উইলিয়াম হিকি খুবই সামাজিক ধরনের মানুষ ছিলেন। তাঁর বন্ধুবৎসলতা, অভিজাত আচরণ, ফুর্তিবাজ স্বভাব, পানপ্রিয়তা প্রভৃতি গুণাবলী তাঁকে জেন্টেলম্যান অ্যাটর্নি উপাধি দিয়েছিল। তৎকালীন রাজপুরুষ যথা ওয়ারেন হেষ্টিংস, ফিলিপ ফ্রান্সিস, বারওয়েল, ওয়াটসন, লর্ড কর্ণওয়ালিস, লর্ড ওয়েলসলি, জাষ্টিস এলিজা ইম্পে, জাষ্টিস হাইড, জাষ্টিস চেম্বার্স প্রভৃতির সঙ্গে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। গণ্যমান্য বাঙালীদের মধ্যে গোকুল ঘোষাল, নিমাই মল্লিক এবং এখানকার বেশি স্নান কেরানী প্রভৃতি বাঙালী বাবুদের সঙ্গে তিনি গভীর সম্পর্কে এসেছিলেন।
উইলিয়াম হিকি বহু দেশ ঘুরেছিলেন। ফ্রান্স, পর্তুগাল, হল্যও ও আফ্রিকার নানা দেশে তিনি অবস্থান করেছিলেন। তিনি বড় বড় চারটি খণ্ডে তাঁর স্মৃতিকথা বা মেময়ার্স রচ করেছিলেন যাতে ১৭৪৯ থেকে ১৮০৯ পর্যন্ত ষাট বছরের নানা দেশ ও মানুষ সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা প্রশংসনীয় ভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা প্রধানত কলকাতা শহরকে ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। তবে কলকাতা ছাড়াও তিনি চন্দননগর, চুঁচুড়া ও মুর্শিদাবাদের কথা লিখেছেন।
উইলিয়াম হিকি প্রথম চুঁচুড়ায় আসেন ১৭৭৮ খ্রীষ্টাব্দে মার্চ মাস। প্রথমে তিনি ফিটনে চেপে আসেন ব্যারাকপুর, সেখান থেকে আসেন পলতায় তাঁর বন্ধু জন প্রিন্সেপের কাছে। প্রন্সেপের একটি কাপড় ছাপানোর কারখানা ছিল। সেখানে দুদিন থেকে তিনি নদীপথে চন্দননগরে আসেন এবং সেখানকার ফরাসী গভর্ণরের বাড়িতে ওঠেন। তখন ফরাসী গভর্ণর ছুটিতে ছিলেন এবং তাঁর কাজ চালাচ্ছিলেন মাঁসিয়ে শেভিলার্জ নামক একজন ফরাসী অভিজাত ব্যক্তি। চন্দননগর থেকে হিকি আসেন ডাচ উপনিবেশ চুঁচুড়ায়। ডাচ গভর্ণরের নাম ছিল রোজ যিনি খুব রাজকীয় কায়দায় বাস করতেন। হিকি যখন বন্ধুবান্ধব সহ গভর্ণ রর বাড়িতে হাজির হন তখন দেখেন যে সেখানে একটি ভে জসভার আয়োজন চলছে। তাঁরাও তৎক্ষণাৎ নিমন্ত্রিত হন এবং ব্যান্ড বাদ্যের তালে তালে রাজকীয় ভোগ সম্পন্ন করেন। হিকি চুঁচুড়ায় তিনদিন ছিলেন এবং গুস্তাফ দুর্গ ও অন্যান্য দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করে পুনরায় পলতা হয়ে কলকাতায় ফিরে যান।
হিকি দ্বিতীয়বার চুঁচুড়ায় আসেন ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতা থেকে সোজা জলপথে। যাওয়ার লক্ষ্য ছিল অবশ্য মুর্শিদাবাদ। ১৭৯১ সালের জুনমাসে হিকির তৃতীয়বার চুঁচুড়ায় আসা হয়। তখন তিনি একটি হিন্দুস্তানী মেয়ের সঙ্গে ঘর সংসার করছেন, যাকে তিনি জমাদারনী বলে সম্বোধন করতেন। চুঁচুড়া তখনও ডাচ উপনিবেশ। নৌকা থেকে এই শহরের সৌন্দর্য দেখে জমাদারনীর এখানে বাস করার ইচ্ছা জাগে। চুঁচুড়ায় তাঁরা একটি বাড়ি ভাড়া করেন, সেখানে তাঁর গার্ডেনরিচের বাড়ির জন্য কেনা আসবাবপত্র হিকি আনিয়ে নেন। হিকি লিখেছেন যে কলকাতা থেকে চুঁচুড়াতে তাঁদের স্বাস্থ্য ভাল থাকত। প্রত্যহ তিনি অনেকক্ষণ এ শহরে ঘোড়ায় চেপে বেড়াতেন। পরে তিনি প্রতি শুক্রবারে রাত্রে অথবা শনিবার সকালে চুঁচুড়ায় আসতেন এবং সোমবার সকালে ফিরে যেতেন। সঙ্গে বন্ধুবান্ধবও কেউ কেউ থাকতেন। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম ছিল জন, যিনি হিকির অনুপস্থিতিতে সপ্তাহে তিন চারদিন করে চুঁচুড়ায় থাকতেন। মাঝে মাঝে ডাচ সাহেদের নিমন্ত্রণ করতেন এবং প্রচুর শ্যাম্পেন বার্গাণ্ডি পান করা হত।
কলকাতায় থেকে চুঁচুড়ায় আসতে তখন চারঘণ্টা সময় লাগত। তাঁরা ঘোড়ার গাড়ি চেপে পলতায় আসতেন। সেখান থেকে গঙ্গা পার হয়ে আবার ঘোড়ার গাড়িতে চেপে চুঁচুড়ায় আগমন ঘটত। এই উদ্দেশ্যে হিকি নিজেই একটা ফিটন গাড়ি কেনেন। পরে তিনি চুঁচুড়ায় পাকাপাকি থাকার সিদ্ধান্ত নেন। গঙ্গায় বেড়াবার জন্য একটি বোটও তিনি তৈরি করান কলকাতার বিখ্যাত বোট ব্যবসায়ী গিলেট সাহেবকে দিয়ে।
১৭৯৪ খ্রীষ্টাব্দেও হিকি কলকাতা চুঁচুড়া যাতায়াত করেছেন, কেননা জমাদারনী চুঁচুড়া ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে রাজি ছিল না। যে বিশাল বাড়িটায় তাঁরা বাস করতেন সেটা ছেড়ে দিয়ে ছোট বাড়ি ভাড়া নেন। বাড়িটা ছিল শহরে ঢোকার মুখে নদীর পাড়ের উপর। বাড়ির ছাদের উপর নিজের খরচে তিনি বাংলো ধরনের একটা ঘর তৈরি করে নেন। তাঁর নিজের ভাষায় সারা বাংলাদেশের মধ্যে এত সুন্দর বাংলো আর কোথাও ছিলনা।
পরে তিনি চুঁচুড়ায় নিজস্ব একটি বাড়ি তৈরি করতে মনস্থ করেন। জমি কেনা হয় নদীর তীর থে ক শ’ খানেক গজ দূরে, ডাচ গভর্নরের বাড়ির পাশের পার্কের কাছে। ১৭৯৬ খ্রীষ্টাব্দের পয়লা জানুয়ারি বাড়ির ভিত কাটা শুরু হয় এবং ১৫ ই জুন থেকে হিকি জমাদারনী সহ এই বাড়িতে বাস করতে শুরু করেন। বাড়িটি আকারে ছোট, কিন্তু তিনতলা। হিকির নিজের ভাষায় চুঁচুড়া শহরের লোকেরা এই বাড়িটির খুব তারিফ করত। বাড়িটি তৈরি করতে এবং আসবাবপত্র দিয়ে সাজাতে তাঁর চল্লিশ হাজার
টাকা খরচ হয়।
কিন্তু এই বাড়িতে বেশি দিন বাস করার ভাগ্য হিকির হয়নি। ১৭৯৬ খ্রীষ্টাব্দের ৪ আগষ্ট সন্তান প্রসবকালে জমাদারনী মারা যায় এর পর ১৮০২ সাল পর্যন্ত হিকি চুঁচুড়ার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিলেন । বাড়ির চাকর বাকরের খরচ এবং তাঁর সাধের বোটের ১৪ জন দাঁড়ি মাঝির খরচ খুব বেশি হওয়ায় তিনি বাড়িটাকে বিক্রয় করতে মনস্থ করেন। শেষ পর্যন্ত মাত্র দশ হাজার টাকায় তিনি বাড়িটা সার্জেন প্লেস্কেটকে বেচে দেন।চুঁচুড়ায় সঙ্গে হিকির সম্পর্কের এখানেই ইতি।
চুঁচুড়ায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত পুরাতন কাড়ির অভাব নেই, যেগুলির মধ্যে অনেকগুলিই আবার আগেকার আরও পুরাতন বাড়ির নূতন সংস্করণ অথবা সেগুলির উপর নূতন কার তৈরী করা হয়েছে। গঙ্গাতীরে উইলিয়াম হিকির প্রথম বাংলা বাড়ি , অর্থাৎ যে বাড়ির দ্বিতলে বাংলো ধরণের ঢালু ছাদ, অথবা ডাচ গভর্ণরের বাড়ির কাছাকাছি পার্কের ধারে তাঁর তৈরি নিজস্ব বাড়ি কোন টিকেই আজ হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবেনা, তবে এটুকু নিশ্চিত যে এই ছুটি বাড়িই বৰ্তমান বর্ধমান বিভাগের কমিশনারের বাড়ি থেকে উত্তরে জোড়াঘাট ও দক্ষিণে দত্তঘাটের মধ্যে অবস্থিত ছিল এবং এটাও অনুমান করা যেতে পারে যে মুল চেহারায় না হলেও কিছুটা বা অনেকটা পরিবর্তিত আকারে বাড়ি ছুটি এখনও আছে। রচনাটি পাঠ করে যদি কেউ বাড়ি দুটিকে সনাক্ত করতে উদ্যোগী হন সেটা খুবই আনন্দের ব্যাপার হবে। সেই সঙ্গে ইতিহাস মনস্কতায় বাড়বে।
গবেষণা এবং স্বত্বাধিকার: প্রলিপ্ত টিম