Hooghly Series:ভদ্রেশ্বরের ৫০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন ভদ্রেশ্বরনাথ ও মা অন্নপূর্ণা - Pralipta


সমীরণ চন্দ্র বনিক: ভদ্রেশ্বর স্টেশনে নেমে টোটো করে চলে গেলাম ভদ্রেশ্বর নাথ শিব মন্দিরে। মানুষের বিশ্বাস এই যে ভদ্রেশ্বর নাথের নাম থেকেই ভদ্রেশ্বর অঞ্চলের নামের উৎপত্তি। এই নিয়ে নানা কিংবদন্তি রয়েছে।



তবে ভদ্রেশ্বর অঞ্চলটি খুবই প্রাচীন। বিপ্রদাস পিপলাই ( ১৪৯৫ )রচিত মনসামঙ্গল কাব্যে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য যাত্রা পথের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেই যাত্রাপথে অন্যান্য নামের সঙ্গে কিন্তু ভদ্রেশ্বর নামটির উল্লেখ আছে। তাছাড়া কাব্যে যে সমস্ত অঞ্চলের নামের উল্লেখ আছে তার মধ্যে বহু অঞ্চলের নামই, সেই নামে এবং স্বমহিমায় আজও বিরাজমান। ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে রচিত পাইলট বা নাবিকদের যাত্রা পথের তালিকায় ভদ্রেশ্বরে নামের উল্লেখ আছে বুদেশি নামে। ভদ্রেশ্বরে একসময় ডেনমার্ক বনিকদের বাণিজ্য কুঠী ছিল। সেই জন্য ভদ্রেশ্বরের একটা জায়গার নাম দিনেমার ডাঙ্গা। 


এই বারে আসছি ভদ্রেশ্বর নাথ শিব মন্দিরের কথায়। এই ভদ্রেশ্বর শিব মন্দির যে কতটা প্রাচীন তা বলা খুব মুশকিল। কারণ মন্দিরে কোন প্রতিষ্ঠা ফলক নেই। কারো মতে এই ভদ্রেশ্বরনাথ শিবলিঙ্গের নাম থেকেই এই ভদ্রেশ্বর নামের উৎপত্তি। এই মতটাকে যদি সত্যি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে এটা ৫০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন। কারণ বিপ্রদাস পিপলাই এর গ্রন্থে ভদ্রেশ্বর নামের উল্লেখ আছে। আবার কারো মতে এই ভদ্রেশ্বর অঞ্চলে এই শিবলিঙ্গের প্রকাশ ঘটেছে বলে এই শিবলিঙ্গের নামকরণ করা হয়েছে ভদ্রেশ্বর নাথ। মন্দিরের গর্ভগৃহে যে শিবলিঙ্গ দেখতে পাই, তা স্বয়ম্ভু, এই শিবলিঙ্গের মাথায় বড়সড়ো একটি ফাটল, বা ক্ষতচিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়।

তাই নিয়েও নানা মুনির নানামত। কেউ বলেন, এই শিবলিঙ্গটি মাটির তলায় চাপা পড়া অবস্থায় ছিল। একটা গরু এসে প্রতিদিন সেই জায়গায় দুধ দিয়ে যেত। এক চাষী সেই ঘটনাটা দেখতে পেয়ে তার খুব কৌতূহল হয় যে, কেন গরুটি এখানে প্রতিদিন দুধ দেয়। সেই তখন ওই মাটি খুঁড়ে এই শিব লিঙ্গটি দেখতে পায়। এবং এও দেখতে পায় যে, শিবলিঙ্গের মাথায় একটা মহামূল্যবান মানিক আছে। মানিক দেখতে পেয়ে তার খুব লোভ হয়।

সে তখন কোদালের আঘাতে লিঙ্গের মাথায় আঘাত করে, মানিকটা বের করে নিয়ে গঙ্গার কাছে চলে যায়। আসলে সে চেয়েছিল ওই মানিকটা নিয়ে নৌকো করে গঙ্গা পেরিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। কিন্তু তার ইচ্ছে পূরণ হয়নি, যেকোনো কারণেই হোক, সেখানেই তার মৃত্যু হয়। সেই জন্যই নাকি ওই জায়গাটার নাম মানিকনগর ঘাট ও শ্মশান।

আবার কারো মতে, হোগলা ও বেতবন পরিষ্কার করতে গিয়ে কোদালের আঘাতে পাথরের মাথায় ফাটলের সৃষ্টি হয়। যারা জঙ্গল পরিষ্কার করছিল তখন তাদের মনে কৌতুহল তৈরি হয়। তারা বহু চেষ্টা করেও ওই পাথরটাকে মাটি থেকে তুলতে পারিনি। তখন তারা বুঝতে পারে যে এই পাথরটির মধ্যে নিশ্চয়ই কোন ঐশ্বরিক বা অলৌকিক ব্যাপার লুকিয়ে আছে।

তখনকার বিজ্ঞ মানুষরা উপলব্ধি করতে পারেন যে, এটা নিশ্চয়ই শিবলিঙ্গ এবং তিনি স্বয়ম্ভূ। তখন সেখানে মাটির ঘর তৈরি করে সেখানেই ওই লিঙ্গের পুজো অর্চনা শুরু হয়। পরবর্তীকালে বর্ধমানের মহারাজা পাকা মন্দির তৈরি করে দেন। এবং তিনিও নাকি চেয়েছিলেন শিবলিঙ্গটিকে বর্ধমানে নিয়ে যেতে। কিন্তু তার সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি। বর্ধমানের মহারাজা এই শিবলিঙ্গের নিত্য পূজা অর্চনার জন্য প্রচুর জমি দেবত্তোর করে গেছেন। বর্তমানে সেইসব জমির অনেকটাই বেদখল হয়ে গেছে।


তবে এসবই কিছুটা সত্যি আর কিছুটা মিথ বা কিংবদন্তি বা জনশ্রুতি। বিশ্বাস করা বা না করাটা যার যার ব্যক্তিগত বিষয়।
তবে গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গের মাথায় যে একটা বড়সড় ফাটল আছে সেটা সত্যি, যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি।

স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস, কাশীর বিশ্বনাথ, তারকেশ্বরের তারকনাথের মতন ভদ্রেশ্বরের ভদ্রেশ্বরনাথ যেহেতু স্বয়ম্ভূ, তাই তার মাহাত্মই আলাদা। এক বিদেশী ভ্রমণকারী চার্লস জোসেফ বলে গেছেন ভদ্রেশ্বর অতি প্রাচীন শহর ও ভদ্রেশ্বর নাথ নিজেই আবির্ভূত হয়েছেন। একসময় এই মন্দিরের কাছ দিয়েই ভাগীরথী নদী প্রবাহিত হতো। বর্তমানে তা অনেকটাই সরে গেছে।

তেলেনি পাড়া বা ভদ্রেশ্বরের বন্দোপাধ্যায় জমিদারদের বংশ পরিচয় লেখা আছে, তারা এই ভদ্রেশ্বর নাথের মন্দির নির্মাণ করেছেন। এছাড়াও এই মন্দিরের পেছনে একটি অন্নপূর্ণার মন্দিরও তারা নির্মাণ করেছেন।
গতকাল একটি পোস্টে তেলিনী পাড়ায় স্থানীয় জমিদার বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নির্মিত একটি প্রাচীন অন্নপূর্ণা মন্দিরের উল্লেখ করেছি।
তাদের পরিবারের কেউ এই ভদ্রেশ্বর নাথ মন্দিরের পেছনে অন্নপূর্ণা মন্দির নির্মাণ করে গেছেন।

শিব মন্দিরের পেছনেই যেহেতু অন্নপূর্ণা মন্দির, তাই স্থান মাহাত্মের দিক থেকে এই অঞ্চলটি কাশীর সমতূল। কারণ একমাত্র কাশীতেই শিব মন্দিরের পেছনে অন্নপূর্ণা মন্দির রয়েছে। এটা স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস। 
দুটি মন্দিরইএকসময় জীর্ন হয়ে পড়েছিলো, রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে। ১৯৪৮ সালে তেলিনীপাড়া ও পাইকপাড়া অঞ্চলের ধনী ব্যক্তি রামপ্রসাদ সিংহ, শ্যামনগর নর্থ জুট মিলের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে, ভদ্রেশ্বরনাথ শিব মন্দির ও অন্নপূর্ণা মন্দিরের সংস্কার সাধন করেছিলেন। ১৯৫০ সালে তদানীন্তন রাজ্যপাল মাননীয় কৈলাস নাথ কাটজু মহাশয় মন্দির পরিদর্শনে এসে, মন্দিরের সংস্কার কার্যে সন্তুষ্ট হয়ে অনেক প্রশংসা করে গেছেন।

এবার বলি ভদ্রেশ্বর নাথ মন্দিরের কথা। মন্দিরের সামনে বেশ বড়সড় খোলা প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গন পেরিয়ে একতলা ছাদ বিশিষ্ট মন্দির। ছাদের উপর চার চালা টাইপের একটা ছোট্ট শিখর রয়েছে। মন্দিরটি খুব ঝকঝকে, তকতকে। হয়তো কয়েক মাস আগেই রং করা হয়েছে। জীর্ণ মন্দির দেখা অভ্যস্ত চোখ, সুন্দর রং করা চকচকে মন্দির দেখতে বেশ ভালই লাগছিল। মন্দিরের সামনে ছাদ এবং দুপাশের ছাদ জোড়া জোড়া থামের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তারপর অলিন্দ। তারপর এক খিলানের প্রবেশ পথ। খিলানে লতাপাতা ও ফুলের কাজ রয়েছে। তারপর গর্ভগৃহ। মাঝখানে গোলাকার বেদীর মাঝখানে শিব লিঙ্গ। সকাল থেকে ভক্তরা এসে পুজো দিয়ে যাচ্ছেন। শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালছেন। বেল পাতা ও আকন্দ ফুলের মালা দিচ্ছেন। সাহায্য করছেন মন্দিরে পুরোহিত শ্রী প্রশান্ত মুখার্জি। এনারা বংশ পরম্পরা ছয় পুরুষ ধরে এই মন্দিরের পূজারী। শ্রী প্রশান্ত মুখার্জী প্রায় ৩০ বছর ধরে এই মন্দিরের পূজার কাজে নিযুক্ত আছেন।

পুরোহিত মশাই বলছিলেন, বাবাকে প্রতিদিন দুপুর বেলা পরমান্ন ভোগ দেয়া হয়। এছাড়া প্রতিদিন বহু মানুষ শিবের মাথায় জল ঢালতে আসেন, এছাড়াও শ্রাবণ ও বৈশাখ মাস জুড়ে ভক্তরা দলে দলে বাবার মাথায় জল ঢালতে আসেন। শিবরাত্রির দিনও প্রচুর ভক্তরা আসেন জল ঢালতে। তার মধ্যে স্থানীয় মানুষরা তো আছেনই, তাছাড়াও বহু দূর দুরান্ত থেকে ভক্তরা, আবাল বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে, এই মন্দিরে আসেন বাবার মাথায় জল ঢালতে।



প্রতি বছর বৈশাখ মাসে এই মন্দিরের সামনের প্রাঙ্গণে মেলা বসে যায়। বহু লোকের সমাগম ঘটে। সবাই মেতে ওঠেন ভদ্রেশ্বর নাথের জয়গানে।
তারকেশ্বরে যেমন শোনা যায় যে, জয় বাবা তারকনাথের জয়। এখানে ভক্তদের মুখে উচ্চারিত হয়, জয় বাবা ভদ্রেশ্বর নাথের জয়। কারণ ভক্তদের কাছে এই মন্দিরের খ্যাতি ও মাহাত্ম্য অনেক বেশি।

যে সমস্ত ভক্ত বাবার নামের সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করতেন, তারা জয় বাবা ভদ্রেশ্বর নাথের জয় বলেই বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করতেন। হুতোম পেঁচার নকশাতেও ( ১৮৬৩/১৮৬৪ )সে ঘটনার উল্লেখ আছে। কথিত আছে বহু সাধু সন্ন্যাসী এই মন্দির এসে, বাবা ভদ্রেশ্বর নাথের দর্শন করে গেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তৈলঙ্গস্বামীর শিষ্য অভয়ানন্দ স্বামীজি। যিনি পরবর্তী কালে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গঙ্গার ধারে, যেটি এখন অভয়ানন্দ আশ্রম নামে পরিচিত। আরো শোনা যায়, চন্দননগরের প্রবর্তক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী মতিলাল রায়ের স্ত্রী, চন্দননগর থেকে পায়ে হেঁটে এই মন্দিরে এসে বাবার মাথায় জল ঢালতেন ও পুজো দিতেন। মন্দিরের সামনে একটি বড় সড় পুকুর আছে বাঁধানো।



পুকুরকে ডান হাতে রেখে বাঁদিকে ঘুরলেই পাওয়া যাবে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা অন্নপূর্ণা মন্দির। এই মন্দিরটিও মোটামুটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় বলেই মনে হল। সামনে লোহার গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে হলো। সামনে কিছুটা খোলা জায়গা।

তারপর সামান্য উঁচু বেদীর উপর একতলা মন্দির। মন্দিরের স্থাপত্যে কোন বৈশিষ্ট্য নেই। একটা সাদামাটা মন্দির যেমন হয়। মন্দিরের গর্ভগৃহে উঁচু বেদীর উপর রয়েছে শিব ও অন্নপূর্ণা মূর্তি। মা অন্নপূর্ণার মূর্তি মাঝখানে কাঠের টুলের উপর স্থাপিত। মা এখানে সিংহাসনে উপবিষ্টা। তার বাঁ হাতে ধরা অন্ন পাত্র। ডান হাতে রয়েছে অন্ন দেওয়ার হাতা। মায়ের ডান পাশে দণ্ডায়মান শিবের মূর্তি। জড়ো করা দুই হাতে ভিক্ষা পাত্র। শিব অন্নপূর্ণা মূর্তির দু'পাশে দুই সখীর মূর্তি রয়েছে। তাদের পায়ের কাছে দুপাশে, বসা দুটো সিংহের মূর্তি।



মন্দিরের সেবায়েত, ৭০ বছর বয়স্ক, শ্রী জীবনকৃষ্ণ পাঠক বলছিলেন, আগে এই মূর্তিটি মাটির ছিল, বেশ কয়েক বছর আগে, মূর্তিটি সিমেন্ট দিয়ে বানানো হয়। তারা প্রায় একশ বছর ধরে এই মন্দিরের পূজো অর্চনা করে আসছেন।

এই মন্দিরটি যেহেতু তেলেনী পাড়া, ভদ্রেশ্বরে জমিদার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার নির্মাণ করেছিলেন। তাই তারা প্রথম দিক থেকে বেশ কয়েক বছর এই মন্দিরের পূজা অর্চনার দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে বহু বছর হলো তারা আর এই মন্দিরে আসেন না। পাঠক পরিবারই এখন এই মন্দিরের দেখভাল করেন। পাঠকবাবু বলছিলেন, তার দাদু তিনকড়ি মুখোপাধ্যায় ছিলেন এক সময়কার এই মন্দিরের পুরোহিত। কিন্তু তার কোন পুত্র সন্তান না থাকায়, তার মেয়ের ঘরের বংশধররাই, বংশ পরম্পরায় এই মন্দির দেখাশোনা করে চলেছেন। ভদ্রেশ্বর স্টেশন থেকে এই মন্দির চত্বরে এসে, দুটি মন্দিরই দর্শন করে ফিরে চললাম নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।