Hooghly's Temples:হুগলী জেলার মন্দির - Pralipta

প্রলিপ্ত ডেস্ক: প্রাচীন বাংলায় মোটামুটি চার ধরণের বিভিন্ন শৈলীর মন্দির নির্মাণ-রীতি প্রচলিত ছিল। প্রতেকটি রীতিতেই ভূমি-নকশার যুক্তি পদ্ধতি ও বিন্যাস একই প্রকারের। পার্থক্য যা কিছু তা কেবল গর্ভগৃহের উপরিভাগ অর্থাৎ ছাদ বা চালের রূপ ও আকৃতি নিয়ে। এই চারটি রীতিকে নিম্নোক্ত ভাবে শ্রেণীবদ্ধ ও বর্ণনা করা যায়।

( ১ ) ভদ্র বা পীড় দেউল। এই রীতিতে গর্ভগৃহের চাল ক্রমহ্রস্বায়মান পিরামিডের আকার নিয়ে ধাপে ধাপে উপরের দিকে উঠে যায় । ধাপ বা স্তর এই ধরণের সংখ্যায় তিনটি বা পাঁচটি বা সাতটি। মন্দিরের সর্ব্বোচ্চ ও ক্ষুদ্রতম স্তরের উপর আমলক ও চূড়ার অধিষ্ঠান। এই ভদ্র বা পীড় দেউলই উড়িষ্যার রেখ বা শিখর মন্দির - সমূহের সম্মুখস্থ জগমোহন বা ভোগমণ্ডপ।

( ২ ) রেখ বা শিখর দেউল। এই রীতিতে গর্ভগৃহের চাল ঈষদ বক্ৰরেখায় শিখরের আকার নিয়ে সোজা উপরের দিকে উঠে যায়। শিখরের উপরিভাগে আমলক ও চূড়া। এই রেখ বা শিখরদেউল উত্তর ভারতের ও উড়িষ্যার নাগর পদ্ধতির মন্দিরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

( ৩ ) স্তূপযুক্ত পীড় বা ভদ্র দেউল। এই ধরণের দেউলের চালের ক্রমহ্রস্বায়মান পিড়ামিডাকৃতি স্তরের উপরে একটি স্তুপ। স্তুপটির উপরে চূড়া। 

( ৪ ) শিখরযুক্ত পীড় বা ভদ্র দেউল। এই ধরণের দেউলের চালের ক্রমহুস্বায়মান পিরামিডাকৃতি স্তরের উপর একটি শিখর। শিখরের উপরে চূড়া। 

 উপরিউক্ত চার ধরণের মন্দির পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলায় থাকলেও হুগলী জেলায় তা বিশেষভাবে অনুপস্থিত। ব্যতিক্রম হিসাবে খানাকুল থানার অন্তর্গত সেনহাটের একটি রেখ ধরণের বক্র কার্নিসযুক্ত মন্দির এবং পাণ্ডুয়া থানার অন্তর্গত বৈঁচিগ্রামের গোপাল দেউলের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে এখানকার বহু রত্নমন্দিরের কেন্দ্রীয় ও কৌণিক শিখরাবলী রেখ দেউলের আদর্শে নির্মিত হয়েছে। হুগলী জেলার অধিকাংশ মন্দিরই মধ্যযুগীয় গৌড়ীয় বা বাংলা রীতির অনুসারী। বঙ্গদেশের পল্লীগ্রামে আজও বাঁশ বা কাঠের খুঁটির উপর চতুষ্কোণ নকশার ভিত্তিতে মাটির দেওয়াল বা বাঁশের চাঁচারির বেড়ায় ঘেরা যে ধরণের ধনুকাকৃতি দোচালা, চৌচালা বা আটচালা ঘর দেখতে পাওয়া যায় সেই ধরণের বাংলা ঘর রচনাই ছিল এখানকার রীতি। দ্বিতল - ত্রিতল গৃহও এই রীতিতে নির্মিত হত। উপরের চাল বিন্যস্ত হত ক্রমহ্রস্বায়মান ধনুকাকৃতি রেখায়। মন্দির নির্মাণেও এই একই পদ্ধতি অনুসৃত হত। এই ধরণের মন্দিরকে তাই কুটির - দেউল আখ্যা দেওয়া যায়। এই শ্রেণীর মন্দির ইটের তৈরী হলেও চালাগুলির ঊর্দ্ধ মিলনরেখা এবং কার্নিসগুলি খরের ঘরের মতই বাঁকানো। এই মন্দিরগুলিকে নিম্নোক্ত পাঁচ শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে।

     বলাগড় সুখাড়িয়ার আনন্দভৈরবী মন্দির

(১) দোচালা বা একবাংলা মন্দির। এই মন্দিরগুলি কুঁড়েঘরের সর্বাপেক্ষা সরলীকৃত যে রূপ সেই দোচালার অনুকরণেই নির্মিত। এই জাতীয় মন্দিরের প্রবেশদ্বার কোন কোন ক্ষেত্রে একটি, কোন কোন ক্ষেত্রে তিনটি

(২) জোড় - বাংলা। দুইটি দোচালাকে পাশাপাশি স্থাপন করলেই জোড়বাংলা নামক বিশেষ ধরণটি পাওয়া যায় । বাস্তুবিদ্যার দিক থেকে দোচালা বা এক - বাংলা মন্দিরগুলি খুব দৃঢ় হয় না, কিন্তু দুটিকে জুড়ে দিলে ইমারতের জোড় বাড়ে এই কারণেই জোড় - বাংলার উদ্ভব। আরও মজবুত করার প্রয়োজনে দুটি চালার মাঝখানে কখনও সংযোগকারী চূড়া স্থাপন করা হয়। এই জোড়া দোচালার একটি বা তিনটি প্রবেশদ্বার থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে পিছনের চালাটির পাশের দিক থেকেও একটি দ্বারপথ থাকে ।

(৩) চারচালা। এই ধরণের মন্দির চারচালা কুঁড়েঘরের অনুকরণে নির্মিত। মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালার দ্বারা নির্মিত চারচালা কুটির গ্রাম বাংলার সর্বত্রই দেখা যায়। একই রীতিতে ইটের তৈরি গর্ভগৃহের চারদেওয়ালের উপরে চারটি ত্রিকোণ চালা প্রলম্বিত করাই এই ধরণের মন্দিরের নির্মাণবিধি।

     বালিতে অবস্থিত মঙ্গলচণ্ডী মন্দির

(৪) আটচালা। চারচালারই পরিবর্ধিত রূপ, আটচালা কুঁড়েঘরের অনুকরণে নির্মিত। প্রথম তলের চারটি চালার উপর দ্বিতীয় তলে আরও চারটি চালা সংস্থাপন করলে আটচালা হয়। ঊর্দ্ধাংশের ভারবহনের সুবিধার জন্য দ্বিতীয় তলের চালাগুলি আয়তনে প্রথম তলের চালাগুলির চেয়ে অনেক ছোট হয় । প্রথম তলের চারটি চালার উপর দ্বিতীয় তলের চারটি চালার মধ্যবর্তী অংশটি বর্গাকার চারটি দেওয়াল দিয়ে গঠিত হয়।

 (৫) রত্নমন্দির। চালামন্দিরের বির্তিত ও পল্লবিত রূপ। রত্ন বলতে চূড়া বা শিখরকে বোঝায়। চারচালা ধরণের মন্দিরের সর্বোচ্চ অংশের কেন্দ্রবিন্দুতে যেখানে চারটি চালার সংযোগ ঘটছে, সেই কেন্দ্রীয় অঞ্চলটিকে যদি একটি চূড়া বা শিখরের রূপ দেওয়া যায় তাহলে তা একরত্ন মন্দির হিসাবে পরিগণিত হয়। এই চূড়াটি চার ও ততোধিক কোণবিশিষ্ট হতে পারে। বেলগকার, অর্ধগোলাকার বা গম্বুজাকারও হতে পারে। কেন্দ্রস্থ চূড়া বা শিখরটি ছাড়া যদি চারকোণে আরও চারটি চূড়ার সন্নিবেশ ঘটানো যায় তাহলে তা পঞ্চরত্ন মন্দিরে পরিণত হয় । মন্দিরের তলের সংখ্যা বৃদ্ধি করে আরও বেশি চূড়া বা শিখর সংস্থাপন করা যায় । এইভাবে নবরত্ন, ত্রয়োদশরত্ন এবং আরও অধিক রত্নের মন্দির তৈরী করা যায়।

                  চন্দননগরের নন্দদুলাল মন্দির

হুগলী জেলায় দোচালা বা একবাংলা মন্দির বড়ই কম। চন্দননগরে এই ধরণের ছুটি মন্দিরের সন্ধান পাওয়া যায়। দুটি মন্দিরই অষ্টাদশ শতকে নির্মিত। বোসপাড়া খলিসানীতে অবস্থিত নন্দনন্দন মন্দিরটি একটিমাত্র প্রবেশ-দ্বার-বিশিষ্ট দোচালা মন্দিরের বিশেষ নিদর্শন। পক্ষান্তরে ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত চন্দননগরের কেন্দ্রস্থলে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পশ্চিমে লালবাগান যাবার পথে অবস্থিত নন্দদুলালের  মন্দিরটি পোড়ামাটির অলঙ্করণসহ তিনটি প্রবেশদ্বার বিশিষ্ট। জাঙ্গীপাড়া থানার অন্তর্গত আঁটপুরে কারুকার্যখচিত কাঠের চণ্ডীমণ্ডপটিও এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রায় তিনশো আগেকার এই চণ্ডীমণ্ডপটি প্রমাণ করে যে সুপ্রাচীনকাল থেকেই ইট - পাথরের মন্দিরের পাশাপাশি কাঠ - খর - বাঁশের তৈরী দোচালা কুঁড়েঘরকেও দেবালয় হিসাবে ব্যবহার করার রীতি প্রচলিত ছিল। এই প্রসঙ্গে বলাগড় থানার অন্তর্গত শ্রীপুরে অবস্থিত একটি দোচালা চণ্ডীমণ্ডপের কথাও উল্লেখ করা যায়।

     চন্দননগরে বোড়াইচণ্ডীতলার বোড়াইচণ্ডীর মন্দির

দোচালার পরিবর্তে ডবল-দোচালা বা জোড় বাংলা মন্দিরের সংখ্যা হুগলী জেলায় তুলনামূলক ভাবে বেশী। জোড়বাংলা মন্দিরের ক্ষেত্রে স্থাপত্যগত বৈশিষ্ট্য দোচালা মন্দিরের তুলনায় অধিকতরভাবে লক্ষণীয়। জোড়বাংলা মন্দিরের একটি কক্ষ অলিন্দ হিসাবে সচরাচর ব্যবহৃত হয়, এবং প্রায় সকলক্ষেত্রেই এই অলিন্দের তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশ পথ থাকে । কোন কোন ক্ষেত্রে পশ্চাদের কক্ষটিরও একটি প্রবেশদ্বার থাকে। হুগলী জেলায় সাদামাটা জোড়বাংলা মন্দিরের পরিচয় পাওয়া যায় ধনিয়াখালি থানার অন্তর্গত দশঘড়ায় এবং পোলবা থানার অন্তর্গত মহানাদে। এই মন্দিরদ্বয় প্রাথমিক ধরণের জোড়বাংলা মন্দিরের নিদর্শন । দাদপুর থানার অন্তর্গত সেনেটের বিশালাক্ষী মন্দির এবং বলাগড় থানার অন্তর্গত গুপ্তিপাড়ার চৈতন্যদেবের মন্দির যথার্থ মানের জোড়বাংলা মন্দির হিসাবে বিবেচিত। চন্দননগরে বোড়াইচণ্ডীতলার বোড়াইচণ্ডীর মন্দিরটিও জোড়বাংলা মন্দিরের বিশিষ্ট নিদর্শন। আরামবাগ মহকুমার গোঘাট থানার অন্তর্গত বালি দেওয়ান গঞ্জে একটি বিস্ময়কর জোড়বাংলা মন্দির আছে। এখানে মূল মন্দিরের শিখর হিসাবে জোড়বাংলার ছাদে আস্ত একটি নবরত্ন মন্দির বসিয়ে দেওয়া হয়েছে -

বিশুদ্ধ চারচালা মন্দিরের নিদর্শন পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্র পাওয়া গেলেও হুগলী জেলায় তা অতি দুর্লভ। আরামবাগ মহকুমার পুরশুড়া থানার অন্তর্গত বাখরপুরে একটি পরিত্যক্ত চারচালা মন্দির বর্তমান। কোন কোন ক্ষেত্রে যেমন আরামবাগ মহকুমার পারুল বা রাজহাটিতে আটচালা মন্দিরের নাট মণ্ডপ হিসাবে চারচালা বর্তমান । আরামবাগেরই গোঘাট থানার অন্তর্গত সেলানপুর এবং শ্রমবাজারে চারচালা মন্দিরকে রথ বা রত্ন মন্দিরের আদল দেওয়া হয়েছে। ইনাথনগরের বিশালাক্ষী মন্দিরটিও চারচালা ধরণের।

                           হরিপালের রাধাগোবিন্দ মন্দির 

আটচালা মন্দিরের সংখ্যা হুগলী সর্বাধিক। তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার বিশিষ্ট অভিবৃহৎ আটচালা মন্দিরসমূহের মধ্যে মাহেশের রাধাবল্লভ, শ্রীরামপুরের রাধাবল্লভ (হেনয়ী মার্টিনের প্যাগোডা) এবং গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র ও কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অষ্টাদশ শতক ও তার পূর্ববর্তী আমলের পোড়ামাটির অলঙ্করণযুক্ত যে সকল আটচালা মন্দির হুগলী জেলায় দেখা যায় সেগুলির মধ্যে জাঙ্গীপাড়া থানার হরিপালে অবস্থিত রাধাগোবিন্দ , কালী ও সীতারাম মন্দির , গোবিন্দপুরের শ্রীধর মন্দির , বাহির গড়ের দামোদর মন্দির , রাজবলহাটের দুইটি দামোদর মন্দির , রাধাকান্ত ও সীতারামের মন্দির , দ্বারহাট্টার রাজরাজেশ্বর মন্দির, কোটালপুরের রাজরাজেশ্বর মন্দির ও আঁটপুরের কাশীনাথ শিব মন্দির, পাণ্ডুয়া থানার মণ্ডলয় ও বেড়াগড়ির গোপাল মন্দির, ধনিয়াখালি থানার কাঁকরাকুলির লক্ষ্মী জনার্দন , কালিকাপুরের রাজরাজেশ্বর গুড়াপের নন্দদুলাল মন্দির ও একটি শিব মন্দির, আরামবাগ থানার হমিয় বাটির দামোদর মন্দির, ভালিয়ার রঘুনাথ মন্দির, খেদারিলের দামোদর মন্দির, পারুলের রঘুনাথ মন্দির, শ্রীরামপুরের বিষ্ণুমন্দির, এলোমার বিষ্ণু ও বিশালাক্ষী মন্দির ও রামনগরের লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, পুরশুড়া থানার দেউলপাড়ার জয়চণ্ডী মন্দির , বাঘরপুরের পরিত্যক্ত মন্দির , পুরশুড়ার রঘুনাথ মন্দির ও জঙ্গলপাড়ার মঙ্গলচণ্ডী মন্দিয় , দাদপুর থানার কৃষ্ণপুরের শিবমন্দির তারকেশ্বর থানার জয়নগরের শিবমন্দির , গোঘাট থানার মালঞ্চের শিবমন্দির প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই সকল মন্দিরের প্রবেশদ্বারের খিলান ও কার্নিসের মধ্যবর্তী স্থানে, কোন কোন ক্ষেত্রে স্তম্ভগাত্রে পত্রপুষ্পের অলঙ্করণ ছাড়াও পোড়ামাটির ফলকে উৎকীর্ণ বিভিন্ন মূর্তি , পৌরাণিক কাহিনীর যুদ্ধদৃশ্য দেখা যায় ।

              সাহাগঞ্জের শিবমন্দির

অষ্টাদশ শতক ও তৎপূর্বে নির্মিত মৃৎফলক কারুকার্যমণ্ডিত একটি প্রবেশদ্বার বিশিষ্ট ছোট আটচালা মন্দির সমূহের মধ্যে হুগলী-চুঁচুড়া থানার অন্তর্গত সাহাগঞ্জের শিবমন্দির, উত্তর পাড়ার দুইটি শিবমন্দির, এবং উত্তরপাড়া থানার অন্তর্গত একটি শিবমন্দির , পাণ্ডুয়া থানার বৈঁচিগ্রামের পশ্চিমপাড়ায় অবস্থিত রঘুনাথ মন্দির, জাঙ্গীপাড়া খানার হরিরামপুরে অবস্থিত দুইটি শিবমন্দির, মহেশপুরের পরিত্যক্ত মন্দির, পুরশুড়া থানার অন্তর্গত ভাঙ্গামোড়ার শীতলামন্দির, মগরা থানার অন্তৰ্গত নিত্যানন্দপুরের জোড়া শিবমন্দির, আরামবাগ থানার গৌরহাটির গঙ্গাধর শিবমন্দির প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত পোড়ামাটির কারুকার্যখচিত বৃহৎ আটচালা মন্দির সমূহের মধ্যে গোঘাট থানার বালির দামোদর মন্দির, সেলানপুরের সমান কার্নিসযুক্ত দামোদর মন্দির ও কৃষ্ণগঞ্জের দামোদর মন্দির, আরামবাগ থানার ডিহিবায়ারার ধর্ম মন্দির, পারুলের বিশালাক্ষী মন্দির ও রাজহাটির বিশালাক্ষী মন্দিরের কথা উল্লেখযোগ্য। আরামবাগ থানার মলয়পুর ও গোঘাট থানার বালিতে অবস্থিত দুইটি আটচালা মন্দিরের রথধর্মী বৈশিষ্ট লক্ষনীয়। আরামবাগ থানার সেনহাট ও পাণ্ডুয়া থানার ইলছোবায় বারোচাল মন্দির আছে। আটচালা মন্দিরের উপর চারচালা শিখর বসিয়ে দিলেই তা বারোচালায় পরিণত হয়।

কৃষ্ণনগরের রাধাবল্লভ মন্দির

রত্ন বা রথ ধরণের মন্দির শিখর ও তলের সংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত। একরত্ন বা এক শিখর বিশিষ্ট মন্দির সমূহের মধ্যে গোঘাট থানার উদয়রাজপুরের তিনটি মন্দির উল্লেখযোগ্য। এই মন্দিরগুলির চূড়া রেখধর্মী। খানাকুল থানার অন্তৰ্গত কৃষ্ণনগরের রাধাবল্লভ মন্দিরটিও একরত্ন, শিখরটি চারচালা। বাঁশবেড়িয়ার বাসুদেব ও গুপ্তিপাড়ার রামচন্দ্রের একরত্ন মন্দিরদ্বয় অষ্টকোণযুক্ত শিখর বিশিষ্ট। পক্ষান্তরে আরামবাগ থানার কানপুরের কণকেশ্বর মন্দিরের শিখর গম্বুজাকৃতি এবং তার চারদিকে খিলান নির্মিত বারান্দা বর্তমান ।

      বাঁশবেড়িয়ার বাসুদেব মন্দির

কেন্দ্রস্থ বৃহত্তর শিখর বা চূড়া বিশিষ্ট একতলা মন্দিরের সমতল বা অর্ধগোলাকৃতি ছাদের চারকোণে যদি চারটি ক্ষুদ্রতর শিখর বসানো হয় তাহলে তা পঞ্চরত্ব বা পঞ্চরথ মন্দিররূপে পরিগণিত হয়। এই জাতীয় মন্দিরের সংখ্যা হুগলী জেলায় অনেক। গোঘাট থানার অন্তর্গত মাকড়া নির্মিত শ্যামসুন্দরের পঞ্চরত্ন মন্দিরটি রেখ ধরণের শিরাযুক্ত শিখর ও তিনটি খিলান নির্মিত প্রবেশদ্বার বিশিষ্ট। অনুরূপ রেখ ধরণের শিরাযুক্ত শিখর ও তিনটি প্রবেশদ্বার বিশিষ্ট পঞ্চরত্ন মন্দির সমুহের মধ্যে ধনিয়াখালি থানার দশঘড়ার গোপীনাথ মন্দির , পুরশুড়া থানার অন্তর্গত সোয়ালুকের পুরাতন গোপীনাথ মন্দির চণ্ডীতলা থানার বৈজহাটি, গোঘাট থানার কয়াপাট ও মামুদপুর এবং দাদপুর থানার কৃষ্ণনগরের কয়েকটি  মন্দিরের সম্মুখভাগে পোড়ামাটির কারুকার্য বর্তমান। আরামবাগ থানার বালির অন্তর্গত রাউত পাড়ার দামোদর মন্দিরটিও একই শ্রেণীভুক্ত। এই মন্দিরের রেখ ধরণের শিখরগুলি বক্ৰতল বিশিষ্ট। রেখ ধরণের শিখরাবলী ও একটি প্রবেশদ্বার বিশিষ্ট পঞ্চরত্ন মন্দির বলাগড় থানার অন্তর্গত শ্রীপুর , পাণ্ডুয়া থানার অন্তর্গত বড়াগড়ি ও ইলশেবা , ধনিয়াখালি থানার অন্তর্গত গুড়াপ , পুরশুড়া থানার অন্তর্গত বড়াগড়ি ও ইলতোবা, ধনিয়াখালি থানার অন্তর্গত গুড়াপ, পুরশুড়া থানার অন্তর্গত ভাঙামোড়া ও ডিহিবাতপুর হরিপাল থানার অন্তর্গত হরিপাল ও দ্বারহাট্টা এবং উত্তরপাড়ায় বিদ্যমান । এই সকল মন্দিরের সম্মুখভাগে পোড়ামাটির অলঙ্করণ দেখা যায় । খানাকুল থানার অন্তর্গত সেনহাট ও আরামবাগ থানার অন্তর্গত লক্ষ্মীপুরে বাঁকানো কার্নিসযুক্ত অর্ধগোলাকৃতি শিখর বিশিষ্ট দুইটি পঞ্চরত্ন মন্দির বর্ত্তমান।

       দশঘরা গোপীনাথ মন্দির

নবরত্ন মন্দির পঞ্চরত্বেই বর্ধিত রূপ। এই ধরণের মন্দির দ্বিতল। প্রথম তলে চারটি , দ্বিতীয় তলে চারটি এবং সর্বোপরি কেন্দ্রস্থ শিখর নিয়ে নবরত্ন গঠিত হয়। অষ্টাদশ শতকে নির্মিত পোড়ামাটির অলঙ্করণযুক্ত একটি বিশাল নবরত্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পুরশুড়া থানার অন্তর্গত সুন্দুরুষে দেখা যায়। খানাকুল ও দিগসুই - এ দুটি অষ্টাদশ শতকের প্রাচীন নবরত্ন মন্দির বর্তমান। গোঘাট থানার অন্তর্গত বদনগঞ্জের দামোদর মন্দির এবং কয়পাটের শ্রীধর মন্দির ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে নির্মিত। তিনটি প্রবেশদ্বার বিশিষ্ট এই মন্দিরগুলির শিখরাবলী রেখ ধরণের খাঁজকাটা। খানাকুল থানার অন্তর্গত কৃষ্ণনগরের গোপীনাথ মন্দিরের রেখধর্মী শিখরগুলির শিরাসমুহ রীতিমত বক্রতাযুক্ত। চণ্ডীতলা থানার অন্তর্গত বাকমার রঘুনাথ মন্দিরের ও পুরশুড়ার বৈকুণ্ঠপুরের শ্রীধর মন্দিরের খাঁজকাটা চূড়াগুলি আকারে লম্বা হলেও সরু মাপের। চন্দননগরের বুড়োশিবের মন্দিরও এই পর্যায়ভুক্ত। এই মন্দিরটি হুগলী-চুঁচুড়া থানার অন্তর্গত খামারপাড়ার শিব মন্দিরের মতই একদ্বার বিশিষ্ট ও পোড়ামাটির অলঙ্করণ সমৃদ্ধ। গোঘাটের হাজিপুরের লক্ষ্মীজনার্দ্দন মন্দিরটি একটু বিচিত্র ধরণের। এই মন্দিরটি দ্বিতল নয়, অথচ এখানে নয়টি শিখর বর্তমান। বলাগড় থানার অন্তর্গত সোমড়ার নিস্তারিনী ও হরসুন্দরী কালীমন্দির সমতল কার্নিসের উপর নবরত্নের বিশিষ্ট নিদর্শন। 

     সোমড়ার নিস্তারিনী মন্দির

নবরত্ন মন্দিরের তলের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং অতিরিক্ত শিখর সংযোজন করে ত্রয়োদশ ও ততোধিক রত্ন বিশিষ্ট মন্দির নির্মাণ করা যায়। ত্রয়োদশ রত্ন মন্দির সমূহের মধ্যে বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির এবং গোঘাট থানার বালিতে অবস্থিত মঙ্গলচণ্ডী মন্দিরের উল্লেখ করা যায়। বলাগড় থানার অন্তর্গত সুখাড়িয়ার আনন্দভৈরবী মন্দিরটি পঞ্চবিংশতি রত্ন মন্দিরের একটি বিশিষ্ট নিদর্শন। এই মন্দিরটির প্রথম তলের চারকোণে তিনটি হিসাবে বারোটি, দ্বিতীয় তলের চারকোণে দুইটি হিসাবে আটটি , তৃতীয় তলের চারকোণে একটি হিসাবে চারটি ও কেন্দ্রস্থ শিখর সব মিলিয়ে পঁচিশটি চূড়া বর্তমান। 

     বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির

            গোঘাটের হাজিপুরের লক্ষ্মীজনার্দ্দন মন্দির

উপরে উল্লিখিত প্রধান ধরণের মন্দিরসমূহ ছাড়াও আরও কয়েকটি বিশিষ্ট ধরণের মন্দির মহানাদের লালজীউর মন্দির চতুষ্কোণ আছে। গর্ভগৃহের উপর গোল মঠাকৃতি সুউচ্চ শিখর বিশিষ্ট। ধনিয়াখালি থানার কাঁকড়াকুলিতে আটকোণা ভিত্তির উপর নির্মিত একটি রেখ ধরণের মন্দির আছে। ত্রিবেণীর বেণীমাধব মন্দিরটিও আটকোণা ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, ধরণটি চারচালা। পুরশুড়া থানার অন্তর্গত রসুলপুরেও একটি অষ্ট কোণ বিশিষ্ট মন্দির আছে, ধরণটি আটচালা। এছাড়া হুগলী জেলায় সমতল ছাদ বিশিষ্ট বহু মন্দির দেখা যায়। এগুলিকে চাঁদনী ধরণের মন্দির আখ্যা দেওয়া হয়। গোঘাট থানার সেলানপুরের দামোদর মন্দির ও পাণ্ডু গ্রামের শ্রীধর মন্দির এবং পুরশুড়া থানার হরিণাখালির ধর্ম মন্দির এই ধরণের মন্দিরের বিশেষ নিদর্শন। গোঘাটের কামারপুকুরের বিষ্ণু মন্দির এবং বদনগঞ্জের শ্রীধর লালজীউ মন্দির দ্বিতল এবং সমতল ছাদ বিশিষ্ট।

গবেষণা এবং স্বত্বাধিকার: প্রলিপ্ত টিম