Kolkata Series:কলকাতার আকাশে উড়ত মানুষ! - Pralipta



প্রলিপ্ত ডেস্ক: কলকাতার আকাশে ঘুড়ি আর ফানুস দেখতেই অভ্যস্ত বাঙালি। আজকাল সেগুলোও আবার মরশুমি হয়ে গিয়েছে। এক্কালে কলকাতার আকাশ বেলুন আর বাঙালির বেলুনবাজির সাক্ষী থেকেছে। বাচ্চা থেকে বুড়ো, এককালে কলকাতার সকলকেই বিনোদন জুগিয়েছে বেলুন। টিকিট কেটে চেয়ারে বসে বেলুনবাজদের বেলুনবাজি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছে মহানগরবাসী। আঠারো শতকের কলকাতা, আজ থেকে প্রায় ২৩৭ বছর আগের কথা। তারিখটা ১৭৮৫ সালের ২৯ জুলাই। (কেউ কেউ ৩০ জুলাই লিখেছেন) সেদিনই প্রথম অতিকায় বেলুন উড়তে দেখছিল তিলোত্তমা। তখন সবেমাত্র দু-বছর হয়েছে বেলুনের স্বাদ পেয়েছে গোটা দুনিয়া। কলকাতায় বেলুন নিয়ে আসলেন এক সাহেব, উইনটল। জুলাই মাসের রাত ভদ্রলোক বেলুন উড়িয়ে দিলেন, অন্ধকারে ৬ ফুট ব্যাসের বেলুন উড়ে বেড়ালো কলকাতায়। (তবে কোনও কোনও কলকাতা গবেষকের মতে, উইনটল সাহেব ১৭৮৫ সালের ৪ আগস্ট নিজেও বেলুনে চড়েছিলেন।)

এই ঘটনার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরের ঘটনা। এবার মানুষ উঠে পড়ল বেলুনে আর তা চাক্ষুষ করল মহানগর। দিনটা ছিল ১৮৩৬ সালের ১৬ মার্চ। গার্ডেনরিচে মুচিখোলার মাঠ থেকে বেলুনে চড়লেন আরও এক সাহেব। এবারের লালমুখোর নাম ডি. রবার্টসন, তিনি আবার কিলিয়ান এমবাপের দেশের লোক। যদিও ২০০৯ সালের মে মাসের পুরশ্রী বলছে দিনটি হবে ২১ মার্চ কিন্তু সাল বদলাচ্ছে না। যাই হোক আসল কথায় ফিরি, ১৮৩৬ সালে বেলুনে চড়লেন রবার্টসন সাহেব। সেই ভিড়ও হয়েছিল কলকাতায়। আর হবে নাই বা কেন, জব্বর প্রচার চলেছে। কাগজ থেকে শুরু করে হ্যান্ডবিল, সর্বত্র জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল সাহেব বেলুন বাজি করবেন। তিল ধারণের জায়গা ছিল না। সড়ক থেকে শুরু করে জলপথ, সব ভিড়ে ঠাসা। শ্রীভূমির ভিড়ের মতো কারবার। সাহেব ভেল্কি দেখালেন। সাহেব কিন্তু বেশ পটু ছিলেন বেলুনবাজিতে, কলকাতার আগে ইউরোপজুড়ে ১৬ বেলুনবাজি দেখিয়েছিলেন তিনি। বছর দুয়েক পর সাহেব একেবারেই উপরে চলে গেলেন। এবার আর তার বেলুনের দরকার পড়েনি। 

রবার্টসন সাহেবের পর ১৮৫০ নাগাদ আরেক সাহেব আসেন বেলুনবাজি দেখাতে, তার নাম কাইট সাহেব। নামেই কাইট, উড়তে যে তিনি সফল হবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। হয়েওছিলেন সফল। দিনটা ছিল ১৮৫০-এ ৫ নভেম্বর। কাইট সাহেবের পর আরেক বেলুনবাজ পার্সিভাল স্পেন্সার সাহেব কলকাতায় এসে হাজির হন, সালটা ১৮৮৯। কিন্তু স্পেন্সারের প্রথমদিনের বেলুনবাজি সফল হয়নি, সেকেন্ড ট্রাইতে কেল্লাফতে হল। তারিখটা ১৮৮৯ সালের ১৯ মার্চ। এই সব বেলুনের গ্যাস সরবরাহ করছে ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানি। এই কোম্পানির কল্যাণেই ১৮৫৭​ সালের ৬ই জুলাই কলকাতায় প্রথম গ্যাসের আলো জ্বলেছিল। যদিও তা নিয়ে শহরের লোক খুব একটা খুশি ছিলেন না। রটে গেল গ্যাসবাতি বসানো নাকি বাড়ির ট্যাক্স বৃদ্ধির ফন্দি! হিন্দু পেট্রিয়ট ও সর্বশুভকরী পত্রিকায় চলল প্রতিবাদ। 

আলো ছেড়ে বেলুনে ফিরি, সাহেবদের এমন বেলুনে চড়া দেখে বাঙালিদের যে বেলুনে চড়ার লোভ হয়নি, তা বলা বাহুল্য। স্পেন্সার সাহেবের কাছে গেলেন গর্ভমেন্ট নর্মাল স্কুলে ব্যায়াম টিচার রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সিমলার রামবাবু আর বাঙালির অ্যাডভেঞ্চার প্রায় সমার্থক। সেই জটায়ুর মতো উত্তর ভারতের সিমলা আবার ভেবে বসবেন, উত্তর কলকাতার সিমলার ছেলে ছিলেন রামবাবু। ভদ্রলোক একসময় নবগোপাল মিত্রের ন্যাশনল সার্কাসে ট্রাপিজের খেলা দেখাতেন। প্রিয়নাথ বোস অর্থাৎ প্রফেসর বোসের গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসেও তিনি ট্রাপিজের খেলা দেখিয়েছেন, পরে নিজে গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস তৈরি করেছিলেন। রামবাবু গিয়ে স্পেন্সারকে ধরলেন, স্পেন্সার ততদিনে আরও কয়েকবার বেলুনবাজি দেখিয়ে ফেলেছেন। রামবাবুকে পেয়ে বেজায় খুশ স্পেন্সার। অ্যাদ্দিন দেশীয় কাউকে পেলেন। দুজনে চেপে পড়লেন বেলুনে। ১৮৮৯ সালের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ নারকলেডাঙা থেকে দ্য ভাইসরয় বেলুন উড়ল। প্রথম বাঙালি হিসেবে বেলুনে চড়লেন। বাঙালির গর্বের দিনে আরও একটি দিন সংযোজিত হয়ে গেল। 

এবার সাহস বাড়ল। এবার আর কারও সঙ্গে নয়, একা নামলেন রাম। ঠিক হল ২৬ এপ্রিল উড়বেন। সেই মতো প্রচার হল। টিকিট বিক্রি হল দেদার। এক্কেবারে হাউস ফুল। কাতারে কাতারে লোক এসেছে। সব্বাই দেখবেন। কিন্তু এপ্রিল মাস, হঠাৎ করে আসা কালবৈশাখির কারণে সেদিনের মতো ভেস্তে গেল বেলুনবাজি। কিন্তু রামবাবু হেরে যাওয়ার পাত্র নন, নেমে পড়লেন ফের। ১৮৮৯ সালের ৪ মে, উঠে পড়লেন বেলুনে। উড়লেন, সফল হলেন। সে'দিনও লেখা হল ইতিহাস। প্রথম কোনও বাঙালি তথা ভারতীয়র একক আকাশ অভিযান করল, তাও নিজের যানে করে থুড়ি বেলুনে করে। স্পেন্সারের কাছ থেকে দ্য ভাইসরয় বেলুনটি কিনে নিয়ে ছিলেন রামবাবু, কলকাতার নামে নাম রেখেছিলেন দ্য সিটি অফ ক্যালকাটা। 

এতেই থেমে থাকেননি রামবাবু। চ্যাটার্জী বেলুনিং কোম্পানি নামে সংস্থা গড়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে বেলুনে ওড়েন রামবাবু। আর সে'সব বেলুনবাজি দুঃসাহসিক অভিযানের থেকে কোনও অংশে কম নয়। তখন রামবাবুর বেলুনের নাম হয়েছিল দ্য স্টার অফ ইন্ডিয়া, হবে নাই বা কেন, রামবাবুই তখন বেলুনবাজি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় স্টার। বেলুন থেকে রামবাবুর লাফও সেকালের কলকাতায় খুব বিখ্যাত হয়েছিল। কলকাতার কাহিনীতে রামবাবুর বেলুনবাজির রসালো বিবরণ পড়েছি। রামবাবু ছাড়াও উনিশ শতকের কলকাতা আরও দুই বেলুনবাজকে দেখেছিল, তারা হলেন যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, প্রবোধচন্দ্র লাহা। রামবাবুর মেয়েও নাকি বাপের মতোই বেলুনবাজ ছিলেন, বাবার সঙ্গে বেলুনবাজিও করতেন। 


তথ্যঋণ:
কলকাতা তিন শতক- কৃষ্ণ ধর
কলের শহর কলকাতা- সিদ্ধার্থ ঘোষ