস্ফোরণ করে গেছে, তখনও আমরা সচেতন হইনি। আজ সত্যিই পৃথিবী কাঁদছে। কষ্ট তো হয় এখন সবাইকে দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে, কেউ কারোর সাথে হাত পর্যন্ত মেলাতে পারছেনা, যেটা আমাদের সংস্কৃতির খুব সুন্দর একটি পন্থা। এই সমস্ত মিলিয়ে যদি বলেন আমি কেন কেউই ভালো নেই।

আপনি বললেন পেশাগত দিক থেকে আপনি একজন ডাক্তার এছাড়াও আমরা সকলেই জানি আপনি একজন কবি। এই বন্দী পরিস্থিতিতে শুধুই কি ডাক্তারি? তার পাশাপাশি আপনার লেখালেখির কাজ কেমন চলছে?

ব্যপারটা হচ্ছে ২২ তারিখে যখন প্রথম লকডাউন করা হয় সেদিনই আমি একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। সেটা খুব সম্ভবত ২৩ তারিখ বেরোয়। আমি সেদিনই বলেছিলাম কম করে হলেও টানা তিনমাস লকডাউন হতে চলেছে। আজকে ভালোই লাগছে সেটা হচ্ছে দেখে। প্রথমদিকে বেশ কিছু লেখা লিখেছিলাম এটার উপর মানুষজনকে সচেতন করার জন্য, বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন বার্তা দিয়েছি, বিভিন্ন মিডিয়া, পত্রিকায় অনেককিছু বলেছি। জানিনা আগামীতে কি লেখা রয়েছে, তবে এটুকু বলতে পারি এই মুহুর্তে আমেরিকার মতো দেশে মৃত্যুর সংখ্যা যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তার তুলনায় আমাদের দেশ কিছুটা হলেও ভালো আছে। যেখানে বাকি দেশগুলো মেডিকাল ক্রাইসিসের পর লকডাউন করেছিল সেখানে ভারত সরকার অনেক আগেই লকডাউন শুরু করে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আমাদের দেশে গরিবের সংখ্যা তো অনেক বেশি। আশা রাখি খুব তারাতারি এই দুর্দিন কাটবে।

অনলাইন গণমাধ্যমের গুরুত্ব আপনার কাছে ঠিক কতটা?

বিশাল! আমি যখন প্রথম লেখালিখি শুরু করি এবং আজও, আমি অনলাইন মিডিয়া থেকেই উঠেছি এবং আপনাদের ভালোবাসা আশির্বাদ আমার সাথে থেকেছে। আমি আজও নিজেকে অনলাইন মিডিয়ার লেখক বলেই মনে করি। এবং সারাজীবন অনলাইন মিডিয়ার লেখক হয়েই থাকতে চাই। তার একটা কারণ, আমার খুব প্রিয় লেখক, সম্পাদক এবং খুব প্রিয় ভাই অঙ্কুরের সাথে তো আলাপই হতো না। আজ যে অনলাইন ই-বুক বলুন, অনলাইন মিডিয়া বলুন এগুলো এখন মানুষের ঘর পর্যন্ত চলে এসেছে। আপনি বলুন তো কজন মানুষ বইমেলাতে সিরিয়াসলি বই কিনতে যায়। কারণ বর্তমানে তাদের মধ্যে অনেকেই মোবাইল ফোনে রবীন্দ্ররচনাবলী থেকে শরৎচন্দ্র সবটাই পেয়ে যাচ্ছে। এমনকি আমার মতো লেখকের বই যদি কোনো পাঠকের পছন্দ হয়, সেটাও তারা ঐ অ্যাপ থেকেই বার করে নিতে পারছে। তো আমার মনে হয় সময় সাপেক্ষে মনগত পরিবর্তন আনাটা খুব দরকার। যারা এটা বলছে যে সোশাল মিডিয়া খারাপ, আমি বিনীতভাবে অনুরোধ করছি তাদের কাছে, আমরা খারাপ কেন বলব? কোনো জিনিস কে খারাপ বলার তো কোনো কারণ থাকবে। ১০-১৫ বছর আগে যদি লেখা পত্রিকায় না বেরোতো তার গুনমান আমরা জানতে পারতাম না। আজকে ফেসবুকে পোস্ট বলে একটা অপশন আছে। একটা সময়ে আমি নিজে ব্যাক্তিগতভাবে ফেসবুকে লেখা দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছি ভালোবাসা পেয়েছি। আমি অব্যশই একথা বলব, যে এটাও ঠিক ফেসবুকে পোস্ট অপশন আছে অতএব যা খুশি একটা লিখে দেওয়া, এটার একটা অদ্ভুত ট্রেন্ড আমি দেখেছি। লেখার গুনগত মান কিছু নেই অথচ 'দারুন', 'অনবদ্য' এসব কমেন্ট করতে দেখেছি। এগুলোর আমি বিরোধী তবে সেটাকে মাথায় ধরে রেখে সোশাল মিডিয়াকে খারাপ প্রতিপন্ন করি সেটা ঠিক না। সবকিছুরই খারাপ দিক, ভালো দিক আছে। বই পরার দরকার অবশ্যই আছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বইয়ের আকারটাও পাল্টাচ্ছে। এই পরিবর্তনটাকে গ্রহন করতেই হবে। আমরা পুরোনো কে আগলে রাখব এবং গোটা বিশ্ব এগিয়ে যাবে তা তো হয় না। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। পুরোনো কে বুকে আগলে রেখে নতুনকে প্রাণমন ভরে গ্রহন করতে হবে। ইন্টারনেটের দুনিয়াকে আমি বেশি গুরুত্ব দেব। এবং ভালো ভালো লেখকদের আবেদন করব তারা যেন এই বিশাল ক্ষেত্রে অংশগ্রহন করে। এবং ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জায়গা করে নিতে পারবে বলে আমার মনে হয়।

