তরুণ মজুমদারের সিনেমার প্রথম দর্শক ছিলেন সত্যজিৎ রায়। তা কিছুটা তরুণের আবদারেই। সিনেমা নিয়ে মাণিকবাবুর থেকে পরামর্শ নিতেন। খুঁটিনাটি সব বিষয়ে আলোচনা করতেন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে।
তরুণ মজুমদারের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম পরিচয় পথের পাঁচালীর দেখার মধ্যে দিয়ে। ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা দেখে আসা এক বন্ধুর কাছে প্রথমবার সত্যজিৎ রায়ের অনবদ্য ছবি পথের পাঁচালীর কথা শোনেন তিনি। বন্ধুর দাবি ছিল, সিনেমাটা খারাপ না হলেও সিনেমাটি চলবে কীনা? সেই বিষয় যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন তিনি।বলা বাহুল্য সেই রাতেই সবাই মিলে সিনেমা দেখা হয় নাইট শোয়ে। নিজের লেখায় তিনি জানিয়েছেন গভীর রাতে সিনেমা শেষ করে বেরিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন সকলেই। কলকাতার অন্ধকার রাস্তায় শুধু মাত্র শোনা যায় তাদের হাঁটার শব্দ। রাতের ফাঁকা শহরে সত্যজিৎ-এর পথের পাঁচালী যে সেই কয়েকজন বন্ধুকে নিশ্চিত ভাবিয়ে তুলেছিল যার প্রমাণস্বরূপ নিদর্শন ছিল পরের দিন সকালের মিছিল। পরেরদিন সকালে দেশপ্রিয় পার্কের গেট থেকে শুরু হয় পথের পাঁচালীর সমর্থনে মিছিল।
সেই মিছিলে ছিল না স্লোগান, চিৎকার অথবা বিতর্ক। শুধু ছিল পোস্টার, সেখানে লেখা, 'পথের পাঁচালী দেখুন', 'পথের পাঁচালী দেখা আমাদের কর্তব্য'।
সত্যজিৎ-এর জন্য পথে নামা পূর্ণতা পায় যখন সত্যজিৎ নিজে তরুণ মজুমদারের সিনেমা বিদেশে পাঠানোর কথা বলেন। "সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন যে ওঁর যে 'সংসার সীমান্তে' সিনেমাটি বিদেশের সব বড় ফেস্টিভালে পাঠানো উচিত। সুতরাং আমরা ওঁর মূল্যায়ন করার যোগ্যই নই। যারা যোগ্য ছিলেন তাঁরা ওকে একটি বিশেষ জায়গা দিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে।"
তার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের অমূল্য সম্পর্কের কথা তিনি নিজেই সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এইভাবে যে 'এক দিন স্টুডিয়োর অফিসে বসে কাজ করছি, এমন সময় আমারই কিছু বন্ধু-পরিচালক এসে হাজির। এক জনের হাতে কিছু ফাইলপত্র আর রেজিস্টার খাতা। আমাদের এই বাংলা ছায়াছবির ক্ষেত্রে যেমন আর সবার একটা করে গিল্ড বা ইউনিয়ন আছে, পরিচালকদের সে রকম কোনও সংগঠন নেই। ফলে, এখানকার রাজ্য সরকার আর বিশেষ করে কেন্দ্রের সরকারের কাছে নানা রকম দাবিদাওয়া উপস্থিত করা আর সেই বাবদ কিছু আর্থিক সহায়তা আদায় করে আনার মতো কোনও সংস্থা নেই। এই সব আলোচনার জন্য দু’দিন পরে ওঁরা ক্যালকাটা মুভিটোন স্টুডিয়োতে পরিচালকদের একটা সভা ডেকেছেন। সেখানে যেন আমিও উপস্থিত থাকি।
যথারীতি সেদিন সভায় আমন্ত্রিত অতিথির মতো উপস্থিত হলাম , কিছুক্ষণ পর যখন আগামী বছরের জন্য কার্যকরী সমিতির সভ্যদের নাম ঘোষণা করা হবে তখন হঠাৎ নজরে পড়ল বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায়- মৃনাল সেন - ঋত্বিক ঘটক - তপন সিংহ এরা সবাই অনুপস্থিত। জিজ্ঞেস করার পর জানা গেল এই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি তাদের গুরুগম্ভীর মেজাজের ভয়ে। সবার সাথে আলোচনা করে আমি তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, সত্যজিৎবাবুর কাছে আমি নিজেই যাব। শর্ত একটাই— উনি যদি এই উদ্যোগে রাজি হন তা হলে ওঁকেই সংগঠনের মাথায় বসাতে হবে। কারণ, সারা দেশ ওঁকে চেনে আর শ্রদ্ধা করে। তার পর না হয় একে একে বাকি সবার কাছে যাওয়া যাবে।
অত্যন্ত বিরসবদনে উদ্যোক্তারা জবাব দিলেন, ‘‘ঠিক আছে, তা-ই যান।’’
আমার কাছে সমস্ত প্রস্তাবটি শুনে সত্যজিৎবাবু খুবই খুশি হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘‘এ রকম একটা সংগঠন খুবই দরকার ছিল। ঠিক আছে, তোমরা এগোও। কিন্তু পরের মিটিং তোমরা যে তারিখে রেখেছ, সে দিন তো আমি কলকাতায় থাকছি না। আমার সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আমি এখনই একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি।’’ পরে উনি জানতে চেয়েছিলেন ‘‘কী? কী হল তোমাদের সেই ডিরেক্টর্স গিল্ডের?’’ লজ্জায় জবাব দিতে পারিনি। উনি শুধু বললেন, ‘‘ও রকম একটা body থাকার খুবই দরকার ছিল।’’
এরপর দ্বিতীয় কাহিনীতে পদার্পণ করি ,একটা ছবি বানিয়েছিলাম— ১৯৭৪ সালে। নাম ‘ফুলেশ্বরী’।
শুন শুন মহাশয়, শুন দিয়া মন—
বিচিত্র কাহিনি এক করিব বর্ণন।।
যদিও জানি গো ইহা চুয়াত্তর সন—
দিকে দিকে প্রগতির কত না লক্ষণ।।
জলেতে জাহাজ ওড়ে, আকাশে বিমান—
কলে-মিলে ধর্মঘট, মিছিল-স্লোগান।।
‘জন্ম নিয়ন্ত্রণ’ আর ‘গরিবি হাটাও’—
ইন্দিরা-নিক্সন-ভুট্টো-কোসিজিন-মাও।।
ফেলিনি-গোদার-ত্রুফো-সত্যজিৎ রায়—
ইহাদের সকলেরে রাখি গো মাথায়।।
এর পরেই স্মৃতি-মেদুরতার গন্ধ মেখে
পরের লাইন:
‘তবু মাঝে মাঝে মন যেতে চায় ফিরে ফিরে’—
একটা সবুজ-সবুজ গ্রাম। মাটির পথ ধরে এগিয়ে চলেছে একটি মেয়ে। কাঁখে কলসি— ইত্যাদি ইত্যাদি।
চিত্রনাট্য লেখার সময় থেকেই মনে মনে ভাবা ছিল যে, গানে যাঁদের যাঁদের নাম বলা আছে— ছবির সেই অংশে তাঁদের স্টিল ফোটোগ্রাফ ব্যবহার করা হবে। যেমন ইন্দিরা-নিক্সন থেকে শুরু করে সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত সবার। সত্যজিৎবাবুকে অবশ্য এ ব্যাপারে জানানো হয়নি কিছুই। কারণ, ওঁর ফোটোগ্রাফ জোগাড় করা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। গোদারের ছবিও পাওয়া গেল। কিন্তু মুশকিল বাধল ফেলিনির ছবি নিয়ে। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। কী করা যায়? হঠাৎ মনে হল এ ব্যাপারে সত্যজিৎবাবুর সাহায্য নিলে কেমন হয়? ফোনে ওঁর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে পর দিন সকাল হাজির হলাম ওঁর ফ্ল্যাটে। সব শুনে উনি বললেন, ‘‘ফেলিনির ছবি? আমাকে দিন সাতেক সময় দিতে পারবে?’’
রাজি হয়ে গেলাম।
ঠিক সাত দিন পরে সকাল ন’টায় ওঁর ফ্ল্যাটে গিয়ে বেল বাজালাম। উনি নিজেই দরজা খুললেন। চেয়ে দেখি অদূরে, মেঝের ওপর, রাশি রাশি বিদেশি ফিল্ম ম্যাগাজিন আধখোলা অবস্থায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। তাদের মধ্যে ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’, ‘ফিল্ম অ্যান্ড ফিল্মিং’ জাতীয় পত্রিকাও উঁকি দিচ্ছে। আমাকে দেখেই সত্যজিৎবাবু বলে উঠলেন, ‘‘পেয়েছি একটা, বুঝলে। ছবিতে একটু গ্রেন আছে, তবে মনে হয় তোমার কাজ চলে যাবে।’’ এই বলে বিশেষ একটা ম্যাগাজিনের সারা পাতা-জোড়া একটা ছবি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে জানতে চাইলেন, ‘‘কিন্তু হঠাৎ ফেলিনির ছবি নিয়ে কী করবে বলো তো?’’ তখন আমি খুলে বললাম, আর এ-ও বললাম যে ‘‘আপনার ছবিও দরকার, কিন্তু তার জন্য আর আপনাকে কষ্ট দেব না। ও আমি ঠিক জোগাড় করে নেব।’’
শুনে দরাজ গলায় হোহো করে হেসে উঠলেন উনি। সেই হাসি এখনও আমার কানে লেগে আছে। আমার জন্য এক সপ্তাহ ধরে একটা ছবি খুঁজে দিয়েছেন তিনি, এই ঋণ আমি কেমন করে মেটাব?
পরবতী ঘটনা হল-
'সংসার সীমান্তে’ নামে আমার একটা ছবি মুক্তি পেয়েছে। প্রথম দিন এসেই ছবিটা দেখে গিয়েছেন উনি।
হঠাৎ একদিন আমার এবং সত্যজিৎ বাবুর উভয়ের পরিচিত একজন এসে আমায় বললেন 'সত্যজিৎ রায় বলেছেন এখনই তোমার ছবির একটা shorter version বানিয়ে ফেলতে'।
আমি শুনে খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। সত্যজিৎবাবুর মতো ব্যস্ত মানুষ সব কাজ ফেলে আমাকে ও রকম একটা উপদেশ দিতে যাবেন, — কেন? কী দায় পড়েছে ওঁর? তাই আমি আর গা করলাম না।
পরেরদিন ওই ভদ্রলোক হাজির হলেন এবং বললেন বানিয়েছো তোমার ছবির। Shorter version?
আমি বললাম, ‘‘দেখি ভেবে।’’
‘দেখি ভেবে’ মানে? সত্যজিৎ বাবু কী রকম তাড়া দিচ্ছে, জানো? এর মধ্যে এখানে ওখানে চিঠি লিখে ছবিটার পাবলিসিটি শুরু করে দিয়েছে। বিশ্বাস না হয় তো এক বার কথা বলে দেখো।’’
অগত্যা তা-ই ঠিক হল। টেলিফোন করলাম। উনি বললেন, ‘‘কাল সকাল ন’টায় চলে এস।’’
ঘরে ঢুকে সোফায় মুখোমুখি বসলাম আমরা।
আমাদের দুজনের কথোপকথনটা হল এরকম
আমি একটু ইতস্তত করে ওনাকে বললাম, ‘‘আপনি কি আমার ছবির একটা shorter version বানাতে বলেছেন?’’
‘‘হ্যাঁ তো। এখনও শুরু করোনি?’’
আমি বললাম, ‘‘shorter version মানে তো বিদেশি দর্শকদের জন্য। তা, ওই শ্রেণির দর্শক এ ধরনের ছবির কোন কোন অংশ ছাঁটাই করলে—’’
উনি আমার কথাটা শেষ করতেও দিলেন না। হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে সোজা চলে গেলেন একটা ড্রয়ারের কাছে। একটা কাগজ বার করে আমার সামনে বাড়িয়ে ধরলেন। অবাক হয়ে দেখলাম, বাদামি কালিতে ১, ২, ৩, ৪ করে অনেকগুলি মন্তব্য। ওঁর মতে কোন কোন অংশ সংক্ষিপ্ত করা উচিত— তার একটা বিস্তৃত তালিকা।
যে কাজ আমি শুরুই করিনি, মাত্র এক বার দেখেই উনি সেই কাজ সেরে রেখেছেন আমার হয়ে! এই ভালবাসা পেয়ে আমি গর্বিত। কাগজটা আজও সযত্নে রেখে দিয়েছি। পরের প্রজন্মের পরিচালকদের জন্য আমরা হয়তো কিছুই করতে পারি না, কিন্তু আগের প্রজন্মের উনি একটা দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এ-ও এক ধরনের শিক্ষা যা আমরা ওঁর কাছ থেকে শিখেছি।
সমাপ্তিতে একটাই আক্ষেপ রয়ে গেল বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে এই নক্ষত্র রুচিশীল কিন্তু বিনোদনোজ্জ্বল ছবি-নির্মাণের যে অপূর্ব তারুণ্যময় কলা ও কৌশলের উত্তরাধিকার রেখে গেলেন তার ধারা অব্যাহত রাখার যোগ্য কান্ডারী কী আদৌও আছে???