মানস শেঠ: দুর্গা পুজোর আবহ আসন্ন।চারদিকে কাশফুল আর শিউলির সমারোহ।এই দুর্গা কি আমাদের নাকি কোনো প্রাক পৌরাণিক যুগের?এ নিয়ে তর্ক অন্তহীন হয়ে থাকে।হোক-চলুক তর্কের বান।আজ আমার উপস্থাপনা এই কিছু মহাকাব্যিক পুজো ও দুর্গা নিয়ে।
'দুর্গা' নামের উৎপত্তি নিয়ে 'মহাভারত'এ বলা হয়েছে সমস্ত রকম দুর্গতি থেকে উদ্ধার করেন বলেই উপাসকরা ভগবতীকে দুর্গা নামে পুজো করে থাকে।মহাকাব্যের তিন নায়কের কথা যদি বলি,-'রামায়ণ'এর রামচন্দ্র এবং 'মহাভারত'এর যুধিষ্ঠির এবং অর্জুন জীবন যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য দুর্গার বন্দনা করেছিলেন।রাবন বধ এবং লঙ্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে রামচন্দ্র যখন বানরসেনা নিয়ে সমুদ্রাভিযানে সমস্যায় পড়লেন,তখন জাম্বুবানের পরামর্শে অগস্ত্য মুনিকে স্মরণ করা হল।মুনি অগস্ত্য রামচন্দ্রকে বলেছিলেন দেবী দুর্গার পূজা করতে।মহাভারতের "বিরাট পর্বে" তেমনি দেখা যায়,রাজ্যভ্রষ্ট যুধিষ্ঠির বারো বছর বনবাসের পর দ্রৌপদী ও তার অনুজদের নিয়ে এক বছর অজ্ঞাতবাসের জন্য বিরাট নগরের পথে যাত্রা করেন।পঞ্চপাণ্ডব বলে তাঁদের কেউ চিনতে না পারে সেজন্য নতুন নাম নিয়েছেন-জয়,জয়ন্ত,বিজয়, জয়ৎসেন,জয়দ্বল।বিরাট নগরে প্রবেশের আগে লোকচক্ষুর আড়ালে শমীবৃক্ষতে লুকিয়ে রাখেন তাদের অস্ত্রগুলো।তারপর ঋষিদের উপদেশে অজ্ঞাতবাসের সাফল্য কামনায় যুধিষ্ঠির 'দুর্গাৎ তারয়সে দুর্গে তৎ ত্বং ত্বং দুর্গা স্মৃতা জনৈঃ' এই স্তব পাঠ করে দুর্গার আরাধনা শুরু করলেন।
মহাভারতে দুর্গার যে বর্ণনা পাওয়া যায়,তার সঙ্গে একালে পূজিতা দেবী দুর্গার মিল খুঁজে পাওয়া যায়।দেবতারা নিজেদের দেহ-নিঃসৃত ও পুঞ্জীভূত তেজ থেকে যে-দেবীকে সৃষ্টি করেন এবং যে শক্তিরূপিনীর কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন মহিষাসুর,যুধিষ্ঠির সেই দেবীরই স্তব করেছেন-মহিষমর্দিনীর ঘোর-রূপের।শিবের তেজে গঠিত হয়েছিল তার মুখ,যমরাজের তেজে কেশপাশ,বিষ্ণুর তেজে বাহু-সমূহ,চন্দ্রের তেজে বক্ষ,ইন্দ্রের তেজে কটিদেশ,বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু,পৃথিবীর তেজে নিতম্ব,ব্রহ্মার তেজে পদযুগল,সূর্যের তেজে পদের অঙ্গুলি,অস্টবসুর তেজে করের অঙ্গুলি,কুবেরের তেজে নাসিকা, প্রজাপতির তেজে দন্তপংক্তি,অগ্নির তেজে তৃতীয় নয়ন,সন্ধ্যাদেবীর তেজে ভ্রূ যুগল এবং বায়ুর তেজে কর্নদ্বয়।
দিব্য-পুষ্প মালা ভূষিতা সেই দেবীর দশ হাতে দশ-প্রহরণ,যাঁকে বিষ্ণু দিয়েছিলেন চক্র, মহাদেব ত্রিশূল,ব্রহ্মা রুদ্রাক্ষের মালা ও কমন্ডলু,ইন্দ্র বজ্র, বিশ্বকর্মা কুঠার,বরুনদেব পাশ,যমরাজ কালদন্ড।দেবতারা দেবীর দশভুজ সজ্জিত করলেন ক্ষীরোদ সমুদ্র থেকে উত্থিত মণিমুক্তো এবং অলঙ্কারে।করাঙ্গুলি অলঙ্কৃত কেয়ূর,বলয়,কন্ঠভূষণ নূপুর ও রত্নাঙ্গুরীয়তে।
যুধিষ্ঠির-বন্দিতা দেবী চতুর্ভুজা,চতুর্বক্রা,সিংহরূঢ়া।
যুধিষ্ঠির করজোড়ে দুর্গার উদ্দেশ্যে বললেন,
"হে অসুর-বিনাশিনী ভগবতী,তোমাকে প্রণাম!হে সৃষ্টি স্থিতি-প্রলয়কারিনী দুর্গে,তুমি ত্রিভুবন রক্ষা করেছ, মহিষাসুর বধ ক'রে দেবতাদের ফিরিয়ে দিয়েছ তাঁদের স্বর্গরাজ্য।আমরা রাজ্যভ্রষ্ট হয়েছি।কৃপা ক'রে আমাদের জয়ী হতে সাহায্য কর।হে শরণাগতের আশ্রয় দেবী দুর্গে,আমরা তোমার শরণার্থী,আমাদের রক্ষা কর।'
স্তবে প্রসন্ন দেবী আবির্ভুত হয়ে বললেন
'হে বীর, কৌরবদের পরাজিত করে শীঘ্রই তুমি রাজ্য ফিরে পাবে এবং সুখে শান্তিতে বসবাস করবে।"
দুর্গা বন্দনায় পাণ্ডবদের ফের দেখা যায় 'ভীষ্মপর্বে'।কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ-শুরুর আগে কৃষ্ণের 'নারায়ণী সেনা"সহ দুর্যোধনের বিশাল সৈন্যবহর দেখে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন যখন বিহ্বল হয়ে পড়লেন,কৃষ্ণ তাঁকে অভয় দিয়ে দুর্গাস্তোত্র পাঠ করবার উপদেশ দেন।অর্জুন তাঁর যুদ্ধরথ থেকে নেমে কৃতাঞ্জলিপুটে স্তব মালায় যে দেবীকে সম্বোধন করেন,তিনি বিন্ধ্যবাসিনি,চতুর্ভুজা এবং চতুর্বক্রা,সিদ্ধ-সেনানী,চন্ডী,
অর্জুনের স্তুতিতেই তুষ্ট হয়ে দুর্গা তাঁকে শত্রুজয়ের বরদান করেই অন্তর্হিত হন।তারপর শ্রীকৃষ্ণ শঙ্খনাদ ক'রে কুরুক্ষেত্রের সূচনা করলেন।