হরিহর শেঠ-এর বাড়ি
চন্দননগরের স্বনামধন্য ঐতিহাসিক হরিহর শেঠের মতে Dupleis নামে এক ফরাসী ভদ্রলোক ১৬৭৩-৭৪ সালে ৪০১ টাকা দিয়ে ৬০ বিঘা জমি কিনেছিলেন বোডকিষেনপুর অঞ্চলে যেটি এখন তালডাঙ্গা নামে পরিচিত। এখানে ‘তাউৎখানা' নামে একটি বাগান ছিল। এই বাগানেই নীল চাষ শুরু হয়েছিল। সুরক্ষার জন্য চারদিকে গড় দিয়ে ঘেরা ছিল। আজ তা বনে জঙ্গলে ঢাকা পড়ে গেলেও তার অবস্থান বোঝা যায়।
এরপরে ১৬৭৪ সালে চন্দননগরে ফরাসীদের বাণিজ্য বসতি শুরু হয়। দেনাল্ডে (Deslande), ফরাসী কোম্পানীর তরফে প্রথম অধিনায়ক এখানে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করেছিলেন। তখন সকল বিদেশীরাই নিজ নিজ কূঠী রক্ষার জন্য দুর্গ নির্মাণ করতেন। চন্দননগরের গঙ্গা তীরে 'আঁলিয়া দুর্গ' ( Fortea deorleans) দেনাল্ডের কীর্তি। কর্ণেল লর্ড ক্লাইভের স্থলবাহিনী ও এ্যাডমিরাল ওয়ার্টসনের নৌবাহিনী 'আঁলিয়া দুর্গ' বিধ্বস্ত করে পতন ঘটায় ১৯৫৭ খৃষ্টাব্দে ২৩-শে মার্চ। এই দুর্গের আজ আর কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও অনেক মতবিরোধ আছে তথাপি নির্ভরযোগ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বর্তমান ‘ঊর্দিবাজার' এর অবস্থান হিসাবে মেনে নেওয়া যেতে পারে।
দুর্গ বিধস্ত হবার পর ফরাসী আমলে উত্তর ভারতীয় মুসলিম সৈনিকরা বাস করত। আজও তাদের বংশধররা এখানে বাস করে। যদিও নানারকমভাবে ছড়ানো ছিটানো আগোছালো ভাবে পুরাতন জিনিসের বিক্রয় কেন্দ্র রূপে দৈন্যদশা চোখে পড়ে তবু যেন ইতিহাস টেনে নিয়ে চলে।
তালডাঙ্গা ছাড়িয়ে জি . টি . রোড বরাবর এগিয়ে সরিষাপাড়ার মোড়ে একেবারে জি.টি. রোডের ধারেই একটি লাল রং করা পুরানো বাড়ি৷ বাঁ দিকে একটি ছোট ঘরের দিকে একটি সাদা তাকালে দেহে শিহরণ জাগে।
একটি সাদা প্রস্তর মূর্তি ! ইনিই বীর শহীদ কানাইলাল দত্ত। নিজেদেরই দলের লোক নরেন গোঁসাইকে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য জেলে গুলি করার অপরাধে এর ফাঁসি হয়। ইতিহাস পিছু টানে ! জেলখানায় কানাইলালকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কি করে তাঁরা রভালবার পায়? উত্তরে বলেছিলেন “ক্ষুদিরামের ভূত আমাদের রিভালবার দেয়।"
বোড়াই চণ্ডীতলার পাশ দিয়ে গেলে পড়ে প্রবর্তক সংঘ। প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল রায় ও তাঁর স্ত্রীর পাথরের মূর্তি দেখা যায়। চারুচন্দ্র রায়ের বাড়িতে অরবিন্দ কিছুদিন বাস করে ছিলেন। নিত্যগোপাল স্মৃতি মন্দিরেও অনেকের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
বেসোহাটায় একটি বাড়ি, গুলিমারা বাড়ি চন্দননগরের দক্ষিণ দিকে পড়ে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে যুক্ত অনেক বিপ্লবী এখানে আত্মগোপন করে থাকার সময় পুলিশের সঙ্গে প্রবল গুলি বিনিময় হয়েছিল।
ঊর্দিবাজার থেকে গঙ্গার ধার ধরে কিছুটা এগিয়ে ডানদিকে কোর্ট। এখানে ছিল ফরাসীদের একটি হোটেল। আর এখন যেখানে থানা সেখানে ছিল ফরাসীদের পুলিশ হেডকোয়ার্টাস। রবীন্দ্র ভবন , ডুপ্লে কলেজ পার হয়ে চার্চের দিকে গেলে চোখে পড়ে শহীদ চট্টগ্রাম বিদ্রোহের মাখনলাল ঘোষের মূর্তি। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অন্যতম বীর সৈনিক। কুখ্যাত চার্লস টেগার্ট বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে মৃত্যুমুখে পতিত।
আবার গঙ্গার ধারে ফিরে এসে কিছুটা হেঁটে গেলেই রাস্তার ধারে চোখে পড়ে একটি লেখায় — " Institut De Chandernagore Museum Library , French Language Study. .....ফরাসী গভর্ণর যোসেফ ফ্রাসোয়া"। ডুপ্লের বাসস্থান ছিল এটা। ১৯৫১ সালের মুক্ত চন্দননগরের প্রথম প্রেসিডেন্ট হরিহর শেঠ মহাশয়ের নিজস্ব সংগ্রহ ও ফরাসী সংস্কৃতির সমন্বয়ে এই মিউজিয়াম গঠিত। চন্দননগরকে জানতে ও বুঝতে বাইরে থেকে আসা কোন ভ্রমণ পিপাসু ব্যক্তি যদি প্রথমে এখানে আসেন তবে তাঁর সবকিছু খুব সহজ হয়ে পড়বে। বাগানের সম্মুখে চন্দননগরের ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থানগুলির পথ নির্দেশিকা এমনভাবে উপস্থাপিত করা আছে যা সবকিছু চোখের সামনে ভেসে ওঠে ।
মিউজিয়ামের ভিতরে প্রবেশ করছি। বিশ্বের সমগ্র জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি প্রেমিক জগত হিসাবে ফরাসীদের নাম করতে হয়। এখানে এলেই তার নিদর্শন পাওয়া যায়৷ যদিও এটা অভিপ্রেত ছিল না তবুও না বলে পারা যায় না যে চন্দননগর যদি ফরাসী শাসিত না হতো তাহলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসে বিপ্লবের ধারা অন্যরকম হতো। তাই এই ফরাসীদের কথা লেখার প্রবণতা এসে যাচ্ছে।
ভিতরে গভর্ণর যোফেস ফ্রমোখ। ডুপ্লের (১৭৩১ – ১৭৪১) মূর্তি, ওনার ব্যবহৃত সামগ্রী ফুলদানি, বাসনপত্র , টেবিল চেয়ার , বিশাল খাট , খাটটির খিলানের আকারে ব্যাটম, চারদিকে ড্রয়ার যাতে থাকত নানা রকম আগ্নেয়াস্ত্র — সব কিছু যেন ফরাসীদের মনে করিয়ে দেয়।
তারপর হরিহর শেঠের বহু পুরানো পুঁথি। বুদ্ধদেবের মুন্ডবিহীন পাথরের মূর্তি। সেই সময়কার ব্যবহৃত মুদ্রা , শোলার সাজে জগদ্ধাত্রী ও দুর্গা, একটি পাথরের দুর্গা মূর্তি , মুঘল আমলের তরবারী, একটি পেতলের দশমাথা রাবণ। আরও পুরানো ইতিহাসের সাক্ষী সযত্নে রক্ষিত। জোড়াবাংলো মন্দিরের অনুকরণে পোড়ামাটির খিলান দেওয়া এক কাঠের মন্দির। বিদ্যাসাগরের হাতে লেখা ইংরাজী ও বাংলা চিঠি , রবীন্দ্রনাথের হাতে আঁক ছবি । দেওয়ালে টাঙানো দেশের বরেণ্য ব্যক্তি , বিপ্লবী , সমাজ সংস্কারক , কবি , সাহিত্যিকদের ছবি , বিংশ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনের পত্রিকা - এমনভাবে সাজানো গোছানো আছে যে ভারত-ফরাসী সংস্কৃতির মিলনকেন্দ্র রূপের পরিচায়ক এই সূত্রে কালিচরণ কর্মকার মহাশয়ের নাম অপরিহার্য।
বেরিয়ে এসে অতীতের সাক্ষ্যবহনকারী কুলুকুলুরবে প্রবহমান। ভাগীরথীর তীরে প্রাচীন বৃক্ষের ছায়াতলের পাশ দিয়ে প্রশস্ত পথে হেঁটে গিয়ে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ ও বিদ্যাসাগরের স্মৃতি বিজড়িত 'পাতালবাড়ি'। গঙ্গা গর্ভের এই বাড়িটিতে রবীন্দ্রনাথ কাব্য রচনায় কিছুদিন নিমগ্ন ছিলেন। বাড়িটির ভিতরে যাবার আজ আর উপায় নেই। কারণ তা এখন অন্য লোকের দখলে।
প্রথমেই যে জায়গার কথা বলার প্রয়োজন ছিল সেটা হচ্ছে চন্দননগরের দক্ষিণ প্রান্তে গোন্দলপাড়ার কথা। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই স্থানটির ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে নরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। বহু বিপ্লবী এখানে আত্মগোপন করেছিলেন। প্রথমেই নাম করা যায় যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন) , যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে। বাঘা যতীন এখান থেকে অস্ত্র নিয়ে যেতেন। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল এখানে এসেছিলেন। বসন্ত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীশ চন্দ্র ঘোষ জেলে গোঁসাইকে হত্যা করার জন্য এখান থেকে পিস্তল পাঠিয়েছিলেন। শ্রী অরবিন্দ কিছুদিন এই বাড়ীতে আত্মগোপন করেছিলেন।
সত্যাগ্রহী লবণ আইন অমান্য করার উদ্দেশ্যে মেদিনীপুর যান। গোন্দলপাড়ার সত্যেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় , পরিতোষ মুখোপাধ্যায় , তারাপদ মুখোপাধ্যায় , প্রভাত গঙ্গোপাধ্যায়। অনন্ত সিংহ , গণেশ ঘোষ , মাখনলাল ঘোষাল , আনন্দ গুপ্ত ও লোকনাথ বল গোন্দলপাড়ায় একটি বাড়ি ভাড়া করেন , এখানে পুলিশের গুলিতে মাখনলাল নিহত হন। গোন্দলপাড়ায় তাঁর একটি স্মৃতি ফলক আছে। বসন্ত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের বাড়িতে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে পলাতক বিপ্লবী দীনেশ মজুমদার, হিজলী ক্যাম্প থেকে পলাতক নলিনী দাশ ও শচীন কর গুপ্ত প্রমুখকে আশ্রয় দেন। তারপর তাঁরা উত্তর চন্দননগরে বাসুদেব চট্টোপাধ্যায় ও ডঃ হীরেন চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। কৃষক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা কমিউনিস্ট মতাবলম্বী যিনি ১৯৩২ সালে স্টেটস্ম্যান পত্রিকার সম্পাদক আলফ্রেড ওয়াটসনকে হত্যা করার অপরাধে জেলে যান ও যিনি ১৯৫২ সালে মুক্ত চন্দননগরের নির্বাচিত শাসন পরিষদের দ্বিতীয় সভাপতি ও মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের দ্বিতীয় মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন সেই তিনকড়ি মুখোপাধ্যায় এখানকার ব্যক্তি।
গোন্দলপাড়ায় মোরান সাহেবের বাগানে, একটি নীল কুঠি ছিল। গঙ্গার ধারে মোরান সাহেবের অট্টালিকায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের প্রথমদিকে অনেকদিন ছিলেন। এই বাড়িটি আজ আর নেই। এখানে তৈরী হয়েছে গোন্দলপাড় জুট মিল। মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চাতা নিৰ্দ্ধারণে যার নাম জড়িয়ে আছে সেই বাঙ্গালি গণিতঙ্গ পণ্ডিত রাধানাথ শিকদার ছিলেন এই গোন্দলপাড়ার ব্যক্তি। 'রাধানাথ শিকদার রাস্তা' আজও তাঁর স্মৃতি বহন করছে ।
বাগবাজার থেকে ষ্টেশন রোড ধরে গেলে রাসবিহারী রোডে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পৈত্রিক বাসভবন অনেক কথা মনে করিয়ে দেয়।
জি. টি.রোড ধরে যাবার পথে ছবিঘরের কাছে নন্দদুলালের মন্দির।
বিপ্লবীদের ইতিহাস চন্দননগরের প্রায় সর্বত্রই যেন ঢেকে রেখেছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয় , এই বিপ্লবীদের যাঁরা নানাভাবে অনুপ্রাণিত করে বিপ্লবের পথে এগিয়ে দিতে সাহায্য করে বিপ্লবী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন তাঁদের কথা না বললে ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
ডাক্তার হিসাবে যজ্ঞেশ্বর শ্রীমানী ও মঃ গোবিনের নাম উল্লেখযোগ্য। অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন রূপলল নন্দী , প্রমথনাথ মুখোপাধ্যায়, হরিহর শেঠ, ফল কৃষ্ণ পাল, হাবুলাল ভড় , দুর্গাদাস শেঠ , আরও অনেকে। সর্বাগ্রে উল্লেখ্য রূপলাল নন্দীর 'গোলা কুঠির’ বাড়িতে বিপ্লবীদের আশ্রয় দান। ছাড়াও সতীশ কুণ্ডর বাগান বাড়ি , ঘোড়া পুকুর ধারে ক্ষেত্রমোহন বসুর বাড়ি , ফটকগোড়ায় শ্রীশ সেনের বাড়ি , হলদেডাঙ্গার কার ফর্মার বাগান, করের বাগান বিপ্লবীদের আশ্রয় দান বিশেষ ভূমিকা বহন করে ।
পূর্ণচন্দ্ৰ মালাকার , তারাপদ মল্লিক, হীরালাল শেঠ , যতীন পাল , রাধা বিনোদ পাল , অরুণচন্দ্র সোম , হরিচরণ ঘোষ , রামেশ্বর দে , সন্তোষ দে প্রমুখ বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন সহৃদয় ব্যক্তি নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপ্লবীদের আত্মগোপনে সহায়তা করে বিপ্লবের ইন্ধন জুগিয়েছিলেন। চন্দননগরের সব কিছু দেখে হৃদয়ঙ্গম করতে গেলে দু - একদিন থাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
পুরাতন আমলে চন্দননগর জোড়া ঘাট
১৯৫০ সালের ২ রা মে শেষ ফরাসী এ্যাডমিনিস্ট্রেটর মঁসিয়ে তাইওয়ে বসন্ত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (আই .এ. এস)- কে চন্দননগরের শাসন ভার অর্পণ করেন। আর আন্তর্জাতিক আইনে চন্দননগর ১৯৫৪ সালে পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ করে। ভারতবর্ষে অন্তর্ভুক্তি লাভ করে। ১৯৫৫ সালে ২ রা মে আনুষ্ঠানিকভাবে চন্দননগর ভারতবর্ষের মধ্যে চলে আসে।
গবেষণা এবং স্বত্বাধিকার: প্রলিপ্ত টিম