কালাপানি জয়ী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় - Pralipta

অনির্বাণ সাহা: হুগলী জেলার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে প্রতি কোনায় কোনায় ছড়িয়ে রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা। দেশ স্বাধীনের জন্য যারা নিজের সর্বস্ব দিয়েছেন, এমনকি প্রাণ ত্যাগেও কুন্ঠিত হন নি । হুগলী জেলার চন্দননগর শহর এমনই বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্মভূমি ও পীঠস্থান । তাদের মধ্যে বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ্য । 

কালাপানি, দ্বীপান্তর, আন্দামান নাম গুলো সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় কুখ্যাত সেলুলার জেলের কথা । যেখান থেকে  জীবন্ত ফিরে আসা এক প্রকার অসম্ভব ছিল । বন্দিদের প্রতি ইংরেজদের অত্যাচার এতটাই অমানুষিক ছিল যে হয় বন্দিরা আত্মহত্যা করত নতুবা পাগল হয়ে যেত। কিন্তু সব অত্যাচার, অবিচার ও নিষ্ঠুরতাকে অতিক্রম করে বাংলায় ফিরে এসেছিলেন চন্দননগরের এই বাঙালি বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় । 

উপেন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই জুন ফরাসী অধিকৃত চন্দননগরের গোন্দলপাড়ায় । তার পিতার নাম ছিল শ্রীযুক্ত রমানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (তিনি ছিলেন তৎকালীন যুগে একজন বিদ্বান ও শিল্পী) এবং মাতার নাম ছিল শ্রীমতি কুসুমকুমারী দেবী । শৈশবকালে চন্দননগরের ডুপ্লে কলেজে (বর্তমানে কানাইলাল বিদ্যামন্দির) ভর্তি হন । সেসময় ডুপ্লে কলেজের শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী চারুচন্দ্র রায় । ১৮৯৬-৯৭ খ্রীস্টাব্দে এখান থেকেই তিনি এফ.এ. পাশ করে মেডিকেল কলেজে চিকিৎষাশাস্ত্রে ভর্তি হন । কিন্তু স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ার জন্য পাঠ শেষ করতে পারেননি । পরে কলকাতার ডাফ কলেজে বি.এ. পাঠরত অবস্থাতেই হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল, অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হন । পাঠ শেষ করার আগেই তার সহপাঠী ঋষিকেশ কাঞ্জিলালকে সঙ্গে নিয়ে সন্ন্যাসীবেশে দেশ ভ্রমণে বের হন এবং আলমোড়া মায়াবতী আশ্রমে কিছুকাল (কিছু বছরও হতে পারে) সাধনা করেন । কিন্তু সেখানকার সাধন পদ্ধতি তার ভাল না লাগায় পুনরায় চন্দননগরে ফিরে আসেন । ভদ্রেশ্বরে তিনি কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দে তিনি চন্দননগর শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত গোন্দলপাড়া এলাকার বেশ কয়েকজন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সঙ্গীকে নিয়ে "বান্ধব সম্মিলনি" নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন । এখানে নিয়মিতভাবে সাহিত্যচর্চা, ধর্ম, রাজনীতি, শরীরচর্চা প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করা হতো । তৎকালীন হুগলি কলেজের অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ, উত্তরপাড়া অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ এই প্রতিষ্ঠান সাথে নিবিড় ভাবে যুক্ত ছিলেন । এই বছরেই উপেন্দ্রনাথ উল্লাসকর দত্ত, কানাইলাল দত্ত, রাসবিহারী বসু, মনিন্দ্রনাথ নায়েক, বারীনচন্দ্র ঘোষ প্রমুখের সান্নিধ্য পান । এরপরই তিনি বিপ্লবী দলে যোগ দিতে মনস্থ করেন । এই বাল্যকালেই উপেন্দ্রনাথের মনে দেশপ্রেমের বহ্নিশিখা জ্বলে ওঠে । কিন্তু এই বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়ার ঘটনাকে তার পরিবারের কেউই সমর্থন করেননি । তবে একমাত্র তার দাদা দেবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় (উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইয়ের নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়) তার ভাইয়ের বিপ্লবী দলে যোগদান ও বিপ্লবী চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হওয়াকে কিছুটা সমর্থন করেছিলেন । পরবর্তী সময়ে এই "বান্ধব সম্মিলনি" নামক প্রতিষ্ঠানটি চন্দননগরের বিপ্লবী আন্দোলনের এক অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ।

১৯০৬ সালে তিনি প্রথম 'বন্দেমাতরম' প্রত্রিকার সহ সম্পাদক হিসাবে নিযুক্ত হন। ঐ বছরেই তিনি 'যুগান্তর' প্রত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন । ঐসময় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে (১৯০৫-১৯০৬) কেন্দ্র করে সারা ভারতবর্ষ উত্তাল। উপেন্দ্রনাথের বিল্ববী মন তাঁর অন্তরাত্মাকে প্রবল ভাবে নাড়া দেয়। এই প্রসঙ্গে উপেন্দ্রনাথ লিখছেন, "কলকাতায় যুগান্তর অফিসে আসিয়া দেখিলাম ৩/৪টি যুবক মিলিয়া একখানা ছেঁড়া মাদুরের উপর বসিয়া ভারত উদ্ধার করিতে লাগিয়া গিয়াছেন। যুদ্ধের আসবাবের অভাব দেখিয়া মনটা একটু দমিয়া গেল বটে, কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্য। গুলি-গোলার অভাব তাঁহারা বাক্যের দ্বারা পূরণ করিযা দিলেন।"

একদিন কর্মরত অবস্থায় যুগান্তর অফিসেই বিপ্লবী বারীন ঘোষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এরপরই তিনি বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। ১৯০৮ সালে প্রফুল্ল চাকী ও  ক্ষুদিরাম বসু মজফরপুরে জজ কিংস্ফোর্ডকে হত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এর ঠিক দু'দিন পরে ২রা মে 
ব্রিটিশ পুলিশ ৩২, মুরারিপুকুর রোডের বারীন্দ্রনাথের মানিকতলার বাগানবাড়ী থেকে উপেন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তার করে। তাকে আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয় । অন্যান্য অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, উল্লসকর দত্ত, যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কানাইলাল দত্ত, দেবব্রত বসু, হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল প্রভৃতি । প্রাথমিকভাবে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী থাকাকালিন সময়ে পরিবারের পক্ষ থেকে কেবলমাত্র তার দাদা দেবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার সাথে দেখা করতে যেতেন । উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য উকিল হিসেবে নিযুক্ত হন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ।  বিচারে ঠিক হয় উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যদি ব্রিটিশ পুলিশের কাছে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চান তাহলে তাকে এই মামলা থেকে মুক্ত করা হবে । কিন্তু দেশমাতৃকার প্রতি নিয়োজিত প্রাণ উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দৃঢ়চিত্তে ও প্রবল সাহসিকতার জন্য ব্রিটিশ পুলিশের কাছে ক্ষমা চাইতে নিমরাজি হন । ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই মে বিচারে উপেন্দ্রনাথের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ হয় এবং তিনি আন্দামানে নির্বাসিত হন । সেখানে অমানুষিক পরিশ্রম ও প্রবল অত্যাচারের মধ্য দিয়ে ১২ বছর অতিবাহিত করেন তিনি । ১২ বছর পর মুক্তিলাভ করে চন্দননগরের গোন্দলপাড়া স্থিত নিজ বাসভবনে ফিরে আসেন । বিপ্লবীদের কারাবাস থেকে মুক্তির দাবীতে তিনি 'বিজলী' পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন । এই সময় তিনি পুনরায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সংস্পর্শে আসেন এবং তার 'নারায়ণ' পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন । ইতিমধ্যে অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তার অজ্ঞাতবাস থেকে আত্মপ্রকাশ করে ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে সাপ্তাহিক 'আত্মশক্তি' পত্রিকা প্রকাশ করেন । উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই পত্রিকার সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন । রাজনৈতিক কর্মসূচীর মাধ্যমে এই সময়ে তিনি চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সংস্পর্শেও আসেন । বহুবাজারের চেরী প্রেস থেকে তখন 'আত্মশক্তি' প্রকাশিত হত; সেখান থেকেই স্বরাজ দলের মুখপত্র বাংলা দৈনিক 'স্বদেশ' প্রকাশিত হতে থাকে (১৯২৩, ৯ই সেপ্টেম্বর) । 'স্বদেশ' পত্রিকা প্রকাশনার কাজে উপেন্দ্রনাথ বিশেষভাবে সহায়তা করেছিলেন । কিন্তু ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে সেপ্টেম্বর বৃটিশ সরকার আবার তাকে ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দের ৩ ধারায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করে । তিন বছর পর ১৯২৬-এ মুক্ত হয়ে তিনি সাংবাদিকতার কাজে যোগ দেন । 'ফরোয়ার্ড', 'লিবার্টি', 'অমৃতবাজার পত্রিকা' প্রভৃতির সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন । ১৯৪৫-এর এপ্রিল মাস থেকে আজীবন তিনি 'দৈনিক বসুমতী' পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন । শেষ জীবনে হিন্দু মহাসভার আদর্শের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন । ১৯৪৯-এর অগাষ্ট থেকে ১৯৫০-এর মার্চ মাস পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার সভাপতির পদেও অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন । 

১৯২১ সালে উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ হল "নির্বাসিতের আত্মকথা" । আন্দামানে কারবাসের কাহিনী ও জেলে যাবার আগেকার কিছুদিনের কথা তিনি এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে । ব্রিটিশদের থেকে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা আদায় জন্য এককালে কতশত মানুষ কী সীমাহীন আত্মত্যাগ করেছিলেন, ইংরেজদের নিষ্ঠুর অত্যাচার হাসিমুখে বরণ করেছিলেন বইটি আজও তার এক জ্বলন্ত দলিল । এছাড়া উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা অন্যান্য গ্রন্থগুলি হল : 'বর্তমান সমস্যা' (১৯২১) ; 'স্বাধীন মানুষ' ; 'জাতের বিড়ম্বনা' (১৯২১) ; ঊনপঞ্চাশী' (১৯২২) ; 'ধর্ম ও কর্ম' (১৯২২) ; 'পথের সন্ধান' (১৯২৮) ; 'অনন্তানন্দের পত্র' ; 'বর্তমান জগত' ; 'Memoirs of a Revolutionary ইত্যাদি । শোনা যায় 'অনন্তানন্দ ব্রহ্মচারী' ও 'পঞ্চানন্দ' ছদ্মনামেও তিনি মাঝে মাঝে লিখতেন । হাস্যরস যুক্ত ও সরস রচনা লিখতে তিনি যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন ।

এহেন বিপ্লবী, সাংবাদিক তথা সাহিত্যিক উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন হাস্যরসিক ও সরল মানসিকতাসম্পন্ন এক দৃঢ়চেতা ব্যক্তি । দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার যে প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, জীবিতকালে তিনি সেই স্বপ্নকে সার্থক হতে দেখেছেন দুচোখ ভরে । দেশ স্বাধীন হবার তিন বছর পর ১৯৫০ খ্রীষ্টাব্দের ৪ঠা এপ্রিল তিনি উত্তর কলকাতার সাউথ সিঁথি রোডের নিজ গৃহে পরলোক গমন করেন । কিন্তু আজও সকল মানুষের মনের মনিকোঠায় জেগে আছেন তিনি, বেঁচে আছেন তিনি । আজও তার বিপ্লব চেতনা আমাদের অনেককেই উদ্বুদ্ধ করে তোলে নিজেদের জীবন সংগ্রামের জন্য । ১৯৫৬ খ্রীষ্টাব্দে উত্তর কলকাতা সাউথ সিঁথি রোডের ন্যাশনাল পাবলিশার্সের উদ্যোগে উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর প্রায় ছয় বছর পর তার লেখা "ভবঘুরের চিঠি" নামক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় । বীর বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানাই চন্দননগর তথা সমগ্র ভারতবাসীর তরফ থেকে বিনম্র প্রণাম ।


তথ্যসূত্র :
-- "বিপ্লব তীর্থ চন্দননগর" : বিমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ।
-- "শিকরের সন্ধানে চন্দননগর" : শুভ্রাংশু কুমার রায় ।
-- চন্দননগর (১৪৯৯-২০০০) : মনোরঞ্জন মুখার্জী ।
-- নির্বাসিতের আত্মকথা : উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
-- sobbanglay.com নামক একটি ওয়েবপেজে প্রকাশিত উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনী সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন ।
-- উইকিপিডিয়া ওয়েব পেজ ।
-- ফেসবুকের “THE CHANDANNAGORE -চন্দননগর” পেজে প্রদীপ ব্যানার্জী মহাশয়ের প্রতিবেদন। 
-- বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতি শ্রীযুক্ত প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাবলী ।