গুসকরার মাহাতা গ্রামের কবিরাজ বাড়ির সুপ্রাচীন দুর্গাপূজা - Pralipta

অর্নিবান সাহা: অজয় নদীর দক্ষিণে এর প্রধান উপনদী  কুনুর নদীর তীরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পূর্ব বর্ধমানের ছোট্ট শহর গুসকরা । এটি একটি পৌরসভা । এখান থেকে আট কিলোমিটার দূরে গ্রাম মাহাতা । ছোট্ট গ্রাম মাহাতায় কবিরাজ বাড়ির সুপ্রাচীন দুর্গাপূজা আজও অনির্বাণ ।


কবিরাজ পরিবারের সপ্তম পূর্বপুরুষ মথুরামোহন রায় (তৎকালীন বাংলার কোনো রাজা বা জমিদারের থেকে এই পরিবার ‘রায়’ উপাধি পান) বসবাস করতেন মাহাতা গ্রামের পাশে ভুঁয়েরা গ্রামে । সেখান থেকেই বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে তিনি সপরিবারে মাহাতা গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন । বর্তমানে কর্মসূত্রে এই পরিবারের বংশধরেরা জেলা তথা রাজ্য তথা দেশে এমনকি দেশের বাইরে বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লেও এই পরিবারের আদি বাড়ি এখনো এই গ্রামেই অবস্থিত । মথুরামোহন রায় ছিলেন তৎকালীন সময়ে একজন প্রসিদ্ধ  কবিরাজ । মথুরামোহন রায়ের পঞ্চম উত্তরপুরুষ তথা বর্তমানে হুগলি জেলার বিশিষ্ট ইতিহাস অনুসন্ধানী শ্রীযুক্ত  শুভ্রাংশু কুমার রায় জানান, “সম্ভবত ‘রায়’ উপাধি কবিরাজি সূত্রে পাওয়া । মাহাতা গ্রামে বাস করতেন আর এক কবিরাজ ‘সেনগুপ্ত’ পরিবার । মথুরামোহন রায়ের পৌত্র রাধিকাপ্রসাদ রায়ের ‘ঘরজামাই’ হবার শর্তে সেনগুপ্ত পরিবারের কন্যা রামমোহিনীর বিয়ে হয়’। 

সেনগুপ্ত-রা মাহাতা গ্রামের স্বচ্ছল পরিবার ছিল । আধ্যাত্মিক নিষ্ঠা ও স্বচ্ছলতার কারণে এই সেনগুপ্ত পরিবার দুর্গাপূজা শুরু করে, প্রথমে তৈরি হয় মাটির ঠাকুরবাড়ি  । মাহাতা গ্রামের রায় পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তি খুব একটা কম ছিলনা । বৈবাহিক সূত্রে দুই পরিবারের মিলন ঘটলে রায় পরিবারও এই পূজার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হয়ে পড়ে । সেই থেকেই দুই পরিবারের মিলিত সিদ্ধান্তে প্রতি চার বছরে এক বছর করে সেনগুপ্ত পরিবারের দুর্গাপূজার দায়িত্ব পালা করে নেয় রায় পরিবার । ক্রমে গ্রামে এই পূজা ‘কবিরাজ বাড়ির দুর্গা পূজা’ নামে পরিচিত হয় । 


কবিরাজ পরিবারের প্রাচীন রীতি অনুযায়ী জন্মষ্টমীর দিন কাঠামো পূজার মাধ্যমে প্রতিবছর দুর্গাপূজার সূচনা হয় । কাঠামো পূজার পর বাড়ির ঠাকুরদালানেই মৃৎশিল্পী মৃন্ময়ী দেবীর মূর্তি তৈরি শুরু করেন যার নাম ‘এক মেটে’ হওয়া । বংশানুক্রমিকভাবে এই মূর্তি নির্মাণের কাজে যুক্ত ছিলেন মদন পাল । ১০ বছর আগে সেই ক্রমে ছেদ পড়ে । সেই থেকে গুসকরার জয়দেব পাল দেবী মূর্তি নির্মাণ করছেন । শুভ্রাংশু কুমার রায় জানান, ‘এই পরিবারের দেবী দশভুজা প্রথম থেকেই পঞ্চমুণ্ডির আসনে (পঞ্চমুণ্ডি অর্থাৎ চন্ডাল, কেউটে সাপ, শেয়াল, অপঘাতে মৃত মানুষ এবং ব্রহ্মজ্ঞানী হনুমানের মাথার খুলি দিয়ে তৈরি) অধিষ্ঠান করে শাক্তমতে পূজিত হন’ । এটাই এই পরিবারের দেবী দশভুজার পূজাপদ্ধতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।

মহাসপ্তমীর ভোরে নবপত্রিকা স্নানের আগে এই বাড়ির বড়বৌ বাড়ির ঠাকুরঘর থেকে লক্ষ্মীর ঘট ঠাকুরঘরে নিয়ে আসেন । তারপর আধ মাইল দূরে গ্রামের দক্ষিণে ঠাকুরনকুড়ি পুকুরে ঘটস্নানের উদ্দেশ্যে নবপত্রিকা নিয়ে যায় পরিবারের ছোটরা । আগে বাঁশে নবপত্রিকা বেঁধে কাঁধে করে যাওয়া হতো ঘটস্নানের জন্য । বছর ১৫ হলো ঢাকের বাদ্যি সহ পালকি করে নবপত্রিকা স্নানযাত্রা হচ্ছে । বংশপরম্পরায় নিযুক্ত নীলকমল ঢাকি বিগত কুড়ি বছর আগে এই পেশা ছেড়ে দিলে স্থানীয় হারু মুচি এখন ঢাক বাজাচ্ছেন । আর অসুরনাশিনী দেবী দুর্গার আরাধনায় বংশ পরম্পরায় নিযুক্ত রয়েছেন গ্রামের পুরোহিত তপন মুখোপাধ্যায় ।


যে কোনো পারিবারিক পূজা মানেই সেখানে পূজার উপাচার, নৈবেদ্য বা পূজার রীতিতে কোন বিশেষ নিয়ম লক্ষ্য করা যায় । গুসকরার মাহাতা গ্রামের কবিরাজ বাড়িও ব্যতিক্রম নয় । দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত নৈবেদ্যতে দেওয়া চালের পরিমাণ ও প্রসাদ স্বরূপ সেই চালের প্রাপকদের ক্ষেত্রে এই পরিবারে বিশেষ রীতির ছাপ আজও বর্তমান । নৈবেদ্যতে দেওয়া চালের পরিমাণ এবং পূজার পর সেই চালের প্রাপক নিম্নরূপ :
মহা সপ্তমী : নৈবেদ্যে থাকে সাত সের চাল । এর মধ্যে ছয় সের চাল পুরোহিতের প্রাপ্য এবং এক সের পান যিনি পূজার ফুলের যোগান দেন । 
মহা অষ্টমী : নৈবেদ্যে দেওয়া আট সের চাল । যার থেকে সাত সের চাল পুরোহিত পান আর এক সের চাল পারিবারিক গুরুদেবকে প্রণামী রূপে দেওয়া হয় । 
সন্ধিপূজা : নৈবেদ্যের পাঁচ সের চাল পুরোহিতের প্রাপ্য । 
মহা নবমী : নৈবেদ্যে দেওয়া নয় সের চাল । এরমধ্যে সাত সের চাল পান পুরোহিত । এক সের চাল পান মৃৎশিল্পী ও এক সের চাল পান পূজার অন্যান্য উপকরণ যোগাড় দেন যিনি ।

এই পরিবারের দেবী দুর্গার আরাধনায় পারিবারিক রীতি অনুযায়ী সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিন দিনের পূজায় মায়ের উদ্দেশ্যে কোন অন্নভোগ উৎসর্গ করা হয় না । তিন দিন সন্ধ্যায় আরতির সময় লুচি ভোগ দেওয়া হয়  মায়ের উদ্দেশ্যে । কিন্তু প্রাচীন রীতি অনুযায়ী নবমীর দিন দুপুর বেলায় সর্বসাধারণের জন্য অর্থাৎ গ্রামের সকল মানুষের জন্য খিচুড়ি ভোগের ব্যবস্থা করা হয় ।


গুসকরার মাহাতা গ্রামের কবিরাজ বাড়ির দুর্গা পূজার কথা বলতে গেলে স্থানীয় গ্রাম্যদেবী ভদ্রকালী উল্লেখ অবশ্যই করতে হয় । কথিত আছে আলীবর্দী খাঁ এর সমসাময়িক একটি শিলামুর্তি এই গ্রামেরই দক্ষিণে অবস্থিত ঠাকুরানকুড়ি পুকুর থেকে পাওয়া যায় । বহু প্রাচীনকালে এই শিলামুর্তিকে রামঅযোধ্যা ভট্টাচার্য নামে এক ব্যক্তির উদ্যোগে গ্রামের শ্মশানে মন্দির তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করা হয় । মাহাতা গ্রামে এই শিলা মুর্তি স্থানীয় গ্রাম্যদেবী ভদ্রকালী নামে পরিচিত । গ্রামের কেউ কেউ মনে করেন এই গ্রামের দেবী ভদ্রকালী (বড় বোন) ও কবিরাজ বাড়ির দেবী দুর্গা (ছোট বোন) দুই বোন । দুর্গাপূজার সময় মহা নবমীর দিন রাত্রে এই কবিরাজ বাড়ির অনুমতি নিয়ে দেবী ভদ্রকালীকে মন্দির থেকে বাইরে নিয়ে এসে বিশেষ আয়োজন করে শোভাযাত্রা সহ গ্রাম প্রদক্ষিণ করে ঠাকুরানকুড়ি  পুকুরের কাছে বিশেষ স্থানে, গ্রাম্য ভাষায় থানে,  নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানেই দেবী ভদ্রকালীর বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়, বলি হয় । পূজার পর মন্দিরে ফেরার সময় প্রতিটি বাড়িতে কিছু সময়ের জন্য দাঁড় করানো হয় । সেখানেই ভক্তরা দেবী ভদ্রকালীর উদ্দেশ্যে প্রদীপ বা মোমবাতির আলো দেখান  ও নিজেদের মনস্কামনা জানান । দেবী ভদ্রকালীর প্রতি বাড়িতে দাঁড়ানোর এই গ্রাম্যরীতি অনুযায়ী কবিরাজবাড়িতেও কিছু সময় তাকে দাঁড় করানো হয় । সারা বছরের এই একটিই বিশেষ সময়, এই মাহেন্দ্রক্ষণেই দুই বোনের সাক্ষাৎ ঘটে যখন ভদ্রকালী আসেন কবিরাজবাড়ির সামনে । কবিরাজবাড়ির তরফ থেকে গ্রাম্যরীতি অনুযায়ী বড় বোন ভদ্রকালীর উদ্দেশ্যে প্রদীপ বা মোমবাতির আলো দেখানো হয় । এরপর দেবী ভদ্রকালীকে পুনরায় তাঁর নিজস্ব মন্দিরের বেদীতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয় ।

অতীতকালে গ্রাম্য সংস্কৃতিতে বহু কঠিন রীতি প্রচলিত ছিল,  আর সেগুলি বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রেই ছিল । এই পরিবারের দেবী দুর্গার আরাধনা কঠোরভাবে পুরুষতান্ত্রিক পূজা । এই রীতি প্রায় প্রারম্ভিক বর্ষ থেকেই এই পরিবারে প্রচলিত যা আজও অক্ষুন্ন । এই রীতির ফলে বাড়ির কোন মহিলা সদস্যা পূজা সংক্রান্ত প্রত্যক্ষ কাজে যুক্ত হতে পারেন না বা মন্দিরের ভিতর কোন রকম কাজ করতে পারে না । পূজা সংক্রান্ত প্রায় সব কাজ করেন পুরুষরা । 

তিনদিন মহা ধুমধামের সাথে গুসকরার মাহাতা গ্রামের কবিরাজ বাড়ির দেবী দশভুজার পূজিত হবার পর বিজয়া দশমীর দিন ফিরে যান কৈলাসে । এই বাড়ির বা পরিবারের আদি রীতি অনুযায়ী দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তিকে বেদীতে তোলা, নামানো এবং সেখান থেকে বিসর্জনের ঘাট পর্যন্ত নিয়ে যাবার জন্য কাহার সম্প্রদায়ের মানুষেরা যুক্ত থাকে । বিজয়া দশমীর দিন বিকেলবেলায় কাহারের দল কাঁধে চেপে এই পরিবারের দেবী দশভুজা সমগ্র মাহাতা গ্রাম প্রদক্ষিণ করেন । শেষে গ্রামের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত খেঁদো পুকুরে নিরঞ্জন হয় । প্রতিমা বিসর্জনের পর এই পরিবারে একটি বিশেষ রীতি প্রচলিত রয়েছে । দেবী মায়ের মৃন্ময়ীর মূর্তি জলে পরার পর কবিরাজবাড়ির এক সদস্য মশাল নিয়ে গ্রামের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত বনাঞ্চলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, সাথে থাকে একজন লন্ঠন বাহক এবং একজন ঢাকি ।  ঘন বনাঞ্চলের মধ্যে এক বিশেষ জায়গায় পরিবারের সদস্য মশাল মাটিতে পুঁতে দেন । এরপর পিছন ফিরে না তাকিয়ে সেই সদস্য ফিরে আসেন কবিরাজবাড়ির মন্দিরপ্রাঙ্গণে । শুরু হয় বিজয়ার প্রণাম, কোলাকুলি ও মিষ্টি বিতরণ ।  অতি প্রাচীনকাল থেকেই এই রীতি প্রচলিত । কবিরাজবাড়ি্র পরম্পরাগত বিশ্বাস, এ সময় তাদের পূর্বপুরুষরা দেখতে আসেন তাদের দেখানো পথে পরবর্তী প্রজন্ম চলছে কিনা । আর এই প্রজন্ম সেই বিশ্বাসে মশাল পুঁতে জানায়, আমরা তোমাদের দেখানো পথে চলার চেষ্টা করে চলেছি । বনাঞ্চলে মশাল পুঁতে দিয়ে আসার এই সুপ্রাচীন প্রথা কবিরাজবাড়ির ধারাবাহিক সম্পর্ক রাখা ও কর্তব্য পালনের এক উজ্জ্বল নিদর্শন ।

বর্ধমানের গুসকরার মাহাতা গ্রামের কবিরাজ পরিবারের দুর্গাপূজা উপলক্ষে অষ্টমী ও নবমীর দিন নাটক, রামযাত্রা অনুষ্ঠিত হতো পূর্বকালে । এছাড়াও থাকতো নামগানের আসর । এই সকল অনুষ্ঠান উপলক্ষে তৎকালীন সময়ে গ্রামের মানুষদের মধ্যে যথেষ্ট উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যেত । প্রায় সকলেই নাটক ও রামযাত্রা শোনার জন্য অষ্টমী ও নবমীর দিন এই বাড়িতে ভিড় করত । তবে বেশ কিছু বছর পূর্বে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক কারণে এই সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয় পরিবারের তরফ থেকে । কিন্তু পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে তাদের মনোমত পুনর্বহাল করার জন্য উৎসুক । বেশ কিছু বছর পূজা উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকলেও, বর্তমানে তা ভিন্ন রূপে ভিন্ন ভাবে পুনরায় চালু করা সম্ভব হয়েছে । বর্তমানে এই পরিবারের দুর্গাপূজা উপলক্ষে চারদিন ধরে বিভিন্ন রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলপনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে । সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গ্রামের সকল মানুষ  যোগ দিচ্ছেন । আলপনা প্রতিযোগিতায় গ্রামের ছেলে, মেয়ে, গৃহবধূ যোগ দিয়েছেন । এছাড়াও বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী বেশকিছু সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষদের মাধ্যমে সাঁওতাল নৃত্য প্রদর্শিত হচ্ছে ।



তথ্যসূত্র :
-- রায় পরিবারের পঞ্চম উত্তরপুরুষ শ্রীযুক্ত শুভ্রাংশু কুমার রায়  মহাশয়ের থেকে আলাপচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য ।
-- মাহাতা গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কিত একটি স্কেচ থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলী ।
-- রায় পরিবারের পারিবারিক তালিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলী ।
-- সেনগুপ্ত পরিবারের পারিবারিক তালিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলী ।
-- শুভ্রাংশু কুমার রায় মহাশয়ের থেকে প্রাপ্ত পারিবারিক পূজা সম্পর্কিত কিছু ছবি থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলী ।