Kolkata Road History: কলকাতার পথঘাটের ইতিহাস, সেকাল থেকে একাল - Pralipta

কোয়েল সাহা :

"এ পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?"

সত্যিই এই পথের কোন শেষ নেই। এই মহানগরীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কত পথ ও তাদের অজানা ইতিহাস। এই রাজপথ যে কত বিপ্লবীদের আত্মবলীদানের রক্তাক্ত স্মৃতি বহন করছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই আজও মনে হয় যদি জানতাম এই তিলোত্তমার রাজপথের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত তাহলে হয়তো এ শহর আমায় আরো আপন করে নিত। 


ভারতবর্ষে আধুনিক অর্থে সুদূরপ্রসারী রাজপথের (হাইওয়ে) উদ্বোধন করেন শেরশাহ। পেশোয়ার থেকে শুরু করে পাঞ্জাব, দিল্লি, বর্তমান উত্তরপ্রদেশও বিহারের মধ্য দিয়ে শেরশাহের তৈরি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড এ দিকে এসে শেষ হয়েছে ফলতার বন্দরে। গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোড নাম নিয়েই প্রচলিত ছিল ইংরেজ আমলের প্রথম দিক পর্যন্ত। এ দিক থেকে কলকাতা যাওয়ার এটাই ছিল প্রচলিত রাস্তা।


১৬০৯ সালের ২৮শে আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মাধ্যক্ষ জব চার্নক তার কাছ থেকে সুতানুটি, গোবিন্দপুর, কলিকাতা নামে এই তিনটি গ্রাম নিয়ে কলকাতার গোড়াপত্তন করেন। ১৩০০ টাকায় সাবর্ন রায়চৌধুরীরা কলকাতার স্বত্ব দেন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে। সে সময় কলকাতার রাস্তাঘাট ছিল অপরিষ্কার ও অনুন্নত। পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে কলকাতার রাস্তাঘাটের উন্নয়নের কথা ভাবেন বিট্রিশরা। উনিশ শতকের সাতের দশকের পর এই রাস্তা নির্মাণ করার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে। চলুন তাহলে একবার উঁকি দিয়ে আসি তিলোত্তমার রাজপথের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে।


চিৎপুর রোড

চিৎপুর রোড কলকাতার প্রাচীনতম পথ। বাংলায় তখন বৈষ্ণবধর্ম্মের বৈরাগ্যপূর্ণ আধিপত্য বিনষ্ট হয়ে গেছে। তন্ত্রমতে বাঙালী তখন শক্তিপূজায় আত্মনিয়োগ করেছে। যেখানে সেখানে শক্তিমূর্তি ও মাতৃ মন্দির প্রতিষ্ঠা করছে। ঠিক এই শুভ সন্ধিক্ষণে চিৎপুর এলাকায় চিত্রেশ্বরীর মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে চিত্রেশ্বরীর মন্দির নির্মাণের সঠিক সময় ও কে ঐ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকর্তা কিছুই জানা যায়নি। কিন্তু কালীঘাটের কালীমূর্তির মতই তখন চিক্রেশ্বরীর আকর্ষণ। চিৎপুরের দেখতে পাওয়া যেতো অসংখ্য যাত্রী, কাপালিক এবং শাক্ত সন্ন্যাসীদের। দেবীর নাম থেকেই চিৎপুরের নামকরণ হয়ে যায়। চিত্রেশ্বরী থেকে চিৎপুর। অনেকে বলেন, চিত্রেশ্বরীর অন্য নাম চিত্তেশ্বরী। জনশ্রুতি আছে চিতে নামক এক ডাকাত সর্দার দ্বারা এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত। মোঘল বাদশাহের আমল থেকে এই পথটির অস্তিত্ব। তখন চিৎপুর রোডের দুপাশে ছিল জঙ্গল। চিৎপুর রোডের বিস্তৃতি অনেকটাই প্রশস্ত। চিৎপুর রোডের অন্যতম আকর্ষণ মদনমোহন ও সিদ্ধেশ্বরীর মন্দির। চিৎপুরে প্রধানতম মসজিদ নাখোদা মসজিদ।

হ্যারিসন রোড 

হ্যারিসন রোড শেষ পর্যায়ের এক ইংরাজের নামান্বিত রাজপথ - যে পথ যোগাযোগ রক্ষা ক'রে আছে কলকাতার উপকণ্ঠের দু'টি স্টেশনের সঙ্গে। হাওড়াকে পিয়ালার সঙ্গে যুক্ত করেছে হ্যারিসন রোড। হ্যারিসন ছিলেন সে যুগের কড়া আই. সি. এস সেই সময়ে পুলিশ কমিশনার এবং কলকাতা কর্পোরেশনের চেয়ার ম্যান একই ব্যক্তি হওয়ার রীতি চলিত ছিল। হ্যারিসন এই দুই সম্মানজনক পদও অধিকার করেছিলেন। এই পদ দুইটি পাওয়ার পরেই হ্যারিসনকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কলকাতায় মাঠ - ময়দানে ও পার্কে সভঙ্গ করবার জন্য অনুমতি নেওয়ার রীতি প্রথম প্রবর্তন করেন মিঃ হ্যারিসন। উক্ত হ্যারিসন সাহেবের নামানুসারে হ্যারিসন রোডের নাম হয়, যদিও তৎপূর্ব্বে ঐ পথের নাম হয়েছিল সেন্ট্রাল রোড। কলকাতা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হওয়ার সুবিধা পেয়ে হ্যারিসন পূর্ব নাম বাতিল ক'রে নিজ নামে পথটি পরিচিত করেন। পথটির বিষয়ে বিশেষ জ্ঞাতব্য এই যে, ইং ১৮৯১ সালে হ্যারিসন রোড প্রথম ইলেকটিক বা বৈদ্যুতিক আলোয় সুশোভিত হয়। হাওড়া থেকে শিয়ালদা স্টেশনের যোগাযোগ হ্যারিসন রোডকে লক্ষ্মীর আবাসস্থান বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। কেন না হ্যারিসন রোডে ব্যবসায়ীদের প্রচুর সংখ্যক বিপণি আছে। কাপড়, মশলা, স্টিলের সিন্দুক, কলেজ। কাগজ এবং মণোহারীর দোকানে ছেয়ে আছে হ্যারিসন রোড এবং আর হ্যারিসন রোডের দোকানগুলির অধিকাংশ বাঙালীদের পুরানো দোকান। মেসার্স জি. সি. লাহা, নীলমণি দত্ত এণ্ড কোং, আর. ডি. দত্ত মহেন্দ্রলাল দত্ত, নবীন ফার্ম্মেসী, ভোলানাথ পেপার হাউস, গ্লোব নার্সারি, বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ কোং লিঃ, পাহাড়পুর ঔষধালয়, জে. এম. রায় প্রভৃতি বিখ্যাত দোকানগুলি হ্যারিসন রোডের অন্যতম আকর্ষণ। হিন্দু সৎকার সমিতি, কিং কোম্পানীর ঔষধের দোকান, ওয়াই. এম. সি. এ. , শিখদেরও গুরুদ্বার হ্যারিসন রোডে অবস্থিত। দু’টি শিক্ষাকেন্দ্র এই অঞ্চলের মূল্য বর্ধিত করেছে — রিপণ বা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ও বঙ্গবাসী কলেজ। সে - যুগের এ্যালফ্রেড থিয়েটারের স্মৃতি এখনও এই পথে আছে তবে অন্য নামে। এ্যালফ্রেড থিয়েটারে নাটাচার্য্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী প্রথম ‘বসন্তোৎসব’ অভিনয় করেন।

ধর্মতলা রোড


কলকাতার অন্যতম পরিচিত আর জমজমাট অঞ্চল এই ধর্মতলা। জায়গাটা কিন্তু খুবই পুরোনো। লং সাহেব মনে করতেন, এখন যেখানে ধর্মতলায় এখন যেখানে টিপু সুলতান মসজিদ, আগে তার পাশে একটা ঘোড়ার আস্তাবল ছিল। সেই আস্তাবলের জমিতে আরেকটা মসজিদ বানানো হয়েছিল, যেটা আর নেই। সেই মসজিদের প্রথম কারবালার সমাবেশ হত মহানগরে। এরকম ধর্মীয় পরিবেশ ছিল বলেই জায়গাটার নাম ধর্মতলা হয়েছে। সেই মসজিদ এখন আর নেই। অন্যদিকে ডাঃ হর্নেল সাহেব একটা অন্য ব্যাখা দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, জানবাজার এলাকায় বৌদ্ধদের একটা বসতি ছিল। তারা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতেন, সেখান থেকেই ধর্মতলা নামটা এসেছে। বর্তমান কালের গবেষক শ্রীবিনয় ঘোষ বলেছেন,ধর্মতলা নামের সঙ্গে গ্রামবাংলার উপাস্য দেবতা ধর্মঠাকুরের একটা যোগ আছে। তিনি রাঢ় অঞ্চলের দেবতা। একটা সিঁদুর মাখানো এবড়োখেবড়ো পাথরের টুকরোতে পুজো হয় তাঁর। বাউড়ি, বাগদি, হাড়ি, ডোম জাতির মানুষেরা এই দেবতার উপাসক। একদল নিন্মবর্গের মানুষ জানবাজার অঞ্চলে বসবাস করতেন একসময়ে। তাঁরা ধর্মঠাকুরের পুজো করতেন, সেই দেবতার একটা মন্দিরও বানিয়েছিলেন সেখানে। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দেখেছিলেন সেই মন্দির। বিনয় ঘোষ জানিয়েছেন, এখানে মহাসমারোহে ধর্মঠাকুরের পুজো হত, গাজন হত, মেলা বসত – সব মিলিয়ে একটা জমজমাট উৎসব এখানে চালু ছিল। ধর্মতলাতে প্রথম ভারতীয় হাসপাতালটি চিৎপুর থেকে স্থানান্তরিত করেন তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার।ধর্মতলার কাছাকাছি ধর্মতলা অ্যাকাডেমি নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়‌।ধৰ্ম্মতলা স্ট্রীটে আছে তিনটি গির্জা । এ অঞ্চলের ‘ দি রোমান ক্যাথলিক গির্জাটি ইং ১৮৩২ অব্দে মিসেস্ পাশকোয়া ব্যারেটো ডিলুঙ্গ কর্তৃক স্থাপিত হয় । ' দি ইউনিয়ন চ্যাপেল ' স্থাপিত হয় ইং ১৮২১ অব্দে । শ্রীনিকেতন কুটীর শিল্প , অক্ষর কুমার সাহা , জি . সি . লাহা , ইণ্ডিয়া ওয়াটার প্রুফিং এণ্ড ডাইং , ওয়াছেল মোল্লা , কমলালয় ষ্টোর্স , সুবেদালি ব্রাদার্স , নন্দী ব্রাদার্স , এইচ . ডি . নন্দী প্রভৃতি বিপণি ধর্ম্মতলার বিশেষ আকর্ষণ । ব্যাঙ্ক , দন্ত - চিকিৎসক , চশমা বিক্রেতা , ইলেকট্রিক , ফটোগ্রাফী , সাইকেল এবং মোটরের কারখানা ছাড়া এখন ছায়াচিত্রের পরিবেশকদের প্রচুর কাৰ্যালয় ধর্মতলায় হয়েছে । ধর্মতলার চাঁদনী চক বিখ্যাত । নিউ সিনেমা এবং জ্যোতি সিনেমা এই পথে জনাগমের অন্যতম কারণ । পূর্ব্বে এই পথে দু’টি বিখ্যাত রঙ্গালয় ছিল , যথা— করিন্থিয়ান থিয়েটার ও পার্শী থিয়েটার । ১৩৮ নং ধর্মতলা স্ট্রীটের ‘ দি ডিলুজা হোম ' - এর নাম হয়তো অনেকেই জানেন না । ইং ১৮৭৪ অঙ্গে এটি স্থাপিত হয় । প্রথমে দশজন স্ত্রীলোক এবং কুড়িজন শিশুকে স্থান দেওয়ার ব্যবস্থা হয় এখানে । কেবলমাত্র বিত্তহীন ইউরোপীয়রা স্থানলাভ করতো তখন ।

গ্রে স্ট্রিট


এটি কলকাতার প্রথম পাকা রাস্তা। উত্তর কলকাতার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডের উপর এই রাস্তা অন্তত গুরুত্বপূর্ণ । এই রাস্তার নামকরণ হয় ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী চার্লস আর্ল গ্রে’র নামানুসারে । এই রাস্তার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটুকরো ছবি । আলিপুর বোমা মামলায় ১৯০৮ সালের ৮ মে ঋষি অরবিন্দ যে বাড়ির থেকে গ্রেফতার হন , সেই বাড়িটি ছিল এই রাস্তাতেই । তাই এই রাস্তার নাম পরে বদলে রাখা হয় ঋষি অরবিন্দ সরণি । 

হাতিবাগান


এই স্থানের নামকরণের সঙ্গে আবার জড়িয়ে আছে নবাব সিরাজদৌল্লার ফোর্ট উইলিয়াম আক্রমণের কাহিনি । ১৭৫৬ সালে যখন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব ইংরেজদের মোক্ষম শাস্তি দেওয়ার জন্য ৫০ হাজার।সৈন্য নিয়ে কলকাতা আক্রমণ করেন তখন নবাবের হাতিদের রাখা হয়েছিল এই অঞ্চলের কোনও এক বাগানে । সেই ঘটনা থেকে এই অঞ্চলের নাম হয় হাতিবাগান ।

পার্ক স্ট্রিট


আরেকটি অন্যতম ব্যস্ত রাজপথ হল পার্ক স্ট্রিট।১৮৫০ সালে প্রকাশিত ‘বেঙ্গল অ্যান্ড আগ্রা ডিকশনারি’ থেকে জানা যায়, রাস্তার তৎকালীন নাম ছিল ‘Ghorustan ka Rastah’ (গোরস্থান কা রাস্তা), ব্যতিক্রমে ‘Badamtallee’ (বাদামতলি)। রাস্তাটির বিবরণে বলা হয় ফোর্ট উইলিয়ামের ‘চৌরঙ্গী গেট’-এর বিপরীতে রাস্তার একটি মুখ, এবং সেটি সার্কুলার রোডের পূর্ব দিক ধরে চলে।৫ নং পার্ক স্ট্রীটে রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটি । ইং ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দে ১৫ ই জানুয়ারী এই সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় । প্রতিষ্ঠাকর্তা ছিলেন স্যার উইলিয়ম জোন্স এবং ওয়ারেন হেষ্টিংস প্রভৃতি ।প্রথম দিকে ৫৭ নং পার্ক স্ট্রীটে সোসাইটির মাসিক অধিবেশন চলতো । প্রায় ৩০০ শত জন সদস্য ছিলেন , যাঁরা দস্তুরমত চাঁদা দিতেন । তখন প্রবেশ মূল্য ছিল বত্রিশ টাকা , শহরের সদস্যদের প্রতি তিনমাসে ন ' টাকা এবং মফঃস্বলের সদস্যদের ছ ' টাকা চাঁদা দেওয়ার নিয়ম ছিল । এই চাঁদার বিনিময়ে সোসাইটির গ্রন্থাদি ব্যবহার এবং প্রকাশিত পুস্তক বিনামূল্যে পাওয়া যেতো । পরে গ্রন্থাগারে পুস্তকসংখ্যা বৰ্দ্ধিত হয়েছিল। । প্রথমে সোসাইটির মুখপাত্র ছিল ‘ এসিয়াটিক রিসার্চেশ ’ ইং ১৭৯৯-১৮৩৯ পৰ্য্যস্ত ।প্রথমে সোসাইটি কোন সরকারী ভাতা লাভ করতো না । ইং ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দে অনারেবল কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স মাসিক ৫০০ শত টাকা ভাড়া দেওয়ার রীতি প্রবর্তিত করেন । ইং ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে দি ইম্পিরিয়েল গভর্নমেন্ট আরও ২৫০ টাকা ভাতা বৰ্দ্ধিত করেন । গ্রন্থাগারে গ্রন্থসংখ্যা এবং বিবিধ সংগ্রহ ক্রমে ক্রমে বৰ্দ্ধিত হওয়ার জন্য সোসাইটির সংগ্রহ চৌরঙ্গীস্থিত যাদুঘরে রাখা হয় । প্রাচীন ভারতের সুপ্ত প্রত্নতত্ত্ব এবং ঐতিহাসিক ঘটনাদির উদ্ধারই সোসাইটির উদ্দেশ্য ছিল । উদ্ভিদতত্ত্ব , প্রাণীতত্ত্ব , ভারতের প্রাচীন স্থাপত্যশিল্প প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের গবেষণাময় আলোচনা চলতো সোসাইটিতে। সে যুগের খ্যাতিমান বাঙালী , পদস্থ ইংরেজগণ এই সভার সদস্য ও অলঙ্কার ছিলেন।

সার্কুলার রোড

স্বাধীনতা আন্দোলন ও বিপ্লবী সমিতির স্থাপন এবং এই সব ইতিহাসের সাথে সার্কুলার রোডের নাম বিশেষ ভাবে জড়িত । এই অঞ্চল গুলিতে জঙ্গল ভর্তি , লোক সংখ্যা কম , পুলিশের দৃষ্টি সহজে পড়বে না তাই বোমা তৈরির কারখানা এই রাজপথের ধরে গড়ে উঠেছিল । পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিলেন বাঘা যতীন । তাঁর প্রিয় শিষ্য অতুল কৃষ্ণ ঘোষ (১৮৯০-১৯৬৬) হিন্দু ইস্কুল থেকে পাশ করে স্কটিশ চার্চ কলেজে বিজ্ঞান পড়তেন । উচ্চ বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে অতুল কৃষ্ণ ঘোষ বোমা তৈরিতে পারদর্শিতা লাভ করেন । সম্ভবত ১৯১২ সালের প্রথম দিকে রাজা বাজারে ২৯৬/১ আপার সার্কুলার রোডে একটি বোমা তৈরির কারখানা করেন । ২১ নভেম্বর ১৯১৩ সালে রাজা বাজারের এই বাড়িতে তল্লাশি হয় , ওই সময়ে দীনেশ দাশগুপ্ত , সারদা গুহ , চন্দ্রশেখর দে প্রমুখ গ্রেপ্তার হন। রাজা বাজার বোমার কারখানার সাথে জড়িত অন্যতম পুলিশ ইন্সপেক্টর নৃপেন ঘোষকে ১৯১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি চিৎপুর রোডে হত্যা করা হয় ।সশস্ত্র অভ্যুত্থান ছিল শ্রী অরবিন্দুর সংকল্প ৷ যতীন সেই রূপায়ণে ব্রতী হলেন । ১৯০৩ সালে কলকাতায় এসে আপার সার্কুলার রোডের ১০৮ নম্বর একটি বাড়ি ভাড়া নিলেন। তাঁর সহধর্মিনী চিন্ময়দেবী ও বিধবা ভগ্নির সাথে এই বাড়িতে বাস করতে থাকেন । এছাড়া ম্যাথমেটিকাল সোসাইটির মতো বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজের আঙিনায় জন্ম লাভ করে । বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের স্থাপনের সংকল্প করা হয় ১৮ অক্টোবর ১৮৪৭ সালে। সভা হয় সার্কুলার রোডের বিজ্ঞান কলেজে । সভাপতিত্ব করেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু । ঠিকানা ৯২ আপার সার্কুলার রোড ৷ বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা ও প্রসার । সার্কুলার বিজ্ঞান কলেজের পাশে আর একটি মহান প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল । যার স্রষ্টা ছিলেন আচার্য্য জগদীশ চন্দ্ৰ বসু।

কলকাতার পতন উত্থান আর তার সৌন্দর্য ও কালিমা,কামনা-বাসনা সবই জড়িয়ে আছে চারিদিকের বাইরের পরিবেশ ও রাজপথ নিয়ে। এখনও হয়তো মহানগরীর বুকে বেড়ে ওঠা অনেক রাজপথের কাহিনী লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে।