Kolkata Series:রামকমল সেনের বাড়ি কীভাবে হয়ে উঠল 'কফি হাউস'? - Pralipta


প্রলিপ্ত ডেস্ক: বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট, সেখানেই রয়েছে প্রিয় আড্ডাপীঠ কফি হাউস। যতই শহরের বুকে হাজার গন্ডা সিসিডি, ক্যাফে থাকুক কফি হাউসের কোনও তুলনা হয় না। কলকাতার কফিকালচারের জন্ম কিন্তু অনেক দিন আগেই হয়েছিল।

মাত্র পাঁচ বছর হল ইংরেজরা পলাশীর যুদ্ধ জিতেছে। ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা কার্যত সুনিশ্চিত করে ফেলেছেন ব্রিটিশরা। সেই সঙ্গে, ব্যবসা বিস্তারেও মন নিবেশ করছে ইংরেজ বণিকেরা। তবে, শুধু ব্যবসা করলেই তো হলো না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মী ও সেনা এবং ইংরেজ বণিকদের বিনোদনের জন্যেও কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁদের আড্ডা-আলোচনায় অবসর যাপনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

তখনই উইলিয়াম পার্কেসের মাথায় এল, কফির কাপে আড্ডার ফন্দি। কফির সঙ্গে বরাবরই সাহেবিয়ানার একটা সম্পর্ক রয়েছে। পার্কেস ঠিক করলেন, শহরের এক প্রান্তে বাগানবাড়ি কিনে সেখানে ‘কফি রুম’ বানাবেন। সেই মতো প্রস্তাব পাঠালেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। প্রস্তাবটি লুফে নেন কোম্পানির কর্তৃপক্ষেরা। 

কিন্তু একটা আশংকা ছিলই। কোম্পানির তরুণ প্রজন্ম আমোদ-প্রমোদে ভেসে গেলে সর্বনাশ! ব্যবসা লাটে উঠবে। তাই কোন্পানি এর সমাধান খুঁজতে বললো, অনুমতি মিলতে পারে একটি মাত্র শর্তে—সকালবেলায় অফিসের সময়ে আড্ডাখানা ‘কফি রুম’ বন্ধ রাখতে হবে। তবে কোনও মৌখিক শর্ত ছিল না। পুরোদস্তুর আইন প্রণয়ন করল কোম্পানি। সেই আইন মেনেই পার্কেস চালু করলেন তাঁর ‘লন্ডন হোটেল’। এই হোটেলেই বেশ সাজানো-গোছানো ‘কফি রুম’ বানালেন তিনি। সময়টা ১৭৬২ সালের ২১শে জুন। কলকাতায় কফি-কালচারের জন্ম। 

 এই ঘটনার প্রায় দেড়শো বছর পরে কলেজ স্ট্রিটে কফি হাউস তৈরি হয়। অনেকেরই একটি বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে, এটাই বোধহয় কলকাতার প্রথম কফি হাউস। আসলে তা সত্য নয়, আজকের বাঙালির কফি-আড্ডার জন্মদাতা কিন্তু পার্কেস সাহেবই। কোম্পানির এক ইংরেজ কর্মচারীর লেখা থেকে জানা যায়, লন্ডন হোটেলে সে সময়ে খাবারের দাম ছিল অত্যন্ত কম। ১৭৮০ সালে এক ডিশ কফির দাম ছিল মাত্র পঁচিশ পয়সা। সময় কাটানোর জন্য ছিল অঢেল ইংরেজি কাগজ এবং বই।

কিন্তু দিন যত এগোতে শুরু করে, লন্ডন হোটেলের ওই ছোট কফি রুম কোম্পানির তরুণ কর্মীদের, মন ভরাতে পারে না। আরও জায়গা চাই— এমন দাবি উঠল। তাই বাধ্য হয়ে ১৭৮৮ সালে তৈরি হল ক্যালকাটা এক্সচেঞ্জ কফি হাউস। অবশ্য শুধুই কলকাতায় কর্মরত কোম্পানির কর্তাব্যক্তি, কর্মচারী এবং বণিকদের জন্য এটি নির্মাণ করা হলো। তবে কফি হাউসের সদস্য হওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। মাসিক চাঁদা ৪ টাকা। এখানে রাখা থাকত কলকাতা, লন্ডন এবং মাদ্রাজের সমস্ত ইংরেজি কাগজ এবং রাজনৈতিক খবরের একাধিক পত্রিকা। দিব্যি জমে উঠেছিল সেই কফি হাউসের আড্ডাও। হঠাৎই একদিন বদলে গেল জমজমাট চিত্রটা। কারণ একটাই, সেটা হল লোকসান। 

আড্ডা জমলেও ব্যবসা তেমন জমে ওঠেনি। অগত্যা মালিক কফি হাউসটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। তখনই বেঁকে বসেন হাউসের সদস্যরা। ঠিক হয়, কফি হাউস বাঁচাতে লটারি করা হবে। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি! নিলামের সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় কলকাতার কফি প্রেমের এক অজানা অধ্যায়। প্রাসাদোপম বাড়িটি রয়েগিয়েছে শহরের বুকেই, কিন্তু ক্যালকাটা এক্সচেঞ্জ কফি হাউস নামে, আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। বর্তমানে সেটি রয়্যাল এক্সচেঞ্জ নামে পরিচিত। 

লন্ডন হোটেলে কলকাতায় প্রথম ‘কফি রুম’-এর প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম পার্কেসের; মূল উদ্দেশ্য ছিল, ব্রিটিশ যুবকরা যাতে বিপথগামী না হন। দিন যত গড়িয়েছে, কলকাতা শহরে সাহেব-মেমদের ভিড় বেড়েছে। ব্রিটিশ যুবকেরা ক্রমেই নেশাসক্ত হয়ে পড়ে। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি! কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না কেউই, আলাপ-আলোচনা চলছে। এই সময়ে ক্যাপ্টেন হেনরি পিডিংটন একটা উপায় আবিষ্কার করলেন। তিনি ছিলেন একজন সফল বিজ্ঞানী এবং ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, খনিজতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়েও তিনি পারদর্শী ছিলেন। পিডিংটন প্রস্তাব দিলেন, মাদকের নেশা থেকে ব্রিটিশ যুবকদের ফেরাতে মোক্ষম দাওয়াই হতে পারে কফি। প্রায় একশো বছর পর ১৮৪৮ সালে, কলকাতায় কফি-আড্ডাকে কার্যত আন্দোলনের রূপ দিলেন পিডিংটন। কালক্রমে যার ঠেক হয়ে উঠেছিল ‘অ্যালবার্ট হল’। হ্যাঁ এই অ্যালবার্ট হলই আজকের কফি হাউস।

একেবারে সাহেবি নাম হলেও কাজে অবশ্য ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র ছিল অ্যালবার্ট হল। ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অ্যালবার্ট হলে দাঁড়িয়ে কালী ও কালী পুজো সম্পর্ক বক্তব্য রেখেছিলেন নিবেদিতা। সে সময়ের কলকাতায় এমন কোনও বিখ্যাত মানুষ ছিলেন না, যাদের ভাষণের আওয়াজে মুখরিত হয়নি অ্যালবার্ট হল। ১৯৩৯ সালের ১৬ জানুয়ারি অ্যালবার্ট হলেই শরৎচন্দ্রের প্রথম স্মৃতি-বার্ষিক অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে অতুলচন্দ্র গুপ্ত পথের দাবী উপন্যাসের উপর থেকে ব্রিটিশ সরকারের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার দাবি তোলেন।

এত কান্ডের কেন্দ্র 'অ্যালবার্ট হল' হল কী করে? কেমন করেই বার এর নাম হল?
অ্যালবার্ট হল নামকরণের মধ্যে লুকিয়ে আছে রাজভক্তি। ১৮৭৫-৭৬ নাগাদ কলকাতায় এসেছিলেন রানি ভিক্টোরিয়ার ছেলে ‘প্রিন্স অফ ওয়েলস’ অ্যালবার্ট এডোয়ার্ড (১৮৭৫, ডিসেম্বর)। রানির ব্যাটার আগমণ উপলক্ষ্যে কলকাতায় দুটো প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছিল। শিশিরকুমার ঘোষ তৈরি করেছিলেন অ্যালবার্ট টেম্পল অফ সায়েন্স আর ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনদের ‘অ্যালবার্ট ইনস্টিটিউট’। অ্যালবার্ট ইনস্টিটিউটটিই অ্যালবার্ট হল। ১৮৭৬-এর ২৫ এপ্রিলে রামকমল সেনের বাড়িতেই বাংলার ছোটলাট রিচার্ড টেম্পল অ্যালবার্ট ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা করেন।

বেঙ্গল ব্যাঙ্কের দেওয়ান রামকমল সেন ছিলেন কেশব সেনের ঠাকুরদা। একসময় ওই বাড়ির দোতলায় থাকতেন হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ ডি এল রিচার্ডসন। আর নীচ তলায় কলকাতা মেডিকেল কলেজের ক্লাস চলত। রামকমল সেন ছোট ছেলে, কেশবচন্দ্রের কাকা মুরলীধর সেন ওই বাড়ির মালিকানা লাভ করেন। পাশেই শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের ২০ নম্বর বাড়িতে থাকতেন মুরলীধর সেন। ‘অ্যালবার্ট ইনস্টিটিউট’-এর পাকাপাকি ডেরা তৈরির জন্যে জন্যে ২৩,১৩০ টাকা ব্যয়ে রামকমল সেন ও মুরলীধর সেন, দুজনের বাড়িই কেনা হয়েছিল। মুরলীধর সেনের বাড়ি কেনা হয়েছিল, ১৮৭৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর নাগাদ। এই মুরলীধর সেনের নামে কিন্তু রাস্তাও আছে কলকাতায়। ১৮৭৬-এর ২৬ জুলাই আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রীরা অ্যালবার্ট ইনস্টিটিউটেই তৈরি করেছিলেন ভারতসভা। বছর ত্রিশের মধ্যে ফিকে হতে শুরু করে অ্যালবার্ট ইনস্টিটিউট। ১৯১২ সালে অ্যালবার্ট হলের মালিকানা বদল হল। চোরবাগানের জমিদার অভিরাম মল্লিকের পরিবার বাড়িটি কিনেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বাড়িকেই ব্রিটিশরা এয়ার রেড প্রিকশন সেন্টার বানিয়েছিল। 

১৯৪১-৪২ সালে ইন্ডিয়ান কফি বোর্ড সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের খুলল ‘ইন্ডিয়ান কফি হাউস’। কিছুদিন পর ১৫ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে অ্যালবার্ট ইনস্টিটিউটের হল ভাড়া নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান কফি হাউস’ খোলে ইন্ডিয়ান কফি বোর্ড। তৈরি হয় বাঙালির আড্ডাখানা, বুদ্ধিজীবীদের চারণভূমি। দক্ষিণ কলকাতাকেও এমনই কফি হাউস তৈরি করে ছিল কফি বোর্ড। 

কফি বোর্ডও এককালে কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস চালাতে পারেনি। ১৯৫৮ সালে সমবায় গোষ্ঠী এর দায়িত্ব নেয়। রাজ্য সরকারই কাজটি করে। ফের কফি কাপে ধোঁয়া আর আড্ডা বিতর্কের ঝড় উঠতে শুরু হয়। কিন্তু অধিগ্রহণ পছন্দ হয়নি মল্লিকদের, তারাই বাড়িটির মালিক। দিলেন মামলা ঠুকে, ভাবুন এক বাড়ি নিয়ে দুটো মামলা। তাও একই বিষয় বন্ধ হতে বসা থেকে রুখতে। প্রথমটা হয়েছিল ১৯১৬ নাগাদ অ্যালবার্ট ইনস্টিটিউটের বন্ধ হয়ে যাওয়া ঠেকাতে আর দ্বিতীয়টা হল এই বছর চল্লিশ আগে। শেষমেষ ১৯৯৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর সরকার কফি হাউস কিনে নিয়ে কফি হাউস সমবায়ের হাতে দায়িত্ব দিয়ে দেয়। 

যেখানে বসে আপনি কাটলেট-কবিরাজি খান, কফিতে চুমুক দেন, সেটি তৈরিই হয়েছিল রানি ভিক্টোরিয়ার ছেলে ‘প্রিন্স অফ ওয়েলস’ অ্যালবার্ট এডোয়ার্ডের জন্যে। আজও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে তার ঘোড়ায় সওয়ার মূর্তি দেখতে পাবেন। তার জন্যে তৈরি আরও দুটো জিনিস দাঁড়িয়ে আছে আমার-আপনার শহরে।

ধর্মতলায় লেনিন সরণির উপর, জিসি লাহার দোকানের ঠিক উল্টো দিকে টিপু সুলতান মসজিদের ফুটপাথে রয়েছে এক স্মারকস্তম্ভ। ভাগ্নপ্রায় সে স্তম্ভে লেখা Erected by Nawab Abdul Gunny C. S. I. and his son Nawab Ahsonollah Khan Bahadoor of Dacca to commemorate the visit of H. R. H. ALBERT EDWARD PRINCE OF WALES to Calcutta in 1875. সি.এস.আই হল কম্পানিয়ন অব দ্যি অর্ডার অফ দ্যি স্টার অব ইন্ডিয়া, একটি উপাধি। ইংরেজরা নিজেদের উমেদারদের দিতেন এসব। H.R.H. হল হিজ রয়াল হাইনেস। ফেয়ারলি প্লেসে ইস্টার্ন রেলের সদর দপ্তরের কাছে এমন আরেকটি স্মারক স্তম্ভের দেখা পাওয়া যাবে। লেখা থেকেই বোঝা যাচ্ছে রাজপুত্তুরের আগমন উপলক্ষ্যে এই দুটো সৌধ তৈরি করেছিলেন ঢাকার নবাব আবদুল গণি।

ছবি: ইন্টারনেট