Kolkata Series:বুববুলিয়া ও দস্তুরি-দালালরাজ এবং 'কাটমানি'র সেকেলে কলকাতা - Pralipta


সৌভিক রাজ: হরিহর শেঠ লিখে গিয়েছেন, ‘জাল জুয়াচুরি মিথ্যে কথা
এই তিন নিয়ে কলকাতা।’

সেকালের কলকাতা দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। মোটামুটি পলাশীর পর থেকে সাহেবের দল জাঁকিয়ে বসেছিল কলকাতায়। কোম্পানি আমলে মাত্র ছাড়িয়েছিল জালিয়াতির পরিমাণ। রীতিমতো পেশায় পরিণত হয়েছিল দালালি। তেমনই একটি পেশা ছিল বুববুলিয়া। যা অধুনা লুপ্ত। 

আদপে বুববুলিয়ারা হল কোর্টপাড়ার দালাল। এদের কাজ ছিল উকিলদের কেস পাইয়ে দেওয়া। দালাল মানেই বুঝতেই পারছেন, এরা আদালত চত্বরে তীর্থের কাকের মতো বসে থাকত এবং লোকজন এলেই তাদের পাকড়াও করত। উকিলদের মামলা পাইয়ে দিয়ে কমিশন নিত, আবার মামলাকারীর থেকেও একটা অঙ্কের টাকা এদের প্রাপ্য ছিল। এ'যুগে হলে কাট মানি হত আরকি! কেবল কোর্ট চত্বরে না, এদের হাত আরও লম্বা ছিল। বোধহয় আইনের থেকেও কিঞ্চিৎ দীর্ঘ। সেকালের কলকাতায় বড়লোকদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে এরা গন্ডগোল বাধিয়ে মামলা করানোর তালে থাকতেন। সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোতেন, তার আগে লুটে-পুটে নিতেন কমিশনের টাকা। 

এখানে বলে রাখি একসময় মামলা লড়ার জন্যে উকলের দরকার হত না, বাদী-বিবাদী পক্ষরা নিজেরাই নিজেদের কথা বলত। ১৪ জন অ্যাটর্নি এবং হাফডজন ব্যারিস্টার নিয়ে ১৭৯৩ সাল থেকে কলকাতায় ওকালতি পেশার সূত্রপাত হয়। এর পরেই বুববুলিয়ারা কোর্ট চত্বরে কারবার ফেঁদে বসে।

কলকাতায় দালালরাজ একদিন দু'দিনের কারবার নয়। কোম্পানির লোকেরা যখন ব্যবসা করত তখন থেকেই এই শ্রেণীর উদ্ভব। কেনা-বেচা দালালদের ছাড়া চলত না। দু তরফের মধ্যে ঢুকিয়ে টু-পাইস কামানোর মতো আরামদায়ক পেশা আর হয় নাকি? কলকাতার প্রথম কোম্পানি নিযুক্ত দালালের নাম ছিল দীপচাঁদ বেলা। দালালদের আবার রীতিমতো সম্বর্ধনা দিয়ে কাজে বহাল করা হত। উপহার হিসেবে দেওয়া হত, এক বোতল গোলাপ জল আর একখানা দারুণ সুগন্ধি পান। দীপচাঁদ বেলার বখরার রেট ছিল টাকায় আট পয়সা। দীপচাঁদের মৃত্যুর পর তার কারবারে জাঁকিয়ে বসেন জনার্দন শেঠ। এক সময় দালালদের স্যালারি সিস্টেমও চালু করেছিল ইংরেজরা।

পুরনো কলকাতায় 'কাটমানি'ও প্রচলিত ছিল, তবে তার ধরন ছিল একেবারেই আলাদা। আদপে কাটমানি একটা ব্যাধি, পুরনো হোক বা হালের কলকাতা! কলকাতা হোক বা ক্যালিফর্নিয়া 'কাটমানি' থাকবেই! কাটমানি-র নাম ছিল দস্তুরি। সেকালে জিনিস কেনাবেচা অনেকটাই ফেরিওয়ালাদের দৌলতে চলত। ফেরিওয়ালাদের বাড়ির ভিতরে এন্ট্রি দিতে টাকা নিতেন দারোয়ানরা, সেটাই দস্তুরি। যত টাকার জিনিস বিক্রি হত, সেই অনুযায়ী টাকায় চার পয়সা হারে টাকা দিতে হত ফেরিওয়ালাদের। এ ছিল মনিব কিছু কিনলে তার নিয়ম। মালকিন অর্থাৎ মেম সাহেব কিনলে তার বকরা পেতেন আয়া। চাকরদের হেড, সরকার মশাই গোছের লোকেরাও মাঝে মাঝে সরাসরি দস্তুরি নিতেন, তাদের রেট ছিল টাকায় দু-আনা। সেখানে আবার অন্য চাকর-বাকররা বকরা পেতেন না। কারণ সরকার মশাই রুষ্ট হলে চাকরি নট হবে! তবে ফেরিওয়ালারাও কম যেতেন না। দস্তুরির রেট চাপিয়েই জিনিসের দাম বলতেন।


তথ্যঋণ: 
কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত: বিনয় ঘোষ
কলকাতা দর্পণ: রাধারমণ মিত্র
পুরশ্রী, মে- ২০০৯
পুরশ্রী, ডিসেম্বর- ২০২১