চন্দননগরের প্রাণপুরুষ ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরী (দ্বিতীয় পর্ব) - Pralipta


অনির্বাণ সাহা: বিদেশী রাজার দেওয়া সম্মান ইন্দ্রনারায়নের কাছে যথেষ্ট ছিলনা। তিনি চেয়েছিলেন সামাজিক গোত্রপতির সম্মান, যা কেনা যায় না, যা অর্জন করতে হয় সমাজের বাকি সম্মানীয় ও বিচক্ষণ ব্যক্তিদের সম্মতির মাধ্যমে। আর এই সামাজিক মানরক্ষার লড়াইয়ে ইন্দ্রনারায়নের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল চন্দননগরের তৎকালীন সাবেক গোত্রপতি হালদাররা। ইন্দ্রনারায়নের বিপুল অর্থ ও রাজ-অনুগ্রহ থাকলেও যা তাঁর ছিল না তা হল, তৎকালীন যুগের আক্ষরিক অর্থে ব্রহ্মাস্ত্র, অর্থাৎ বামুন সমাজের অনুগ্রহ! ব্রাহ্মণ সমাজকে নিজের পাশে না পেলে যত টাকা আর যত ক্ষমতাই থাক, গোত্রপতি হওয়ার স্বপ্ন দিবাস্বপ্নই থেকে যাবে। ইন্দ্রনারায়ন সেটা জানতেন। এবং সেই কারনেই ফরাসী রাজের কাছ থেকে স্বর্ণপদক লাভ করার পর তিনি তাঁর বাড়িতে একটি বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, যেখানে গোটা চন্দননগরের সমস্ত শ্রেনীর মানুষের কাছে তিন বেলা পাত পেড়ে খাওয়ার নিমন্ত্রণ গেল। কিন্তু তৎকালীন হালদারদের সুচতুর চক্রান্তে ইন্দ্রনারায়নের বিশাল অনুষ্ঠানের সফলতা আক্রান্ত হয় ও তাঁর গোত্রপতি বা সামাজিকভাবে সম্মানীয় ব্যক্তি হওয়া স্বপ্ন দিবাস্বপ্নই থেকে যায়। ফলে গোত্রপতির স্বপ্ন সফল তো হলোই না, উল্টে হিন্দু সমাজের ছায়া মারানোও ইন্দ্রনারায়নের নিষিদ্ধ হয়ে গেল।

পারিবারিক, ব্যবসায়িক ও আর্থিক লেনদেনের কারণে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরির সাথে নবদ্বীপের কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের সুসম্পর্ক বহু দিন থেকেই গড়ে উঠেছিল। কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা মহারাজা রঘুরাম রায়ও আনুমানিক ১৭১৬-১৭২৮ সাল নাগাদ আর্থিক হিসাব-নিকাশের কারণে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরির কাছে অনেকবারই সাহায্য গ্রহণ করেছেন। সেই সূত্রেই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সাথে তাঁর পরিচয় ও হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। হিন্দু সমাজের ছায়া মারানো নিষিদ্ধ হলেও দীর্ঘ পাঁচ বছরে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয় এবং ইন্দ্রনারায়ণ তাঁর গোত্রপতি বা সামাজিকভাবে সম্মানীয় ব্যক্তি হওয়ার স্বপ্নপূরণের প্রথমধাপ হিসাবে ১৭৪০ সালে অধুনা চন্দননগরের ছবিঘর বাসস্টপ সংলগ্ন লালবাগানের এলাকায় সম্পূর্ণ নিজ খরচে "নন্দদুলাল মন্দির" গড়ে তোলেন ও প্রভূত অলংকারাদী সহ মূর্তি স্থাপন করেন। (তবে এব্যাপারে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর দাদা রাজারাম চৌধুরীর বর্তমান উত্তরসূরি পিনাকী চৌধুরী মহাশয়ের পত্নী শ্রীমতি মাধুরী চৌধুরী মহাশয়ার থেকে সাক্ষাতকারের মাধ্যমে জানা যায় যে, "একসময় ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী মহাশয় তার কিছু সঙ্গীকে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে চন্দননগর থেকে শ্রীরামপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন । তৎকালীন যুগে শুধু এই রাস্তা কেন প্রায় সমস্ত রাস্তায় ছিল জঙ্গলাবৃত বা বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে । পথেই তিনি দেখতে পান পালকিবাহক বিহীন একটি পালকি রাস্তার মাঝে পড়ে আছে । কাছে গিয়ে পালকির পর্দা সরিয়ে তিনি লক্ষ্য করেন সেখানে এক অল্পবয়স্কা বিধবা নারী রয়েছেন । তার সাথে কথাবার্তার মাধ্যমে ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরী মহাশয় জানতে পারেন যে, তিনি বাপেরবাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন কিন্তু পথমধ্যে এই জঙ্গলে তিনি ডাকাতদের আক্রমণের শিকার হন । ডাকাতের ভয় পালকিবাহকরা তাকে পালকি সহ এখানে ফেলে পালিয়ে যায় । ডাকাতরা তার কোন ক্ষতি না করলেও তার সাথে থাকা বেশকিছু অর্থ ও গহনা লুট করে চলে যায় । তখন ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরী তার গন্তব্যস্থানের খোঁজ নেন এবং তাকে সেখানে পৌঁছে দিতে চান । কিন্তু সেই অল্পবয়স্কা বিধবা নারী জানান যে, ডাকাতের আক্রমণের শিকার হওয়ায় তিনি আর কোথাও বা কোন বাড়িতেই স্থান পাবেন না তৎকালীন সমাজব্যবস্থার রীতি অনুযায়ী । এখন তার একমাত্র স্থান "মা গঙ্গার বুকে" । একথা শুনে ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরী নিজ আশ্রয়ে তাকে স্থান দিতে চান এবং তিনিও রাজি হয়ে যান । সেখান থেকে শ্রীরামপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা না করে সেই মহিলাকে নিয়ে চন্দননগরের নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন ইন্দ্রনারায়ন । পরবর্তী সময়ে তার আশ্রয়স্থল হিসেবে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী চন্দননগরের ছবিঘরের নিকট নন্দদুলাল মন্দির স্থাপন করেন । এই মন্দিরেই সেই বিধবা মহিলার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ছিলেন এবং মন্দিরের সমস্ত নিত্য কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন"।) এতে তৎকালীন যুগে নিত্যপূজার ব্যবস্থাও করা হয়। এরফলে সাময়িকভাবে তাঁর অবস্থানের কিছুটা উন্নতি হলেও, তাঁর স্বপ্ন এখনও অধরাই থেকে যায়। ১৭৪২ সালে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর্থিক দেনায় জর্জরিত হয়ে মুর্শিদাবাদের নবাব আলিবর্দি খানের জেলে বন্দী হলে ইন্দ্রনারায়নের হস্তক্ষেপে (কৈশোরকালে আলিবর্দি খানের পিতা মুর্শিদকুলি খানের আশ্রয়েই ছিলেন ইন্দ্রনারায়ন, ফলে এই নবাব পরিবারের সাথেও তাঁর সুসম্পর্ক ছিল) ও আর্থিক সাহয্যে তিনি মুক্ত হন। ফলে ইন্দ্রনারায়নের সাথে তাঁর সম্পর্ক ও বিশ্বাষযোগ্যতা আরও নিবিড় হয়ে ওঠে। এরপরই এক সন্ধ্যায় কৃষ্ণচন্দ্রের কাব্য-সাহিত্য ইত্যাদির প্রতি অনুরাগের কথা মাথায় রেখে কাব্য-সঙ্গীত-নৃত্য-পানাহার সম্বলিত এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন ও মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে আমন্ত্রণ জানান। সেখানেই ইন্দ্রনারায়ণ তাঁর গোত্রপতির স্বপ্নের কথা কৃষ্ণচন্দ্রকে জানান। তাৎক্ষনিকভাবে কৃষ্ণচন্দ্র কিছু না বললেও নবদ্বীপ ফিরে গিয়ে চন্দননগর ও নবদ্বীপের তাবড় হিন্দুশাস্ত্র পণ্ডিতদের সাথে দীর্ঘ আলোচনা করে কিছুদিনের মধ্যেই একটি বিধান বার করেন। হিন্দুশাস্ত্র পণ্ডিতদের দেওয়া বিধানটি কিছুটা এইরকম :- "ইন্দ্রনারায়নের চার কন্যাকে চারটি কুলীন ব্রাহ্মণ সন্তানের সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে। চারটি কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবার তাঁর অনুগত থাকলে তিনি তাঁদের আত্মীয়-কুটুম্বদের একজোট করে নিজে স্বতন্ত্র দল গঠন করতে পারবেন এবং এই সংগঠিত পাঁচ পরিবারের ধারে-ভারে খুব সাধারণভাবেই হালদারদের সরিয়ে তিনি নিজে গোত্রপতির সম্মান লাভ করতে পারবেন"। 


কৃষ্ণচন্দ্রের তরফ থেকে পত্রপাঠ এই বিধানের কথা সবিস্তারে জেনে তা কার্যকর করতে উদ্যত হন ইন্দ্রনারায়ণ, কিন্তু তৎকালীন যুগে চার-চরটি কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবার ও তাদের বিবাহযোগ্য সন্তান পাওয়া বা খুঁজে বার করা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু অর্থ-সামাজিক, ব্যবসায়িক ও সুমধুর ব্যবহারের মাধ্যমে ইন্দ্রনারায়ণ ততদিনে বাংলা তথা দেশের অন্যত্রও এক বিশাল পরিচিতি গড়ে তুলেছিলেন। তিনি তাঁর সেই পরিচিতির মাধ্যমে খোঁজ করে অতি অল্প সময়েই তাঁর চরটি বিবাহযোগ্যা মেয়ের জন্য চারটি কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের বিবাহযোগ্য সন্তানের খোঁজ পান ও চারজনের একত্রে বিবাহ দেন। ফলে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সাহায্যে ইন্দ্রনারায়নের গোত্রপতি হবার স্বপ্ন সার্থক হয়। 

এরই মাঝে কবি ভারতচন্দ্র কারাগার থেকে পালিয়ে কিছুদিন খানাকুলে তাঁর ভগিনী-জামাইয়ের আশ্রয়ে থাকার পর সেখান থেকে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ১৭৫২ সালে  চন্দননগরে এলে ইন্দ্রনারায়ণ আশ্রয়দান করেন তৎকালীন চন্দননগরের ওলন্দাজ সরকারের দেওয়ান রামেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গোন্দলপাড়ার বাড়িতে। ভরতচন্দ্রের কাব্যপ্রতিভা দেখে ইন্দ্রনারায়ণ মুগ্ধ হন ও এই প্রতিভাকে আরও বিকশিত হতে ও তাঁর যোগ্য সম্মান দেবার জন্য মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। বিবাহবাসরে নিমন্ত্রিত হিসাবে বহু বিশিষ্ট অতিথিদের সঙ্গে চন্দননগরে উপস্থিত ছিলেন সপরিবার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। ছিলেন ভারতচন্দ্রও। নির্বিঘ্নে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবার পর বিদায়ের সময় ইন্দ্রনারায়ন মহারাজকে নিজের আজীবন কৃতজ্ঞতার কথা জানিয়ে ভবিষ্যতে যে কোনো প্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দান করেন ও কবি ভারতচন্দ্রের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের কথা মাথায় রেখে উপহারস্বরূপ এই কবিকে গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন। অত্যন্ত আনন্দের সাথে কৃষ্ণচন্দ্র সেই উপহার গ্রহণ করেন ও পড়ে ভারতচন্দ্রকে মাসিক ৪০ টাকা মাহিনায় সভাকবি হিসাবে নিযুক্ত করেন। এখনেই কবি ভারতচন্দ্র হয়ে ওঠেন "রায় গুনাকর ভারতচন্দ্র"।

কৃষ্ণচন্দ্রের সহযোগিতায় বা প্রতিবিধানে চরটি কুলীন ব্রাহ্মণ সন্তানের সাথে চার কন্যা সন্তানের বিবাহ দিয়ে কন্যাদায় থেকে মুক্ত হবার পাশপাশি নিজের গোত্রপতি হবার স্বপ্ন সার্থক করে অবশেষে ১৭৫৬ সালে ইন্দ্রনারায়ণ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আর তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই চন্দননগরের ভাগ্যের চাকাও বিপরীতে ঘুরতে শুরু করে।

তথ্যসূত্র :

→ চন্দননগরের কথা - লিপিকা ঘোষ। 
→ সংক্ষিপ্ত চন্দননগর-পরিচয় - হরিহর শেঠ। 
→ বিংশবঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন (৯ই ফাল্গুন,  ১৩৭৩ সন) - অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি শ্রী হরিহর শেঠ মহাশয়ের অভিভাষণ। 
→ roarmedia ওয়েবপেজে ৭ই মার্চ, ২০১৯ তারিখে আবু বকর সিদ্দিকী কর্তৃক প্রকাশিত "ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর: অষ্টাদশ শতকের শ্রেষ্ঠ কবি" শীর্ষক প্রতিবেদন। 
→ http://www.chorjapod.com ওয়েবপেজে ১৪ই নভেম্বর, ২০১৪ তারিখের "বাংলার প্রথম ফরাসী বাবু ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ও কিছু অজানা ইতিহাস" শীর্ষক প্রতিবেদন।)।