এখনকার সময়ে অনলাইন গণমাধ্যমে যারা লেখালেখি করছে তাদের উদ্দেশ্যে আপনার মতামত কী?

আমি বর্তমানে একটা নিউজ মিডিয়াতে কাজ করছি। সেখানে একটা নিরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। কাজ শেষ এবং এডিটও প্রায় শেষের দিকে। এই কাজে কয়েকজন মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, দুরকমের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সিদ্ধান্তটা এরকমই হয়েছে যে, এসব ক্ষেত্রে ৬০-৬৫% গুরুত্ব আমদের দেওয়া উচিত তরুন প্রজন্মকে। তার একটাই কারণ, বেশিরভাগ আমরা যেটা দেখি, যারা নামি-দামি লোক তাদের থেকে লেখা নিয়ে সেই লেখাটা প্রকাশ করা হচ্ছে, পত্রিকাগুলোর পরিচিতি বাড়ানোর জন্য। তবে বাংলা সাহিত্যের যে পরিধি সেটা যদি বাড়াতে হয়, এটা আমার একটা করুন আবেদন প্রবীণ লেখকদের কাছে তরুন প্রজন্মকে সাহিত্যের জগতে তুলে আনতেই হবে। আমি দুঃখের সাথে একটা কথা বলছি, কোথাও আমার মনে হয় তরুন প্রজন্ম যেরকম ভালোভাবে নিজেদেরকে মেলে ধরতে পারছে। তাদের কিছু সুযোগ অবশ্যই প্রাপ্য, কিন্তু সেটা তাদের দেওয়া হচ্ছে না। নতুন প্রজন্ম নতুন চিন্তাশক্তি নিয়ে হাজির হচ্ছে। আর আমি সর্বোপরি একটা কথা বলি, অনেকেই বলেন যে আমার এত বয়স হয়েছে, আমার অনেক অভিজ্ঞতা আছে, আর এরা তো মাত্র ২৫-২৬ বছরের। এরা জীবনটাকে কী দেখেছে। আমার বয়স ৬০ বছর আমি জীবনটাকে অনেক বেশি চিনি। আমি যা লিখতে পারব তার তুলনায় ও কি লিখতে পারবে? এটা কিন্তু খুব চাউড় একটা প্রশ্ন বর্তমান মানুষের কাছে। আমি ১৯৮০ সাল থেকে লিখছি। আমি দেশ, নবকল্লোলে লিখেছি। বিভিন্ন পত্রিকায়, আনন্দ বাজারে আমার প্রচুর লেখা বেরিয়েছে। এখন ৬০ বছরে এসে যার এরম কথা বলছেন তারাও একটা সময়ে কিন্তু ২০-২৫ বছরেরই ছিল। এখানে বক্তব্যটা একটু পরিস্কার করার ব্যাপার আছে। আমি যদি এইভাবে ভাবনাচিন্তা করি, একটা ২৫ বছরের ছেলে এই সময়কালে দাঁড়িয়ে তার যে চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গী, তার যে সমস্যা প্রত্যেকটি মানুষের একটা সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সমস্যা আছে, এটা মানতেই হবে। অতএব এই জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা ২৫-২৬ বছরের ছেলে যে সমস্যাগুলো অনুভব করছে, আশা করি এই শতকে দাঁড়িয়ে একটা ৬০-৬২ বছরের মানুষ সেটা অনুভব করতে পারবে না। অতএব আমি অনেকেই একটা কথা বার বার বলি, সম্পর্কটা কতদিনের সেটা বড় কথা নয়, সম্পর্কটা কতটা গভীর সেটা বড় কথা। এমনটাও তো হতে পারে ঐ ২৫-২৬ বছরের ছেলেটার যে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আছে সেটা অনেকটাই। অতএব আমার মনে হয় আধুনিক সময়ে যারা লিখছে তাদেরকে জায়গা ছেড়ে দেওয়া দরকার আমি এবং অঙ্কুর নিজেও অনেক কাজের সাথে যুক্ত, অনেক নতুনকেই জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে। মৃত্তিকা প্রকাশন ও অনেক কাজ করছে। বেশ কিছু প্রান্তিক পত্রিকাও ভালো কাজ করছে। আর সর্বোপরি আমি সকলকে একটা বার্তা দিতে চাইছি। প্রান্তিক লেখক যারা অর্থাৎ কোলকাতাকে কেন্দ্র করে প্রান্তিকভাবে লেখে তাদেরকে তুলে আনাটা ভীষণ প্রয়োজনীয়। কারণ এই প্রান্তিক লেখকরা যদি রাজধানীতে স্থান না পায়, আমরা কিন্তু চারপাশের খবর জানতে পারব না। আমি কিন্তু বারুইপুরে বসে জানতে পারব না যে প্রত্যন্ত গ্রামে কি হচ্ছে। এগুলোর খবর একমাত্র প্রান্তিক লেখকদের থেকেই পাওয়া যায়। এছাড়াও আমার মনে হয় প্রায় ৬০-৬৫ ভাগ জায়গা নতুন প্রজন্মকে ছেড়ে দেওয়া উচিত। একটা পরিস্কার কথা হল যে জায়গা ছাড়তে জানতে হয়। জায়গা আঁকড়ে রাখছি অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না, এই চিন্তাভাবনা থেকে যদি বেরোনো যায় আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্য উন্নতি করতে পারবে।

সাহিত্য জগতের বাইরে বেরিয়ে আমাদের ছোট একটা উদ্যোগ হল "প্রলিপ্ত"। এর সম্বন্ধে যদি আপনি কিছু বলেন, আগামীদিনে আমদের কি করনীয় বলে আপনি মনে করেন?

যখন আমরা ছোট ছিলাম তখন জানতাম যে বড় বড় সাংস্কৃতিক পত্রিকায় যাদের লেখা নেওয়া হচ্ছে তারাই লেখক। এবং তাদের নামটাই প্রকাশ্যে আসছে। মানুষ যতটুকু যশ করছে তাদের জন্যই করছে। একটু আগে যেটা বললাম প্রান্তিক লেখক বা সমসাময়িক কিছু লেখক তারা জায়গা পাচ্ছে না। আমি একটাই উপদেশ দেব বা দৃষ্টিভঙ্গী ভাগ করে নেওয়ায় বলতে পারো, একটু যদি আমরা ভারতবর্ষের ইতিহাসটা ঘাঁটি দেখতে পাব যে অনেক প্রতিভা নষ্ট হয়ে গেছে শুধুমাত্র তারা প্রকাশ্যে আসতে পারেনি বলে। আমি সক্কলকে নত মস্তিষ্কে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছি, হয়তো আরও কিছু খনিজ সম্পদ উঠে আসতে পারতো, কিন্তু তথাকথিত ব্র্যান্ডের অভাবে তা হারিয়ে গেছে।  আমরা পারিনি প্রতিভা তুলে আনতে তার দায়ভার অবশ্যই আমাদের। সেই প্রেক্ষিতে গণমাধ্যমের উপর আমার আস্থা অনেক রয়েছে। আমার আস্থা অঙ্কুর এবং তার সাথে যারা কাজ করছে তাদের উপরেও আস্থা আছে। এবং একটা খুব ভালো খবর হলো এখন ২৪-২৫ বছরের যুবক যারা তারা পত্রিকার সম্পাদক হচ্ছে। এবং নতুন নতুন ছেলেমেয়েদের তারা সাহিত্য জগতে তুলে আনছে, অনুষ্ঠান হচ্ছে। এখন অবশ্য লকডাউনের জন্য নিয়মিত অনুষ্ঠান করা যাচ্ছে না। মোট কথা একটা সাহিত্যের উৎসব তৈরি হচ্ছে। মেলবন্ধন হচ্ছে পুরনোর সাথে নতুনের। আমার মনে হয়, আজ থেকে যদি আমরা ১০-১৫ বছর আগে ফিরে যাই তখন সংস্কৃতি মানেই আকাশবাণী, দূরদর্শন, এইসব। কিন্তু এখন সংস্কৃতি গ্লোবালাইজ হয়েছে। সবজায়গাতেই একটা সাহিত্য অঙ্গন তৈরি হয়েছে। আশা রাখি বর্তমান যুগের ছেলেরা যারা প্রকৃত প্রতিভাসম্পন্ন তারা অনেক ভালো কাজ করবে এবং আমার আশির্বাদ ভালোবাসা, শুভকামনা সবসময়ই আছে এবং ভবিষ্যতে ঘনিষ্ঠতার সাথেই থাকবে। এবং আমি মনে করি যুবকরাও সেদিনই ভালো কাজ করতে পারবে যেদিন বয়জ্যেষ্ঠরা তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। আমি এটাই আশা রাখি এবং এটুকুই আমার বলার।


প্রলিপ্ত তরফ থেকে কথোপকথনে কাঁকন খাঁড়া 

পোস্টার Arnabjit Mandal